Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

শিক্ষা ক্যাডারে প্রমোশনে দরকার কার্যকর পদক্ষেপ

অরিয়ন তালুকদার

জুন ৩০, ২০২১, ০৭:৪০ পিএম


শিক্ষা ক্যাডারে প্রমোশনে দরকার কার্যকর পদক্ষেপ
  • বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের জট কমাতে বিভিন্ন ভ্যানুতে একযোগে প্রশিক্ষণ শুরুর সিদ্ধান্তকে নবীন কর্মকর্তারা সাধুবাদ জানিয়েছেন কিন্তু কার্যক্রম শুরু হয়নি। অন্যান্য ক্যাডারের ৩৮তম ব্যাচ বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে ফেলেছেন, কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের ৩৫তম ব্যাচের অনেকেরই সুযোগ হয়নি তাতে অংশ নেয়ার। চাকরি স্থায়ীকরণ তো সুদূর-পরাহত। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অভিমানের খেয়ার মতো বলতে চাই, অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই, কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই

ইংরেজি ‘ফার্স’ এর বাংলা সমার্থক শব্দ হলো প্রহসন। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি মহাকবি ও এবং প্রহসন রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৬০ সালে দুটি স্বার্থক প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ রচনা করেন। তার জীবনকাল একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বর্ধিত হলে তিনি হয়তো ‘একেই কি বলে প্রমোশন’ নামে নতুন কোনো প্রহসন রচনা করতেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন উচ্চ শিল্প ও সামাজিক মূল্যধারণ করলেও হালে ডিপিসি ঘেরাটোপে প্রমোশন নামক যে উচ্চমার্গীয় প্রহসনের নিয়ত মঞ্চায়ন হচ্ছে তা শিল্প মূল্যহীন এবং শিক্ষা ক্যাডারকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে ও ফেসবুকে ঝড় তুলে অনেকে পদোন্নতির ক্রেডিট নিলেও বরাবরের মতোই বাস্তবে কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না পদোন্নতিযোগ্য শিক্ষা ক্যাডারের সাধারণ সদস্যরা। গত ৯ মে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির প্রথম সভা শুরুর আগে আওয়াজ তোলা হয় তিন হাজার ৩০৮ জন শিক্ষককে পদোন্নতি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ে শূন্য পদ সংখ্যা এক হাজার ৮০ ও ৫৬০-এর বিপরীতে পদোন্নতিযোগ্য মোট কর্মকর্তার সংখ্যা পাঁচ হাজার ৭৮৪ জন। ২০১৮ সালে সর্বশেষ পদোন্নতি নামক ধূমকেতুর দেখা মিলেছিল শিক্ষা ক্যাড়ারে। ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতি সমস্যা সমাধানে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছেন তারই অংশ হিসেবে তারা ৬ মে শিক্ষামন্ত্রীর  বরাবর  স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। সর্বশেষে আবেদন দিয়েছেন আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী  হিসেবে  খ্যাত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে।

গত ৩০ মে দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেয়া লিখিত আবেদনে তিন বছর ধরে পদোন্নতিবিহীন সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য তিন হাজার ৩০৮ জন কর্মকর্তা এবং সহকারী অধ্যাপক পদে দুই হাজার ৪৭৬ জন কর্মকর্তার সবার পদোন্নতি দাবি করা হয়। আবেদনে বিভিন্ন ব্যাচের পদোন্নতি বঞ্চনার পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, ১০-১২ বছরেও পদোন্নতি না পাওয়া শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে নিজ ক্যাডার নিয়ে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। পদসোপান অনুযায়ী, এখন শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপকরা সর্বোচ্চ চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত যেতে পারেন। কিন্তু তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম গ্রেড পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়া ২৭তম বিসিএসের কোনো কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেখানে এখন পঞ্চম গ্রেড পাচ্ছেন, সেখানে ১৬তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারের অনেকেই পঞ্চম গ্রেডে (সহযোগী অধ্যাপক) চাকরি করে অবসরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন। এ রকম বিভিন্ন বৈষম্যের কথা তুলে ধরে তা সমাধানের দাবি জানানো হয় আবেদনে। কিন্তু তারপরও কোনো অদৃশ্য কারণে স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না হাজার হাজার কর্মকর্তার পদোন্নতি সমস্যার উত্তর মিলছে না। তিন বছর পর শুধুই শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি দিলে অথবা যেকোনো একটি টায়ারে পদোন্নতি দিলে সমস্যার সাময়িক সমাধান মিলবে। স্থায়ী  সমাধানকল্পে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি অথবা সুপার নিউমারি পদ সৃজনের বিকল্প নেই। গত ৯ মের পর থেকে অনেক ক্যাডারের ডিপিসি বসেছে, পদোন্নতির জিও হয়েছে, পদ্মা-মেঘনায় হাজার হাজার কিউসেক জল গড়িয়েছে শত শত আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রগুলো থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছেছে কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতি ডিপিসি থেকে জিও পর্যন্ত পৌঁছায়নি।

অতলান্ত বিষাদগ্রস্ত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা যারপরনাই হতাশ। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো একজনের নিজের গায়ে আগুন জ্বেলে আত্মাহুতি দেয়ার স্ট্যাটাসে। আমি দুর্নীতির প্রতিবাদে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বরে তিউনিসিয়ার সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বাওয়াজিজি নিজের গায়ে আগুন জ্বেলে আত্মাহুতি দেয়ার কথা বলছি না, আমি বলছি ৩১তম বিসিএসের এক নারী কর্মকর্তার কথা। কেন তার এমন আত্মঘাতী অনুভূতির উদয় হলো! তার সাবেক রুমমেট যিনি ব্যাংকে কর্মরত তিনি প্রমোশন পেয়ে পঞ্চম গ্রেডে চলে গেছেন শুধু তাই নয়, অন্য ক্যাডারে কর্মরত ব্যাচম্যাটরাও দীর্ঘ দিন যাবৎ আছেন ষষ্ঠ গ্রেডে যদিও তারা প্রায় একই সাথে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। তাহলে তিনি কি শুধু প্রমোশন বঞ্চিত হয়ে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! না। তিনি যখন দেখেন তার সহকর্মীরা বোর্ড থেকে মাথায় করে পরীক্ষার খাতা বয়ে আনেন কিংবা নিজ ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদে থাকা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের জন্য কোনো যানবাহন নেই অথচ বেতন স্কেলে অনেক পেছনে থাকা বিভিন্ন ক্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তারা সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। যুগ্ম সচিব, উপসচিব এমনকি ব্যাংকাররাও  গাড়ি কেনার ঋণ পাচ্ছেন অথবা তিনি নিজে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও হচ্ছেন অন্যরা তখন তার এমন অনুভূতিকে নিতান্তই আবেগ বলে পাশ কাটানো যাবে না। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার পর  দেশের সব ইউএনওর নিরাপত্তায়  তড়িৎগতিতে চারজন সশস্ত্র আনসার দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও বিভিন্ন সময় অধ্যক্ষসহ অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তার ওপর হামলা হলেও পরবর্তীতে এমন অনভিপ্রেত ঘটনা এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। করোনায় অনলাইন শিক্ষা  কার্যক্রম পরিচালনার এক বছর অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু পাঠদানের প্রয়োজনীয় উপকরণ মোবাইল, ল্যাপটপ কিংবা ইন্টারনেট ভাতা দেয়ার তাগিদ অনুভব করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে তৃতীয় গ্রেডে গেলেও শিক্ষা ক্যাডারের পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তারা অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে চতুর্থ গ্রেডে যান। অষ্টম জাতীয় স্কেল, কার্যকরের আগে চতুর্থ গ্রেড পাওয়া শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা সিলেকশন গ্রেড পেয়ে তৃতীয় গ্রেডে যাওয়ার সুযোগও ২০১৫ সালে সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় বন্ধ হয়ে গেছে। তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক স্তরের পদোন্নতি। এমনিতেই ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির পরিবর্তে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতির কারণে এই ক্যাডারের পদোন্নতির গতি স্লো। প্রায় ৩০ বছর চাকরি করার পরও অনেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি না পেয়েই অবসরে চলে যাচ্ছেন। একটানা ১৬-১৭ বছর কোনো প্রমোশন না পাওয়ারও বিরল রেকর্ডও আছে। এক সময়ে মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ ১৪তম এবং তার অধীনে কর্মরত উপাধ্যক্ষ সপ্তম বিসিএসের কর্মকর্তা ছিলেন। এমন অনেক সরকারি কলেজেই জ্যেষ্ঠদের ‘এসিআর’ লিখছেন কনিষ্ঠরা। বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতির পরিবর্তে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা অনুসরণ করলে সমস্যার অনেকটা সমাধান সম্ভব। শিক্ষা ‘ভ্যাকেশন’ ডিপার্টমেন্ট  হিসেবে গণ্য হলেও এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা সরকারি কলেজে সরাসরি শিক্ষকতায় সম্পৃক্ত রয়েছেন, তারা অর্জিত ছুটির আর্থিক সুবিধা থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ শনিবার এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবসে যখন অন্যরা পরিবার পরিজন নিয়ে সময় কাটান তখন তাদের  দায়িত্ব পালন করতে হয়। এতে অবসরের সময় তাদের গড়ে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু ক্রমাগত বঞ্চনা, অপ্রাপ্তি, বৈষম্য তাদের ক্যাডারের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের কর্মস্পৃহাকে হ্রাস করে দিচ্ছে। তাতে নতুনমাত্রা যোগ করেছে ২৮৩ বেসরকারি কলেজ সরকারিকরণ ও এসব কলেজে কর্মরত প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষককে আত্তীকরণ। যেখানে ক্যাডার কর্মকর্তাদের সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে যোগদান করতে প্রায় বছর খানেক লেগে যায় এবং চাকরি স্থায়ীকরণ হতে বিভাগীয় পরীক্ষা, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের বৈতরণী পার হতে দুই বছর সময় প্রয়োজন হয় সেখানে তাদের নামমাত্র পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ ছাড়াই কিভাবে স্থায়ী করণ হয় তা বোধ্যগম্য নয়।

অন্য ক্যাডারে ছয়টি স্তর থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারে মাত্র চারটি। আবার উচ্চক্রম অনুযায়ী ওপরের দিকে পদের সংখ্যা অনেক কম। শুধু তাই নয় উচ্চ শিক্ষায় নিয়োজিত এই জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের উচ্চতর ডিগ্রি  অধিকতর প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট মহলের গুণগত শিক্ষার প্রসারে এবং দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে চিরায়ত উদাসীনতা স্বরূপ আবারো স্পষ্ট  হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত উচ্চশিক্ষা বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকা থেকে। যেখানে এই বিদ্যাশিল্পীদের স্বল্প সংখ্যক বৃত্তি নামক অমাবস্যার চাঁদের দেখা পেয়েছেন। অথচ শিক্ষার্থীদের স্বার্থে জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের এই উচ্চ শিক্ষাবৃত্তি লাভের সুযোগ অবারিত হওয়া উচিত ছিলো। বাস্তবে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ফলে অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট লাভের সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উল্টো পথেই হাঁটছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের জট কমাতে বিভিন্ন ভ্যানুতে একযোগে প্রশিক্ষণ শুরুর সিদ্ধান্তকে নবীন কর্মকর্তারা সাধুবাদ জানিয়েছেন কিন্তু কার্যক্রম শুরু হয়নি। অন্যান্য ক্যাডারের ৩৮তম ব্যাচ বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে ফেলেছেন, কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের ৩৫তম ব্যাচের অনেকেরই সুযোগ হয়নি তাতে অংশ নেয়ার। চাকরি স্থায়ীকরণ তো সুদূর-পরাহত। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অভিমানের খেয়ার মতো বলতে চাই, অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই, কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই। আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন— আর কতদিন?

লেখক : শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত

আমারসংবাদ/জেআই