Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

সম্মুখসারির যোদ্ধা ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী

অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ

জুলাই ৪, ২০২১, ০৭:০০ পিএম


সম্মুখসারির যোদ্ধা ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনার প্যানডেমিক চলছে তার আপন গতিতে, তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বে। যেহেতু করোনা সম্পূর্ণ একটি নতুন রোগ, তাই শুরুতে এর চিকিৎসক এবং প্রতিরোধব্যবস্থা নিয়ে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং জনগণের মাঝে ভয়ভীতি ছিলো এবং সেটা থাকাটাই স্বাভাবিক। এমনকি ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীও কিন্তু আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। কারণ এর উৎপত্তি, জটিলতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা কোনো কিছুই কারো জানা ছিলো না। শুরুতে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে রোগী এবং তার স্বজনদের অভিযোগ ছিলো অনেক। যেমন— ডাক্তাররা রোগীর কাছে যায় না, গায়ে হাত দেয় না, রোগের কথা শোনে না, ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে না, টেলিফোনে চিকিৎসক দেয় ইত্যাদি। নার্সরা রোগীর সেবা পরিচর্যা ঠিকভাবে করে না, ওষুধ খাওয়ায় না, এমনকি অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর খাবারদাবার ঠিকমতো দেয় না। তবে বর্তমানের পরিস্থিতি অনেক উন্নত। ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রথম সারির যোদ্ধা, তারা সব ভয় জয় করে জীবনবাজি রেখেই আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে, করোনাকালের পুরোটা সময় অভাবনীয় সেবা দিয়েছেন এবং দিয়ে চলছেন। শুরুতেই অনেক সমস্যার মধ্যে ওষুধপত্র ও চিকিৎসাসামগ্রীর অভাব এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমাবদ্ধতা ছিলো। তবে সীমিত সামর্থ্য এবং সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চিকিৎসকরা নেমে পড়েন করোনা মোকাবিলায়। এমনকি লকডাউন ঘোষণার পর সারা দেশের মানুষ যখন ঘরবন্দি, তখন বিরামহীনভাবে করোনা আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, তারা প্রস্তুত এ মহামারি মোকাবিলায়।

করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি বেশ কিছু হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণাসহ সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড ইউনিট খোলা হয়। এ ছাড়া বেশ কিছু ফিল্ড হাসপাতালও প্রস্তুত করা হয় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। করোনার প্রকোপ বেড়ে গেলে এর চাপ পড়ে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর। এসব উপেক্ষা করেই কোভিড হাসপাতালে যেসব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত আছেন, তারা কিন্তু জীবন বাজি রেখেই চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ভয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে বিরত থাকেননি। এসব হাসপাতালে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এবং সুচারুরূপে করোনার চিকিৎসা দিয়ে আসছেন চিকিৎসকরা। এর প্রমাণ মেলে করোনায় মৃত্যুর হার পর্যালোচনা করলে। সারা বিশ্বে কোভিডে মৃত্যুর হার যেখানে প্রায় ২.০৭ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ১.৫৮ শতাংশ। অনেক উন্নত দেশের মৃত্যুর সংখ্যা যেখানে লাখ লাখ, সেখানে আমাদের দেশের মৃত্যু এখনো কয়েক হাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে এতে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। যারা মারা গেছেন বা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের জন্য আমরা সত্যিই মর্মাহত, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সাধারণ মানুষ যখন করোনার ভয়ে ভীত, কোনো হাসপাতালের আশপাশ দিয়ে গমনও করে না, নিরুপায় ও নিতান্তই অসহায় হয়ে যখন ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন, তখন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই কিন্তু পরিবার-পরিজন ফেলে হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। রোগীর সঙ্গে কথা বলছেন, আশার বাণী শোনাচ্ছেন, সরাসরি স্পর্শ করছেন, রোগীর গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। নার্সরা ইনজেকশন-স্যালাইন পুশ করছেন, ওষুধ ও খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন, নিয়মিত ব্লাড প্রেশার, পালস, শরীরের তাপমাত্রা এবং অক্সিজেন মেপে দেখছেন। অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীকে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে অনেক ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সারা দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ৯১০ জন চিকিৎসক, এক হাজার ৯৯৮ জন নার্স এবং তিন হাজার ২৯৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চিকিৎসকরা শুরুর দিকে মাস্ক ও সুরক্ষা পোশাকের সংকটে পড়েন, সে কারণে অনেক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হন। অত্যন্ত দুঃখজনক সংবাদ হলো, ইতোমধ্যে ১৫০ জনের বেশি চিকিৎসক মারা গেছেন ভয়াবহ এই করোনার ছোবলে। এই ক্ষতি নিঃসন্দেহে অপূরণীয়, কারণ একজন চিকিৎসক তৈরি হতে অনেক দিন সময় লাগে। করোনার ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসকরা যেমন রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন, তেমনি রোগীর পাশে থেকে সেবা দিয়েছেন নার্সরা। বিপুল সংখ্যক নার্স আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন প্রায় ২৫ জন।

এ ছাড়া কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালক, আইসিইউতে কর্মরত ইনচার্জ, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং কোভিড-পরবর্তী জটিলতায় এখনো ভুগছেন। অনেকে চলেই গেছেন চিরতরে! চিকিৎসকদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ অতিরিক্ত রোগীর চাপ। হাসপাতালগুলোতে যত বেশি রোগীর চাপ বাড়ছে, তত বেশি চিকিৎসক আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া করোনা ভাইরাসের ধরনগুলো বর্তমানে এত বেশি সক্রিয় যে তা খুব দ্রুত ফুসফুসকে সংক্রমিত করছে, এতে রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকরাও আক্রান্ত হচ্ছেন এবং সবারই মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। চিকিৎসকরা একটা মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে করোনার চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। চলমান এই চাপে রোগী সামাল দেয়াও তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসক-নার্সরা কিন্তু পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। অতিরিক্ত রোগী হলে বা রোগীর চাপ বেশি হলে এসব সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীই দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে কিন্তু নতুন করে কাউকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না বা জনবল বাড়ানো হচ্ছে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লে তার চাপটা গিয়ে পড়ছে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপরই। তখনই নানা অভিযোগ আসছে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা নিয়ে। অথচ আমরা বাস্তবতা উপলব্ধি করছি না। চিকিৎসাসামগ্রীর অপ্রতুলতাসহ বিভিন্ন কারণে ডাক্তারের অসহায়ত্ব রোগী ও তার স্বজনদের উপলব্ধি করা উচিত।

অনেকে হয়তো জানেন না— চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা রোগীদের ডিউটি পালন শেষে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসবাস করতে পারেন না, একসঙ্গে ঘুমাতেও পারেন না। ডিউটি পালন শেষে তাদেরকে ১৪ দিনের জন্য হোটেল বা অন্য কোথাও কোয়ারেন্টাইনে থেকে তারপরে আবার ডিউটি পালন করতে হচ্ছে। শুরুতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে হোটেলের ব্যবস্থা ছিলো, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিলো বিশৃঙ্খল। চিকিৎসকদের হোটেল বিল বাবদ অনেক বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে, এরকম সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমানে এই ব্যবস্থা আর নেই। কিন্তু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চিকিৎসকদের এক ধরনের সংকটে পড়তে হয়েছে। অনেককেই নিজের বাসায় থাকতে হয় এবং তারা বাসায় আলাদা রুমে থাকলেও সব সময় আতঙ্কে থাকেন এই ভেবে যে, তার মাধ্যমে পরিবার-পরিজন করোনায় আক্রান্ত হয় কি-না। এ ছাড়া ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনও অসহ্য যন্ত্রণার মতো, এই সময় একটু দরজার ফাঁক দিয়ে বা দরজা দিয়ে চিকিৎসকরা তাদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে হয়তো একটু কথা বলেন বা দেখেন।

তবে এত কিছু সত্ত্বেও চিকিৎসকদের ভাগ্যে জুটেছে শুধু বঞ্চনা, যেখানে অনেক দেশে চিকিৎসকরা সুপার হিরোর মর্যাদা এবং স্যালুট পেয়েছেন। চিকিৎসকরা পালিয়ে গেছেন, দায়িত্ব পালন করছেন না, এরকম গুজব ছড়ানো হয়েছিল। আসলে চিকিৎসকদের কাজ তো চিকিৎসা করা, তাহলে তারা পালিয়ে যাবেন কেন? লকডাউনের সময় চিকিৎসকদের নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারার কথা। কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে বাধা, জরিমানা এমনকি চিকিৎসক পরিচয় দেয়ার পরও অপমানের মুখে পড়েন, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা বা প্রণোদনা পাননি। এমনকি মৃতদের পরিবার-পরিজনদের প্রণোদনা দেয়া হয়নি। আমি মনে করি, প্রতিটি পরিবারকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়া উচিত। ডাক্তাররা কিন্তু সেবা দিচ্ছেন প্রণোদনা বা আর্থিক লোভের বশবর্তী না হয়ে, তবে তাদের প্রাপ্যটুকু দিলে অবশ্যই তারা আরো উৎসাহিত হবেন। এত কিছুর পরও কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নিজেদের সর্বোচ্চটুকু ঢেলে দিয়েছেন চিকিৎসকরা, তারা দমে যাননি বরং জ্ঞানের সর্বোচ্চটুকু ঢেলে দিয়ে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন জনগণের। যেসব চিকিৎসক বিভিন্ন কারণে সরাসরি চিকিৎসা দিতে পারেননি, তারা টেলিমেডিসিন ও ভিডিও কলে সেবা দিয়েছেন অসংখ্য মানুষকে। আশা করি, জাতির ক্রান্তিকালে চিকিৎসকদের এসব অবদান, ত্যাগ, কর্ম, সেবা সবাই মনে রাখবেন এবং প্রাপ্য সম্মানটুকু দেবেন।

সিলেটের একটি আঞ্চলিক খুবই জনপ্রিয় গান— ‘আইলারে নয়া দামান, আসমানেরও তেরা, বিছানা বিছাইয়া দিলাম, সাইল ধানের নেড়া, দামান বও, দামান বও।’ শুধু চিকিৎসাসেবাই নয়, ডাক্তাররা সিলেটের এই জনপ্রিয় গানটি নেচে গেয়ে রোগীদের আনন্দও দিচ্ছেন এবং মনোবল বাড়াচ্ছেন। করোনা ভাইরাসজনিত সংক্রমণ সম্পূর্ণ নতুন একটি রোগ। এই সংক্রমণ ইতোমধ্যে বিশ্বকে তছনছ করে দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র কিংবা উন্নত রাষ্ট্রগুলোও আজ ধরাশায়ী হয়েছে এই সংক্রমণের কাছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন স্ট্রেইন দেখা যাচ্ছে। সুতরাং এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কিংবা বেঁচে থাকতে হলে সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। তাই আসুন, আমার নিজ জীবনের কথা চিন্তা করে, আমাদের পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনের জীবনের কথা চিন্তা করে, আমাদের চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা চিন্তা করে, চিকিৎসাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে আরো অধিক সতর্ক হই। করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে জরুরি ব্যক্তির সচেতনতা ও সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। একই সঙ্গে হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে এবং তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে পুরো ব্যবস্থাই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। সবাইকে এটা বুঝতে হবে আমরা এক বিশেষ ও ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রচেষ্টা ছাড়া এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব নয়।

লেখক : ইউজিসি অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

আমারসংবাদ/জেআই