Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

শেষ সঞ্চয়ে আঘাত

জুলাই ১০, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


শেষ সঞ্চয়ে আঘাত
  • ৮০ শতাংশ লোক ব্যবসার পুঁজি ভেঙে খাচ্ছেন
  • ৬০ শতাংশ লোক সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে
  • ৮৬ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর দুঃসময়
  • কর্মসংস্থান হারিয়েছেন ২৬ লাখের বেশি
  • দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ
  • বেকার মানুষের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে
  • দরিদ্র হয়েছেন দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ
  • আড়াই কোটি দরিদ্র মানুষকে কতদিন সরকার খাওয়াবে —প্রশ্ন

খাদিজা বেগম! চার সন্তানের জননী। থাকেন রাজধানীর হাতিরপুল এলাকায়। স্বামী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিন সন্তানই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়েন। করোনার প্রভাবে দীর্ঘ এক বছর স্বামীর আগের মতো আয় নেই। বাসা ভাড়া দেয়া ও সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড় মেয়ের বিয়েকে সামনে রেখে খাদিজা বেগম একটি ব্যাংকে বিগত পাঁচ বছরে লাখ তিনেক টাকা সঞ্চয় করেন। এরই মধ্যে তিন-চার মাসের বাসা ভাড়া জমে যাওয়ায় এবং সংসারে টানাপড়েন দেখা দেয়ায় শেষ সম্বলেও আঘাত আসে। গত তিনদিন আগে ব্যাংক থেকে মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো টাকা এনে সংসারে খরচ করেন। শুধু খাদিজা বেগম নন, দেশের সকল ব্যবসায়ী, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সবার ঘরেই করোনার প্রভাব পড়েছে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো থেকে দাবি উঠেছে, তাদের ৮০ শতাংশ লোক ব্যবসার মূল পুঁজি ভেঙে খাওয়া শুরু করেছেন। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে তাদের বড় একটি অংশ। এ ছাড়া মধ্যবিত্ত যারা রয়েছেন তারা সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শুরু করেছেন। বেশ কয়েকটি জরিপ সংস্থায় উঠে এসেছে — দেশের ৬০ শতাংশ লোক সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শুরু করেছেন। অন্যদিকে, দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর উপর করা জরিপ বলছে— করোনার এই সময়ে দেশে দুই কোটির উপরে মানুষ গরিব হয়ে গেছে।

নীলক্ষেতে বাসমান চায়ের দোকান করেন আরিফ হোসাইন। তিনি বলেন, ‘দোকান খোলা থাকলে আমার ১২শ থেকে ১৫শ টাকা আয় হয়। গত এক বছর বারবার লকডাউন দেয়ায় আমার কিছু টাকা সন্তানদের জন্য ও ঘর দেয়ার জন্য জমা ছিলো। গত পাঁচ-ছয় মাসে তার বড় অংশই শেষ হয়ে গেছে। খুব দুশ্চিন্তায় সময় পার করছি। কবে পৃথিবী শান্ত হবে।’ বেসরকারি জব করেন নুরুল আমিন নয়ন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বড়লোকের গাড়ি চলে, গরিবের সিএনজি-বাস বন্ধ। বড়লোকের অফিস চলে, গরিবের দোকান বন্ধ। গরিব মানুষের সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।’

সংক্রমণ ঠেকাতে গত এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। বর্তমানে দেশব্যাপী চলছে কঠোর বিধিনিষেধ। এতে সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ রয়েছে। এছাড়া সড়ক, রেল ও নৌপথ, গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব ধরনের যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে শপিংমল, মার্কেটসহ সব দোকানপাট, পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে চালু আছে শিল্প-কারখানা, পুঁজিবাজার, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঘরে ঘরে সন্তানদের নিয়ে মহাচিন্তায় অভিভাবকরা।

অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ছোট-বড় সব ধরনের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, হোটেল, চায়ের দোকানি, মুদি দোকান, মনোহারি দোকানি আছেন প্রায় ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৯৪ জন। এর মধ্যে গ্রামে অবস্থান করছেন ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯২০ জন। আর শহরে অবস্থান ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৭৪ জন। এদের মধ্যে ফেরিওয়ালা, হকার ও ভ্যানে পণ্য বিক্রেতা আছেন ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৭১৯ জন, চা-পান বিক্রেতা আছেন ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৮৫ জন। এরা সবাই এই লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া নির্মাণ খাতে জড়িত আছে ৩৪ লাখ লোক এবং পরিবহন খাতে আছে ৫২ লাখ শ্রমিক। এসব খাতের লোকজন কর্মহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। সমপ্রতি এটুআই আইএফসি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইউএনডিপি, ডব্লিউআরএফ, লংকাবাংলা, লাইট ক্যাস্টল ও এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে— দেশের ৬০ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সঞ্চয় ভেঙে এখন জীবিকা নির্বাহ করছেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সামপ্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া মহামারির কারণে দেশের মানুষ কী পরিমাণ কর্মসংস্থান হারিয়েছে তার একটি গবেষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সমপ্রতি বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৯ সদস্যের একটি গবেষক দল। বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তারা জানিয়েছে, মহামারির কারণে দেশে গত বছর কর্মসংস্থান হারিয়েছে ২৬ লাখের বেশি মানুষ।

ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি বন্ধ থাকায় দীর্ঘ হচ্ছে আর্থিক ক্ষতি। গত ২৯ জুন জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এক বছরে করোনা মহামারিতে অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারিতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ ৪৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (১৭শ কোটি মার্কিন ডলার)। সরকারি হিসাবে, সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারিতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ ৪৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (১৭শ কোটি মার্কিন ডলার)। লকডাউনে ভেঙে পড়েছে কয়েক লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। রীতিমতো স্থবির পর্যটন খাত। আর চাকরিচ্যুতসহ নানা কারণে কমছে মানুষের আয়। চলমান লকডাউন কতদিন দীর্ঘায়িত হবে, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের দুশ্চিন্তার যেনো শেষ নেই। কারণ শেষ অবলম্বন হিসেবে রাখা সঞ্চয়ে আবার আঘাত আসছে।

লিও খান বলেন, এই লকডাউনে  যখন সেনা, বিজিবি, পুলিশ আসে তখন পাবলিক পলায়ন করে। যখন পুলিশ, সেনা, বিজিবি চলে যায়। তখন জনগণ আগের মতো একত্রিত হয়। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে শাস্তিই এখন বড় বিষয়। না হয় মানুষ আরো বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে।’ শাকিল আহমেদ বলেন, ‘ঈদযাত্রা তো বন্ধ সম্ভব নয়। বরং সরকার সব কিছু শিথিল করে দিয়ে আইন প্রয়োগ কঠোর করুক, তাহলেই হবে। শুধু যান বন্ধ করে করোনা সংক্রমণ কমানো অসুন্দর হয়ে যাবে। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দুঃসময় রয়েছে। তেমনি বন্দি জীবন থেকে স্বজনদের কাছেও যাইতে চাইবে।’

ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যারা রয়েছেন তাদের ৮০ শতাংশ লোক পুঁজি ভেঙে খাওয়া শুরু করেছেন। এভাবে আর কিছু সময় চলতে থাকলে সবারই পুঁজি শেষ হয়ে যাবে। অন্ধকার নেমে আসবে ছোট ব্যবসায়ীদের জীবনে। তারা আর দাঁড়াতে পারবেন কি-না তাও সন্দেহ হচ্ছে। আর এই সংক্রমণ কবে শেষ হবে তাও একমাত্র আল্লাহই জানেন। কবে মৃত্যু কমবে কবে সংক্রমণ কমবে আমরা কেউ জানি না। এ পরিস্থিতিতে শুধু আমরা নই, সব পেশার মানুষই বড় কষ্টের মধ্যে রয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘বৈশ্বিক মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশেও বড় প্রভাব পড়েছে। কমে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ, একের পর এক বাতিল হচ্ছে পোশাক খাতের ক্রয়াদেশ, বন্ধ রয়েছে দেশের অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিনিয়তই লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আর এ সবকিছু বিবেচনায় সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির ওপর এ প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে মানুষকে যদি তার আয় থেকে দূরে রাখা হয়, সে কতদিন চলতে পারবে, আড়াই কোটি দরিদ্র মানুষকে কতদিন সরকার খাওয়াতে পারবে, তাই তাদের কাজের মধ্যে রাখতে হবে। মানুষ বেকার হলে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। এখনই রাস্তায় ভিক্ষুক বা সাহায্যপ্রার্থী মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ছে। আমি কেবল একটা কথাই বলবো, লকডাউন করোনা ভাইরাসের চেয়েও ক্ষতিকর।’ তিনি আরো বলেন, ‘কঠোর লকডাউনের মধ্যেও ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রাখতে হবে, সেটা সীমিত পরিসরে হলেও। কারণ ব্যাংক বন্ধ থাকলে কেবল ব্যক্তি গ্রাহকই অসুবিধার সম্মুখীন হবেন না, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

আমারসংবাদ/জেআই