Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতেই ছাই ৫২ শ্রমিক!

জুলাই ১০, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতেই ছাই ৫২ শ্রমিক!
  • পুলিশের মামলায় চারদিনের রিমান্ডে কারখানা মালিক ও সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমসহ আটজন
  • প্রত্যেক ফ্লোরে লোহার তারের পার্টিশনে কেন তালা, সম্প্রতি বিক্ষোভ-কোম্পানি বন্ধে শ্রমিকদের হুমকি, এসআরদের ১০৬টি মোটরসাইকেল জব্দ করে নিলামে বিক্রিসহ নানা টানাপড়েন চলছিল কারখানাটিতে
  • প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু অনিয়ম আমাদের নজরে এসেছে, আমরা মামলা করবো এবং সর্বোচ্চ আইনগত পদক্ষেপ নেবো —স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
  • এটা শুধু দুর্ঘটনা নাকি অন্য কিছু, কারখানা নির্মাণে ত্রুটি ছিলো কি-না ও মালিকপক্ষের গাফিলতি কতটুকু, সব বিষয় আমলে নিয়েই অনুসন্ধানে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে —পুলিশ সুপার, নারায়ণগঞ্জ
  • পোড়া লাশের জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ঢামেক  ১৫ লাশ নেয়া হয়েছে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে

সেদিন কি ঘটেছিল হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুস তৈরির কারখানায়? অগ্নিকাণ্ড নাকি অগ্নিসংযোগ— এমন প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মহলে। এরই মধ্যে স্থানীয় ও হতাহতের স্বজনরা বিচ্ছিন্নভাবে অভিযোগ করছেন অগ্নিসংযোগের। কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগের মৌখিক অভিযোগের কারণ হিসেবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার শ্রমিকদের ভেতরে ঢুকিয়ে রহস্যজনক কারণে প্রত্যেকটি ফ্লোরে থাকা লোহার তারের পার্টিশনে তালা মেরে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ।

ওই দিন সন্ধ্যায় একতলার আগুন নিয়ন্ত্রণে কোনোরকম কার্যকরী ভূমিকাও গ্রহণ করেনি তারা। বরং শ্রমিকদের কাজ করে যেতে বলা হয়েছিল এবং আগুন নিভে যাবে বলেও আশ্বস্ত করা হয়েছিল। অথচ একতলার সেই আগুনই পরদিন শুক্রবার দুপুর নাগাদ উঠে আসে তৃতীয় তলায়। এর পরের গল্প সবারই জানা। সে পর্যন্তও খোলা হয়নি পার্টিশনের তালা। এর আগে ভেতরে বহু রকমের দাহ্যপদার্থ থাকায় সমস্যা হচ্ছিল বলেও বারবার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন শ্রমিকরা। সেই দাহ্যপদার্থই নিচতলার আগুন নিয়ে যায় ষষ্টতলা পর্যন্ত। কিন্তু শ্রমিকদের কোনো কথাই আমলে নেয়নি সেজান জুস কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও এক সপ্তাহ আগে বকেয়া বেতন ও ভাতার দাবিতেও শ্রমিকদের বিক্ষোভ এবং সম্প্রতি কিছু সংখ্যক কর্মচারীর বকেয়া বেতনসহ কোম্পানিটির সাথে বিভিন্ন টানাপড়েনের কারণে কোম্পানি বন্ধ করে দেয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন। যে কারণে কোম্পানির ১০৬ জন এসআরের ১০৬টি মোটরসাইকেলও ক্লোজ করে নিলামে বিক্রি করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এসব কারণকেই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করছেন হতাহতের স্বজনরা। তবে সার্বিক বিষয় আমলে নিয়েই আগুনের এ ঘটনার নেপথ্যের রহস্য উদ্ঘাটনে ইতোমধ্যেই অনুসন্ধানেও নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম। আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে ও কিভাবে এবং অগ্নিকাণ্ডের সাথে কর্তৃপক্ষের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি-না, এ নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি এসবই খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সবকটি সংস্থার গঠিত তিনটি তদন্ত কমিটিও। ইতোমধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিভিন্ন আলামতও জব্দ করেছে। কারখানায় কর্মরত শ্রমিক থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করছেন তারা। আগুন লাগার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি-না তাও অনুসন্ধানের চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে এই ঘটনায় কারখানা মালিক ও সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাসেমসহ আটজনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানার ভুলতা ফাঁড়ির ইনচার্জ নাজির উদ্দিন মজমুদার বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন— আবুল হাসেমের ছেলে হাসিব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহিম, তাওসীব ইব্রাহিম, তানজিব ইব্রাহিম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহেন শাহ আজাদ, উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সালাহউদ্দিন। গতকাল চেয়ারম্যানসহ আটজনকে আটকের পর আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত আটজনের চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে বলে নিশ্চিত করেন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম।

এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ত্রুটি খুঁজে বের করা হবে। প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু অনিয়ম আমাদের নজরে এসেছে। দোষীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা মামলা করবো এবং সর্বোচ্চ আইনগত পদক্ষেপ নেবো। এ ছাড়া আহতদের সুচিকিৎসা এবং নিহতদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তাও অব্যাহত থাকবে।’ 

জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর লকডাউন শুরুর প্রথম দিন বকেয়া বেতন ও ভাতার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন সেজান জুস কারখানার শ্রমিকরা। এর এক সপ্তাহের মাথায় কারখানাটিতে ঘটলো অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনা। এতে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, শ্রমিকদের বেতন ও ভাতার দাবিতে বিক্ষোভের সঙ্গে কি আগুনের এ ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে কি-না? শ্রমিক বিক্ষোভের এক সপ্তাহের মাথায়ই বা কেন আগুন লাগলো? শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেজান জুস কারখানায় শ্রমিকদের এক মাসের বেতন বকেয়া রেখে চলতি মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়। অর্থাৎ, সবসময়ই এক মাসের বেতন বকেয়া থাকে। যে কারণে বেতন পরিশোধের দাবি জানিয়ে আসছিলেন তারা। কিন্তু মালিকপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি। এতে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে বকেয়া বেতন ও ওভারটাইমের টাকার দাবিতে গত ১ জুলাই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তাই মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্বের কারণে কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে কি-না, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. জায়েদুল আলম বলেন, ‘সেজান জুস কারখানায় আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত কোথা থেকে, কী কারণে আগুন এমন ভয়াবহ রূপ নিলো, এত শ্রমিকের প্রাণহানি কেন ঘটলো, আগুন লাগার পর শ্রমিকরা কারখানা থেকে কেন বের হতে পারেননি, এটা শুধু দুর্ঘটনা নাকি অন্য কিছু! কারখানা নির্মাণে ত্রুটি ছিলো কি-না ও মালিকপক্ষের গাফিলতি কতটুকু— সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’

এদিকে এ ঘটনায় নিহতদের জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যে কারণে বাধ্য হয়ে ১৫ জনের মরদেহ নেয়া হয়েছে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে। আটটি মরদেহ আছে ঢামেকের জরুরি বিভাগের মর্গে। ২৫টি রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। ঢামেকে পুড়ে যাওয়া মরদেহগুলোর পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা চলছে। গতকাল বেলা আড়াইটা পর্যন্ত ৩৬ মরদেহের বিপরীতে ৫০ জন স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিআইডির সহকারী ডিএনএ অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন। এর আগে শুক্রবার বিকেল ৫টা থেকে ঢামেক মর্গের সামনে বুথ বসিয়ে নমুনা সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা হয়। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলে এ কার্যক্রম। শনিবার সকাল ৮টা থেকে ফের নেয়া হয় স্বজনদের নমুনা। প্রতিটি মরদেহের স্বজন না আসা পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ কার্যক্রমের বিষয়ে নুসরাত বলেন, ‘আজ সারা দিন আছি। হয়তো আগামীকালও (রোববার) থাকবো।’

আমারসংবাদ/জেআই