Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

নারী সুরক্ষায় জনসংখ্যা হোক জনসম্পদ

ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

জুলাই ১০, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


নারী সুরক্ষায় জনসংখ্যা হোক জনসম্পদ
  • পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। নতুন আর কি কি পদক্ষেপ নেয়া যায়, কিংবা কিভাবে মানুষের ভোগান্তি কমিয়ে আনা যায়, এসব আরো একবার হিসাব-নিকাশ করার জন্যই আজকের এই দিনটি। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে যোগ হয়েছে নতুন নতুন সমস্যা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে খাদ্যাভাস ও অপুষ্টিজনিত কারণে। এছাড়া সুপেয় পানির অপ্রতুলতা, বাতাসের বিষাক্ততা, সম্পদের বিলুপ্তি, বাসস্থানের সমস্যা, ওজোন লেয়ার ধ্বংস ইত্যাদি বহু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব। তার উপর যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং কোভিড-১৯। তার মূলেও রয়েছে এই জনসংখা বৃদ্ধি

আজ ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। প্রতি বছর জাতিসংঘ তথা সারা বিশ্ব নানা রকম আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ দিনটি পালন করে থাকে। বিশ্বায়নে জনসংখ্যা- চ্যালেঞ্জ ও পরিকল্পিত পরিবারের সুবিধাসমূহের ব্যাপারে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করাই এ দিবস পালনের লক্ষ্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে— ‘অধিকার ও পছন্দই মূল কথা : প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রাধান্য পেলে, কাঙ্ক্ষিত জন্মহারে সমাধান মেলে।’ ধারণা করা হয়, ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে উন্নীত হয় এবং পরবর্তী সময়ে ইউএনডিপির গভর্ন্যান্স কাউন্সিল প্রতি বছর এই দিনটিকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করে আসছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৮০৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিলো ১০০ কোটি। এর দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছিল ১২৩ বছর। অর্থাৎ ১৯২৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ কোটিতে। এরপর ১৯৫৯ সালে অর্থাৎ ৩২ বছরে জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০ কোটিতে। এর ১৫ বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৪০০ কোটিতে। বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আরও কম। মাত্র ১৩ বছরে ১৯৮৭ সালে সংখ্যাটি ৫০০ কোটিতে পৌঁছায়। এরপর প্রতি ১২ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়েছে ১০০ কোটি করে। ১৯৯৯ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০০ কোটিতে। আর ২০১১ সালে তা ৭০০ কোটিতে পৌঁছায়।

সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় ৭৭১ কোটি। এই হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এই জনসংখ্যা বেড়ে এক হাজার কোটি অতিক্রম করবে। একটি রাষ্ট্রের যে কয়েকটি মৌলিক উপাদান রয়েছে তার মধ্যে জনসংখ্যা অন্যতম। আর এই জনসংখ্যা কোনো দেশের জন্য সম্পদ আবার কোনো দেশের জন্য বোঝা। কোনো কোনো দেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা না করে বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে প্রযুক্তি ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে অতিরিক্ত জনসংখ্যা দক্ষ করতে পারলে তা সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় অপুষ্টি, পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব, চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার মূলে রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যা। আর এসব বিষয়কে সামনে রেখে জনসংখ্যা বিষয়ক সমস্যাগুলো সকলকে অবহিত করা এবং তা গুরুত্ব সহকারে সমাধানের প্রচেষ্টা করাই হলো দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান আলোচনা করে দেখা যায়, ১৮৬০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিলো মাত্র দুই কোটি। ১৯৪১ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৪.২০ কোটি। অর্থাৎ ৮১ বছরে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ে মাত্র ২.২০ কোটি । আবার ১৯৬১ সালে জনসংখ্যা ছিলো ৫.৫২ কোটি যা ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১১.১৫ কোটিতে। অর্থাৎ ৩০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১২ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিলো ১৫.২৭ কোটি। ২০১৬ সালের জুলাইতে এই জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬.০৮ কোটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ এক হাজার, সে হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২২ কোটি ২৫ লাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, প্রতি মিনিটে বিশ্বে প্রায় ২৫০টি শিশু জন্মগ্রহণ করে। আর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে প্রায় ১০টি শিশু। সংস্থার আর এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে জন্ম নেয়া ১০০ শিশুর মধ্যে ৯৭ শিশু জন্মগ্রহণ করে তৃতীয় বিশ্বের তথা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। যে দেশগুলোতে এমনিতেই অধিক জনসংখ্যার দেশ। তাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের এই বছরের থিম মূলত বিশ্বজুড়ে মেয়েদের অধিকার রক্ষার এবং সুরক্ষাকেন্দ্রিক। প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে বোঝায়, যে লোকেরা একটি সন্তোষজনক এবং নিরাপদ যৌনজীবন অর্জন করতে সক্ষম এবং তাদের প্রজনন কখন এবং কিভাবে করা উচিত তা সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে। পুরুষ এবং মহিলাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের সম্পর্কে অবহিত করা উচিত এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের নিরাপদ, কার্যকর, সাশ্রয়ী এবং গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে তাদের প্রবেশাধিকার থাকা উচিত। পাশাপাশি যৌন প্রজনন সংশ্লিষ্ট ওষুধের উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা, পরিসেবাগুলো প্রাপ্তি এবং গর্ভাবস্থা ও প্রসবের সময় মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য এবং দম্পত্তিদের একটি স্বাস্থ্যকর শিশু জন্ম দেয়ার সবচেয়ে ভালো সুযোগ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার। এই সমস্ত কাঙ্ক্ষিত প্রজনন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অধিকার যদি মেয়েরা পায়, তবেই কার্যত জন্মহার রোধ করা সম্ভব হবে। তাই আমাদের সবার উচিত নারীদের সমঅধিকার দেয়া। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি কিশোর-কিশোরী রয়েছে। যারা এদেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় এক চতুর্থাংশ। তারপরও তাদের উপযোগী করে সেবার ব্যবস্থা করার চিন্তা এখনো ততটা গুরুত্ব পায় না। এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে। বাল্যবিয়ের উচ্চ হারের কারণে বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালে অনেক মেয়ে গর্ভধারণ, সহিংসতা ও অপুষ্টির ঝুঁকিতে থাকে। বর্তমানে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়স নারীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। এই বয়সে তারা প্রজনন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে তেমন সচেতন থাকে না। এই অবস্থার কারণে বাংলাদেশে অনেক নবজাতকের মৃত্যু হয়। আবার সন্তান প্রসবের পর মা ও শিশু রোগাক্রান্ত হন। বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালের তিনজন মেয়ের মধ্যে একজনই রুগ্ন। আর মেয়েদের ১১ শতাংশই অনেক বেশি রোগা, পাতলা। তাদের অধিকাংশেরই জিংক, আয়োডিন ও আয়রনের মতো পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের কিশোরী মেয়েদের অপুষ্টির পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। তা হলো— পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার না পাওয়া ও অল্প বয়সে গর্ভধারণ। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়াতে বিষয়টি এখানে অনেক প্রাসঙ্গিক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যার হার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও সেটা এখনো বেশ উদ্বেগজনক। বিবিএস ও ইউএনএফপির তথ্যমতে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘণবসতিপূর্ণ শহর হলো ঢাকা শহর। দেশের মোট ১০ শতাংশ লোক এই ঢাকা সিটিতে বাস করে। ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর গ্লোবাল সিটিস ইনস্টিটিউশন পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকা হবে বিশ্বের তৃতীয় জনসংখ্যা বহুল শহর এবং একই সময়ে জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখে। পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। নতুন আর কি কি পদক্ষেপ নেয়া যায়, কিংবা কিভাবে মানুষের ভোগান্তি কমিয়ে আনা যায়, এসব আরো একবার হিসাব-নিকাশ করার জন্যই আজকের এই দিনটি। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে যোগ হয়েছে নতুন নতুন সমস্যা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে খাদ্যাভাস ও অপুষ্টিজনিত কারণে। এছাড়া সুপেয় পানির অপ্রতুলতা, বাতাসের বিষাক্ততা, সম্পদের বিলুপ্তি, বাসস্থানের সমস্যা, ওজোন লেয়ার ধ্বংস ইত্যাদি বহু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব। তার উপর যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং কোভিড-১৯। তার মূলেও রয়েছে এই জনসংখা বৃদ্ধি।

লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

আমারসংবাদ/জেআই