Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ঢাকার বাইরে হাহাকার

মাহমুদুল হাসান

জুলাই ১১, ২০২১, ০৭:৩০ পিএম


ঢাকার বাইরে হাহাকার
  • এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক কোভিড পরিকল্পনা
  • ৭৫ শতাংশের বেশি মৃত্যু ঢাকার বাইরে
  • ঢাকার বাইরের ১৭ হাসপাতালে বাড়তি চাপ
  • দেশের ৮৯ হাসপাতালে নেই আইসিইউ
  • রাজধানীতেই অর্ধেকের বেশি কোভিড শয্যা
  • বিভাগীয় শহরে শুরু হয়নি ফিল্ড হাসপাতাল
  • মোট আইসিইউর ৭৩ শতাংশই ঢাকায়

করোনা সংক্রমণ বাড়লেও স্বাস্থ্যব্যবস্থা চলছে প্রলেপ আর জোড়াতালি দিয়ে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের কথা বলা হলেও তুলনামূলকভাবে বাড়েনি সক্ষমতা। আর যতটুকু বেড়েছে তার অধিকাংশই রাজধানীকে ঘিরে। এদিকে শনাক্ত-মৃত্যু সবকিছুই ঢাকার বাইরে বেশি। গতকাল মৃত্যু হয়েছে ২৩০ জনের। তার ৪ ভাগের ৩ ভাগই ঢাকার বাইরের। এ পর্যন্ত মৃত্যু প্রায় সাড়ে ১৬ হাজারের অর্ধেকের বেশি রাজধানীর বাইরের। অধিকাংশ সূচকে ঢাকার বাইরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পিছিয়ে পড়ার চিত্র রয়েছে। রয়েছে কোভিড পরিস্থিতির চরম অবনতির দৃশ্য। তবুও নজর নেই বাইরের জেলাগুলোতে।

সারা দেশে ১২৯টি কোভিড হাসপাতালের ৫৭টি ঢাকা বিভাগে। এসব হাসপাতালের দখলেই অর্ধেকের বেশি সাধারণ ও দুই তৃতীয়াংশ আইসিইউ বেড। অন্যদিকে বিভাগীয় শহরের আইসিইউ ও সাধারণ বেডের জন্য হাহাকার। সারা দেশে ৮৯টি হাসপাতালে নেই আইসিইউ বেড। এর মধ্যে ঢাকার বাইরের ৭৯টি হাসপাতাল। হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাও ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার মধ্যে রয়েছে ৫৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে বাকি সাত বিভাগে রয়েছে মাত্র ৪২ দশমিক ১৮ শতাংশ। রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা থাকলেও অক্সিজেন সিলিন্ডারের সবচেয়ে বেশি সরবরাহ ঢাকায়। ঢাকায় ৪০ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও সারা দেশে মাত্র ৫৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

এ ছাড়াও বিভাগীয় শহরের ১৭ হাসপাতালে সক্ষমতার চেয়েও বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। অন্যদিকে রাজধানীর বাইরে লোকবল সংকট তো দীর্ঘদিনের। অক্সিজেন কনসেনট্রেটরও ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ। তবে দেশের অন্যান্য সাতটি বিভাগে ৭৪ দশমিক ৩০ শতাংশ থাকলেও এককভাবে ঢাকায় রয়েছে ২৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। সংকটে ঘেরা রাজধানীর বাইরের কোভিড পরিস্থিতিও চরমভাবে বিপর্যয় ডেকে আনছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ঢাকার বাইরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেকটা জোড়াতালি দিয়েই চলছে। দীর্ঘদিন এসব ভোগান্তির তথ্য চাপা পড়ে থাকলেও করোনার কারণে সেসব তথ্য এখন সবার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। বিভাগীয় শহরেও পর্যাপ্ত নেই আইসিইউ। ন্যাজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের বরাদ্দও ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে বিভাগীয় শহরে রোগীর এসব চাহিদা থাকলেও ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকার বাইরে বেশি রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গতকাল রোববার সারা দেশে ২৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ৪ ভাগের ৩ ভাগ ঢাকার বাইরের। শতাংশের হিসাবে ৭৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ, বাকিরা ঢাকার। রাজধানীসহ সারা দেশে ১২৯টি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা চলছে। এসব হাসপাতালে ১৫ হাজার ৪৩টি সাধারণ ও এক হাজার ২৬৩টি আইসিইউ বেড রয়েছে। এসব হাসপাতালে সাধারণ বেড ফাঁকা আছে পাঁচ হাজার ১৪টি। আইসিইউ ফাঁকা আছে ৩০১টি। ঢাকায় মোট সাধারণ বেড রয়েছে ৪৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। বাকি সাত বিভাগে আছে মাত্র ৫২ দশমিক ৭০ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে সাত হাজার ১১৬টি সাধারণ বেড রয়েছে ঢাকায়। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরে সাত হাজার ৯২৭টি। এদিকে ঢাকার বাইরে আইসিইউ আছে মাত্র ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ঢাকায় আছে ৭৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে ৯২৪টি আইসিইউ আছে ঢাকা বিভাগে। অন্যদিকে বাকি সাত বিভাগে আছে মাত্র ৩৩৯টি আইসিইউ বেড। এদিকে ১২৯ হাসপাতালের মধ্যে ১৮টি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার বেশি কোভিড রোগী ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ছাড়া বাকি ১৭টি অন্যান্য বিভাগের। তার মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম আল মানাহিল নার্চার জেনারেল হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফেনীর সবকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর সদর হাসপাতাল, যশোর ২৫০ বেড জেনারেল হাসপাতাল, যশোর বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, কুষ্টিয়া ২৫০ বেড জেনারেল হাসপাতাল, মাগুরা সদর হাসপাতাল ও বরগুনা জেলা সদর হাসপাতাল।

সারা দেশের ২৮ হাজার ৮১৬টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১১ হাজার ৬৬১টি, ময়মনসিংহে ৯২৩টি, চট্টগ্রামে পাঁচ হাজার ১৫৫টি, রাজশাহী তিন হাজার ৬২০টি, রংপুর এক হাজার ৮৩৫টি, খুলনা তিন হাজার ৪৬২টি, বরিশাল এক হাজার ৪০১টি ও সিলেটে ৭৫৯টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। এদিকে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে এক হাজার ৬৮৮টি। তার মধ্যে  ঢাকায় ৯৭৬টি, ময়মনসিংহে ৩৬টি, চট্টগ্রামে ১৬৫টি, রাজশাহীতে ১৩২টি, রংপুরে ৬১টি, খুলনায় ১৮৫টি, বরিশালে ১১১টি ও সিলেটে ২২টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। এ ছাড়াও এক হাজার ৮২৯টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকায় ৪৭০টি, ময়মনসিংহে ৩৩টি, চট্টগ্রামে ৫৭২টি, রাজশাহীতে ৩৯৪টি, রংপুরে ৮২টি, খুলনায় ১৭৫টি, বরিশালে ৪৬টি ও সিলেটে ৫৭টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর রয়েছে।

দেশের সর্বশেষ অবস্থা : সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি ১৩০টি আরটিপিসিআর, ৪৩৫টি র্যাপিড অ্যান্টিজেন ও ৪৮টি জিন এক্সপার্ট ল্যাবসহ ৬১৩টি ল্যাবে গতকাল আরও ৩৯ হাজার ৮৬০টি নমুনা সংগ্রহ ও ৪০ হাজার ১৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬৯ লাখ ৭১ হাজার ১৬৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তার মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫১ লাখ এক হাজার ৭১২টি আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আরও ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে নতুন করে আরও ১১ হাজার ৮৭৪ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২১ হাজার ১৮৯ জনে। তার মধ্যে গতকাল সুস্থ হওয়া ছয় হাজার ৩৬২ জনসহ এ পর্যন্ত সুস্থ রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৭৪ হাজার ৫০১ জনে। এ ছাড়াও গতকাল ২৩০ জনের মৃত্যুতে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৪১৯ জনে। গতকাল শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। সুস্থতার হার ৮৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ ও মৃত্যুহার ১ দশমিক ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতি ১০ লাখে শনাক্ত হচ্ছে ছয় হাজার ৩৮ দশমিক ৬ জন, তার মধ্যে সুস্থ হয়েছে পাঁচ হাজার ১৭১ দশমিক ২ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৯৭ দশমিক ৯ জন।

গতকাল মৃত্যুবরণকৃত ২৩০ জনের মধ্যে ১৩৩ জন পুুরুষ ও ৯৭ জন নারী। এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ১১ হাজার ৫০৮ জন পুরুষ ও চার হাজার ৯১১ জন নারী। শতাংশের হিসাবে মোট মৃত্যুর ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ ও ২৯ দশমিক ৯১ শতাংশ নারীর মৃত্যু হয়েছে। বয়সের বিবেচনায় ষাটোর্ধ্ব গতকাল আরও ১১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে রয়েছে ৫১ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ৪২ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ১৯ জন এবং ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে সাতজন। এ পর্যন্ত ষাটোর্ধ্ব ৯ হাজার ১১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে মারা গেছে তিন হাজার ৯৭৩ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের এক হাজার ৯২৬ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ৯২২ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের ৩২৯ জন, ১১ থেকে ২০ বছরের ১০৪ জন ও ১০ বছরের নিচে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৫৬ জন, খুলনার ৬৬ জন, চট্টগ্রামের ৩৯ জন, রাজশাহীর ২৬ জন, বরিশালে আটজন, সিলেটে আটজন, রংপুরের ২২ এবং ময়নসিংহের পাঁচজনের। এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ আট হাজার ১১৫ জন। খুলনার এক হাজার ৮৫৪ জন, চট্টগ্রামের তিন হাজার জন, রাজশাহীর এক হাজার ২৪৭ জন, বরিশালে ৪৮৭ জন, সিলেটে ৫৮৪ জন, রংপুরের ৭৫২ এবং ময়নসিংহের ৩৮০ জন। শতকরা হিসাবে ঢাকায় অর্ধেকের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মোট মৃত্যুর  ৪৯ দশমিক ৪২ ঢাকা বিভাগের। এরপরে চট্টগ্রামে ১৮ দশমিক ২৭ শতাংশ, খুলনায় ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, রাজশাহী ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ, রংপুর ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ, সিলেট ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ, বরিশাল ২ দশমিক ৯৭ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ২ দশমিক ৩১ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১৬৯ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ৪২ জন এবং বাসায় আরও ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

আমারসংবাদ/জেআই