Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

যাদের হারালো আইনাঙ্গন

জুলাই ১১, ২০২১, ০৭:৩০ পিএম


যাদের হারালো আইনাঙ্গন
  • আইনজীবী, বিচারক ও বিচার-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ আক্রান্ত শতাধিক
  • চার বরেণ্য আইনজীবীসহ এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৯ জন
  • অদৃশ্য ভাইরাস বিচারাঙ্গনকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে
  • আক্রান্ত কেউ বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন, অনেকে উপসর্গ নিয়ে আইসোলেশনে

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। অক্সিজেন, করোনার সুরক্ষাসামগ্রীসহ নানা সংকটে বিপর্যস্ত দেশ। প্রতিনিয়তই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল। কড়াকড়ি আরোপ করেও সংক্রমণের হার কমানো যাচ্ছে না। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি করোনার প্রভাব পড়ছে আইনাঙ্গনেও। নিয়মিত আক্রান্ত হচ্ছেন আইনজীবী, বিচারক ও বিচার-সংশ্লিষ্টরা। অদৃশ্য ভাইরাসে বিচারাঙ্গনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মারাও গেছেন। অনেকে আক্রন্ত হয়ে ভর্তি আছেন হাসপাতালে। কেউ কেউ বাসায় থেকেও চিকিৎসা নিচ্ছেন। কেউবা উপসর্গ নিয়ে আছেন আইসোলেশনে। এতে বিচারাঙ্গনের সবাইকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। সংক্রমণের বিস্তার রোধে সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের অধঃস্তন আদালতগুলোর নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবুও আইনজীবী, বিচারক ও বিচার-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাসহ অন্তত পঞ্চাশের অধিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলও। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী। করোনা কেড়ে নিয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি আব্দুল মতিন খসরুকে। করোনাকালেই আইনাঙ্গন হারিয়েছে প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে। মারা গেছেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার আব্দুল মান্নান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মমতাজ আলী ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার তানভীর পারভেজ ও অ্যাডভোকেট রশিদ আহমেদ।

আব্দুল মতিন খসরু: সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু সভাপতির চেয়ার বসার আগেই গত ১৪ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। আইনজীবীদের ভোটে জিতলেও করোনার কাছে হেরে যান তিনি। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম ও কুমিল্লা-৫ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মতিন খসরু গত ১৫ মার্চ সংসদ সচিবালয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। ১৬ মার্চ সকালে তার রিপোর্টে করোনা পজেটিভ আসে। ওইদিনই তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। গত ২৮ মার্চ রাত ১২টার দিকে আব্দুল মতিন খসরুকে আইসিইউতে নেয়া হয়। পরে ১ এপ্রিল করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ আসে। গত ৩ এপ্রিল অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুকে সিএমএইচের আইসিইউ থেকে সাধারণ কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। ৬ এপ্রিল সকালে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে পুনরায় তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে সুপ্রিম কোর্টে শোকের ছায়া নেমে আসে।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক: করোনাকালেই গত বছরের ২৪ অক্টোবর দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মারা যান। রাজধানীর আদ-দ্বীন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। রক্তশূন্যতা, ইউরিন সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জামানায় দুই নেত্রী যখন কারাগারে তখন তাদের জন্য অকুতোভয়ে আইনি লড়াই করেন তিনি। একই সঙ্গে দুই নেত্রীর সমালোচনা করতেও পিছপা হননি তিনি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় বরাবরই সোচ্চার ছিলেন রফিক-উল হক। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন বর্ষীয়ান এই আইনজীবী। ১৯৯০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রফিক-উল হক। কিন্তু কোনো সম্মানী নেননি। পেশাগত জীবনে তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দল করেননি। তবে, নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা সবসময় তাকে পাশে পেয়েছেন। রাজনীতিবিদদের সম্মান সবসময়ই অর্জন করেছেন তিনি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তার জীবনের উপার্জিত অর্থের প্রায় সবই ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণ ও সমাজসেবায়। তার মৃত্যু শুধু আইনাঙ্গন নয়, দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে মনে করে সচেতন মানুষ।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম: রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর করোনা আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মারা যান। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম,  ১৩তম, ১৬তম সংশোধনী মামলা; মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কাদের মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মো. কামরুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে আপিলেট ডিভিশনে মামলা পরিচালনা করেছেন। হাইকোর্ট ডিভিশনে বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি রাষ্ট্রের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনা করেছেন। তার মৃত্যু এখনো ভুলতে পারে না আইনাঙ্গনের মানুষ।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ: প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ গত ১৬ মার্চ মারা যান। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে  তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। গত ১ ফেব্রুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য মওদুদ আহমদ সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তার চিকিৎসা চলছিল। ফুসফুসে পানি জমার কারণে অবস্থার অবনতি হলে গত ৯ মার্চ তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। মওদুদ আহমদ দেশের এক বর্ণাঢ্য রাজনীতিক। তিনি আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন। এরশাদ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

বিশিষ্ট আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমান: করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইদ্রিসুর রহমান মারা যান। রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। আজগর আলী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে তার জানাজা নামাজ শেষে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় দাফন করা হয়।

প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম: করোনাকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী  অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম গত ২৭ জুন রাজধানীর সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২০১০ সাল থেকে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুম একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

ব্যারিস্টার তানভীর পারভেজ: জনপ্রিয় আইনের শিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভীর পারভেজ গত ৩ এপ্রিল করোনায় মারা গেছেন। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে রাজধানীর বাড্ডার এম জেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সিলেটের সন্তান ব্যারিস্টার তানভীর পারভেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। তানভীর পারভেজ সুপ্রিম কোর্টে আইনপেশার পাশাপাশি ভূঁইয়া একাডেমিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইন বিষয়ে শিক্ষকতা করতেন।  তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

এ ছাড়া গত ৫ এপ্রিল আইনজীবী রশিদ আহমেদ (৫১) করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন আইনজীবী মমতাজ আলী ভূঁইয়া (৭০)। ১০ এপ্রিল আইনজীবী মো. ওবায়দুল্লাহ (জাকির) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১৩ এপ্রিল মারা যান আইনজীবী সৈয়দ মোকাদ্দাস আলী। ১৫ এপ্রিল মৃত্যু হয় আইনজীবী মনজুর কাদেরের। ১৬ এপ্রিল মারা যান রেজিনা চৌধুরী জেনি (৫৭)। ২৩ এপ্রিল সকালে মারা যান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী লিও সাহা কেনেডি। তিনি করোনা পজেটিভ হওয়ার পর বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। পরে করোনা নেগেটিভও হয়েছিলেন। কিন্তু শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়ায় স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। গত ২৪ এপ্রিল রাতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা জিয়াউর রহমান খান মারা যান। তার বাবা ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। ২৫ এপ্রিল সকালে শেখ ইউনুস আলী করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। একই দিন বিকেলে আইনজীবী নাজমুল হাসান (৭৮) মৃত্যুবরণ করেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আলী হায়দার কিরণ মারা যান। এর আগে ১৩ জানুয়ারি ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার আব্দুল মান্নান (৭০) মারা যান।

আমারসংবাদ/জেআই