Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

করোনাকালে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম

ফারিহা হোসেন

জুলাই ১১, ২০২১, ০৭:৩০ পিএম


করোনাকালে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম
  • বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এখনো করোনা মহামারি প্রতিরোধের যুদ্ধে লিপ্ত। কিছু কিছু দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে বা দিলেও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে পরক্ষণেই আবার বন্ধ করছে। সংকটের কথা চিন্তা করে অধিকাংশ দেশ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে। কেউ কেউ আবার সব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে খুলতে চাইলেও পরিস্থিতি পাল্টে যাওযায় খুলতে পারছে না। করোনার প্রাদুর্ভাবের মাত্রার তথ্য পর্যালোচনা করে বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যতটা সহজ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ বা খোলা রাখার ব্যাপারে, ঠিক ততটাই কঠিন হচ্ছে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের সময়েও লকডাউন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত দেশগুলোতে এটি এখন একটি সাধারণ চর্চার বিষয়ে পরিণত হয়েছে

করোনা মহামারির কারণে সরকার ২০১৯-এর মার্চ মাসে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর একই বছরের মে মাস থেকেই অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর কাজ শুরু করে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি হিসেবে দেশে প্রাথমিক স্কুল আছে ৬৪ হাজার। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিক স্কুল আছে আরও ১৭ হাজারের মতো। আর কলেজ আছে প্রায় আড়াই হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি। যদিও এর মধ্যে অল্প একটি অংশই করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে আর টিভি দেখার সুযোগ আছে সব মিলিয়ে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীর। অর্থাৎ এখনও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রমের আওতার বাইরে রয়েছে। এটি ঠিক যে, অনেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। এখানে সামর্থ্য ও সুযোগের বিষয়টিও জড়িত।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এখনো করোনা মহামারি প্রতিরোধের যুদ্ধে লিপ্ত। কিছু কিছু দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে বা দিলেও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে পরক্ষণেই আবার বন্ধ করছে। সংকটের কথা চিন্তা করে অধিকাংশ দেশ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে। কেউ কেউ আবার সব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে খুলতে চাইলেও পরিস্থিতি পাল্টে যাওযায় খুলতে পারছে না। করোনার প্রাদুর্ভাবের মাত্রার তথ্য পর্যালোচনা করে বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যতটা সহজ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ বা খোলা রাখার ব্যাপারে, ঠিক ততটাই কঠিন হচ্ছে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের সময়েও লকডাউন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত দেশগুলোতে এটি এখন একটি সাধারণ চর্চার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ইউনিসেফের মতে, বিশ্বের প্রায় ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনার কারণে ক্ষতির শিকার। করোনার প্রাদুর্ভাব ও লকডাউনের কারণে  বিশ্বের  প্রায় ১৬০ কোটি শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না। ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, অপুষ্টি, পরিবারের আয় কমে যাওয়া, স্থূলতা, শৃঙ্খলা বোধ ও খেলাধুলার অভাব, শিক্ষা হতে ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ, সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়াসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। এতদসত্ত্বেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঢালাওভাবে খুলে দেওয়া না হলেও পাইলট প্রজেক্টের আওতায় খুলে দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায় কি না- এটাও ভাবা যেতে পারে। কারণ, করোনা প্রলম্বিত হলে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এভাবে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখলে একটি প্রজন্ম শিক্ষাবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যা কোনো দেশ বা জাতির জন্য কখনও মঙ্গলজনক হতে পারে না। আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার, দেশে অনলাইন ক্লাস করার জন্য স্মার্টফোন, কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপ দরকার; কিন্তু তা দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর নেই। আবার গ্রাম, চর, হাওর অথবা দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের ভার্চুয়াল শিক্ষা সম্পর্কে কোনো ধারণা বা প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। রাজধানী ছাড়া দেশের অন্যান্য জেলায়  থ্রিজি/ফোরজি নেটওয়ার্ক বা ব্রডব্যান্ড সুবিধার সহজে দেখা মেলে না। আবার অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক বলছেন, বর্তমান মহামারি পরিস্থিতিতে যেখানে সংসার চালানোই মুশকিল, সেখানে ইন্টারনেটের খরচ বহন করা তাদের জন্য বিলাসিতাই বটে! অন্যদিকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে অনলাইনে ক্লাস করার সময় ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকের লেকচার ঠিকমতো দেখতে ও শুনতে পায় না; ফলে তারা অনলাইনে ক্লাস করতে আগ্রহ হারাচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে অনলাইন ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে বোঝায় পরিণত হয়েছে। করোনার সময়ে সবারই অস্থিরতা, হতাশাসহ নানাবিধ মানসিক সমস্যা অনুভূত হচ্ছে; তারই মাঝে অনলাইন ক্লাস বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অনলাইন ক্লাসের কারণে আজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সবার হাতেই রয়েছে এনড্রয়েড মোবাইল ফোন, বাসায় রয়েছে ল্যাপটপ, ডেস্কটপ এবং পর্যাপ্ত নেট সুবিধা। অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থী কৌতূহলবশত বিভিন্ন সাইটে ঢুকতে পারছে সহজেই। উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের যেসব শিক্ষার্থী পূর্ব থেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে আসছে, তারা সব সময় পরিবারের বিশেষ নজরদারিতে থাকত বা দিনের বিশেষ একটি সময় তা ব্যবহারের অনুমতি পেত; কিন্তু বর্তমান সময়ে অনলাইনে ক্লাসের নাম করে শিক্ষার্থীরা বেশি সময় নেটে অবস্থান করলেও অভিভাবকরা কোনো আপত্তি করতে পারছেন না সন্তানের শিক্ষাজীবনের কথা চিন্তা করে। অন্যদিকে, অনলাইন ক্লাসের অজুহাতে ছোট শিশুরা সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হচ্ছে, যা তাদের বয়সের সঙ্গে খাপ খায় না। সময়ের আগে কোনো কিছুই ভালো না জেনেও আমরাই আজ তাদের ফেসবুক, ইউটিউব চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছি- যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হচ্ছে। আবার  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টানা প্রায় দেড় বছর বন্ধের কারণে তারা এই দীর্ঘ সময় ঘরে বন্দি থাকায় মানসিক ও শারীরিকভাবে বহুবিদ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জীবনবাদী ও প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ গীতিকবি মিজান মালিকের সাম্প্রতিক ‘স্বপ্ন সাজাও’ শীর্ষক কবিতায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিক্ষার্থীদের দুঃসহ এমন সময় সম্পর্কে। তিনি লিখেছেন, ‘থমকে আছে সময় তোমার, থেমে গেছে কোলাহল। তাই ভেবো না জীবন তোমার, হয়ে গেছে খুব অচল। আস্থা রাখো নিজের প্রতি, পাবেই তার ভালো ফল। এই কোভিডের আগে তোমার, স্বপ্ন ছিলো অগণন, মন্দ সময় করছে জানি, বিপন্ন তোমার অবুঝ মন। যতই আসুক বোবা সময়, রাখো ধরে মনোবল। নিজের জগত রাখো ধরে, সময় থেমে থাকে না। নতুন করে সাজাও স্বপ্ন, জীবন হবে আলো ঝলমল’।

অনলাইনে ক্লাস করার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ডিভাইসের স্ক্রিনের সামনে দীর্ঘ সময় বসে থাকায় ছাত্রছাত্রীদের চোখে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আবার কারও কারও মাথাব্যথা অনুভূত হচ্ছে। দীর্ঘ সময় চেয়ারে বসে ক্লাস করায় অনেক শিক্ষার্থীর ঘাড় ও মেরুদণ্ডে ব্যথা হচ্ছে- যা দীর্ঘ সময় ধরে চলছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও শিক্ষার্থীরা টেকনোলজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষাটি সম্পূর্ণভাবে পায়নি। সেশনজটের যাঁতাকল থেকে মুক্তির নিমিত্তে পড়াশোনা পুষিয়ে নিতে নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে অনলাইন ক্লাসের প্রধান অন্তরায় ইন্টারনেটের মন্থর গতি। অনলাইন ক্লাস কারও জন্য আশীর্বাদ, আবার কারও জন্য অভিশাপ। অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন সমস্যার কারণে ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছে না। ফলে তাদের বড় একটি অংশ ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে ক্লাসের যথেষ্ট চাহিদা অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। অনলাইন ক্লাসে তাত্ত্বিক জ্ঞান মিললেও ব্যবহারিক জ্ঞান থেকে সবাই বঞ্চিত হচ্ছে। অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া বেশ কঠিন। মূল সমস্যা হলো অসদুপায় বা নকল বন্ধ করা। যেহেতু শিক্ষক ছাত্রকে দেখতে পাচ্ছেন না, তাই সহজেই গুগল সার্চ, বই দেখে লেখা, অথবা বন্ধু-বান্ধব একসঙ্গে মিলে নকল করা সম্ভব।

এ সময়ে শিক্ষার্থীদের মনে সাহস জোগানো দরকার। বলতে হবে, তারা  বন্দি নয়। জীবনকে নতুন করে গড়ার এটাই সুযোগ। মানবিক, নৈতিক মনোবল চাঙ্গা করে সময়টাকে কাজে লাগাতে পারলেই তোমরা নতুন করে গড়ে নিতে পারবে পাল্টে যাওয়া পৃথিবীকে। বরং পিতা-মাতা বা স্বজনদের সময় দেওয়া, সামাজিক ও মানবিক গুণ অর্জন করার এটাই মোক্ষম সময়। আর যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে কীভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়, তার অনুশীলন করা। যে কোনো জরুরি সময়ে যে কোনো সমস্যা সবার সহযোগিতা নিয়ে কীভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব এবং মানসিক শক্তি আরও সুদৃঢ় করার উপায়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও মানসিকভাবে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষমতা রাখতে হবে। তবেই সম্ভব এই অন্ধকার সময়কে জয় করা।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং নারী-শিশু ও পরিবেশ বিষয়ে অধ্যয়নরত

আমারসংবাদ/জেআই