Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

জীবন যাচ্ছে তবুও কেন মানছি না!

প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী

জুলাই ১২, ২০২১, ০৭:৪০ পিএম


জীবন যাচ্ছে তবুও কেন মানছি না!
  • করোনার প্রভাবে পার্শ্ববর্তী ভারতের আর্থিক কাঠামো অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। সে তুলনায় আমরা অনেকটাই ভালো অবস্থানে আছি। তবে অর্থনীতির এই গতিকে ধরে রাখতে হবে। দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়ে টিকা প্রদান করা জরুরি। কারণ, তারা টিকার অভাবে সময়মতো কর্মস্থলে যেতে না পারলে তা রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া বিদেশি মিশনগুলোকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে। কে বৈধ কে অবৈধ- এটি বিবেচনা না করে তাদের সব বিপদ-আপদে পাশে থাকাটাই জরুরি

দেশে মহামারি করোনা ভাইরাস ভারতীয় বা ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ চলছে। এই ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ইতোমধ্যে সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী ১৭ জেলা ছাপিয়ে ভাইরাসটি সারা দেশে চোখ রাঙাচ্ছে। জেলা হাসপাতালে অপ্রতুল অক্সিজেন সরবরাহ ও হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার অভাবে চিকিৎসাসেবা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অক্সিজেনের অভাবে বগুড়ায় করোনায় আক্রান্ত বেশ কজন রোগীর করুণ মৃত্যু হয়েছে, যা গণমাধ্যমের বদৌলতে মানুষের মনে ব্যাপক দাগ কেটেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বগুড়ায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান করেছেন।

আমরা যদি করোনামুক্ত একটি দেশ দেখতে চাই, তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মানা অতি জরুরি। আসুন, সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি এবং করোনামুক্ত দেশ গড়ি।

দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পগ্রুপ (এস আলম) করোনা চিকিৎসায় বগুড়ার দুটি সরকারি হাসপাতালে ১০টি করে মোট ২০ সেট হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা উপহার দিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বগুড়া সদরের সাংসদও তাঁর ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে দুটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা উপহার দিয়েছেন। দেশের অন্যান্য শিল্পগ্রুপও এ ধরনের মানবিক কাজে এগিয়ে আসবে বলে দেশবাসী আশা করে। করোনা ধনী-গরিব সবাইকেই একাকার করে দিয়েছে। প্রতিটি জেলায় বড়-ছোট অনেক ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা কোটিপতি রয়েছেন। তারা যদি নিজ নিজ জেলা সদর হাসপাতালে তাদের সিএসআর ফান্ড থেকে এস আলম গ্রুপের মতো ২০টি করে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা বা এমপি জিএম সিরাজের মতো হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সাহায্য দিয়ে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন, তাহলে তা করোনা চিকিৎসায় প্রান্তিক জনপদে স্বস্তির আবহ তৈরি করবে এবং অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এতে জনমনেও স্বস্তি ফিরে আসবে।

এদিকে কঠোর লকডাউন সত্ত্বেও মানুষের অসচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা করোনা পরিস্থিতিকে ক্রমেই জটিল করে তুলছে। হাসপাতালে বেড নেই, পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই, প্রয়োজনীয়সংখ্যক আইসিইউ বেড নেই। বেডসংখ্যার অতিরিক্ত রোগীর চাপে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। গত বছরের ৭ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী চিহ্নিত হওয়ার পর আমরা প্রায় ১৭ মাস সময় পেয়েছি। করোনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ আসবে জানা সত্ত্বেও আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে পারিনি। অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করা যায়নি; হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সেবাও নিশ্চিত করতে পারিনি।

সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসার জন্য আইসিইউর সংখ্যা বাড়ানো যায়নি। শুধু একটি উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ করতে গিয়েও হোঁচট খেয়েছি। যদিও পরবর্তীকালে বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহে তৎপর হয়েছে মন্ত্রণালয়। এ পর্যন্ত যা টিকা সংগ্রহ হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে মর্মে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। তবে সংকট এখনও কাটেনি। বরং বেড়েছে।

এক সময় বলা হতো, করোনায় গ্রামের প্রান্তিক মানুষ ও কম বয়স্করা আক্রান্ত হন না। ভারতের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এ দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। মানছি, লকডাউনে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। বহু মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার। শহর ছেড়ে বিকল্প কর্মের সন্ধানে গ্রামে ছুটতে থাকা মানুষের মিছিল দিনকে দিন লম্বা হচ্ছে। এছাড়া তাদের আর কিই-বা করার আছে। এক্ষেত্রে কৃষিই হতে পারে বিকল্প কর্মের উপায়। সুতরাং, কৃষিতে সরকারের আর্থিক প্রণোদনার পরিমাণ বৃদ্ধি করা দরকার। এছাড়া কর্ম হারানো মানুষগুলোকে এসএমই লোন প্রদানের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া গেলে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল হবে। শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশের কৃষি জিডিপিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে অবদান রাখলেও এ খাতের শ্রমিক এবং কৃষক আজও বঞ্চিত। বন্যা, খরা ও নদীভাঙনে বিপর্যস্ত কৃষক সরকারি অপ্রতুল পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যেও কৃষিতে বাম্পার ফলন ফলিয়েছে। কিন্তু লকডাউনের কারণে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাদের উৎপাদিত পণ্য পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এক্ষেত্রে কৃষি বিভাগের সঠিক নজরদারি না থাকায় চরম ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের কৃষক সমাজ। কৃষি বীমার দাবি দেশে জোরালো হলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।

করোনায় প্রান্তিক জনপদের মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। দিন আনা-দিন খাওয়া মানুষগুলো কঠোর লকডাউনের কারণে চরম অর্থ সংকটে পড়েছে। সরকার ইতোমধ্যে প্রান্তিক জনপদের খেটে খাওয়া কর্মহীন মানুষ ও পরিবহন শ্রমিকদের জন্য ২৩ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ; তবে তা একেবারেই অপ্রতুল। এর মধ্যেও অর্থ বিতরণে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি রোধ করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

বিভিন্ন গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেশে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এতসংখ্যক দরিদ্র মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা জরুরি হলেও কাজটি বেশ কঠিন। লকডাউন, কঠোর লকডাউন- যেটাই বলি না কেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে বা সচেতন না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এক্ষেত্রে শুধু দোষারোপের রাজনীতি পরিহার করে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। শুধু আমলানির্ভরতা দিয়ে তা করা যাবে না। বরং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও আমলা সমন্বয়ে তা সহজেই করা সম্ভব হবে। করোনা কোনো দেশের বা কোনো দলের একক সমস্যা নয়। এটি বৈশ্বিক সমস্যা। করোনা দেশে দেশে জাতীয় দুর্যোগ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে বিশ্বকে দীর্ঘমেয়াদে শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা-অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। যার প্রভাব এখনই পড়তে শুরু করেছে। জীবন ও জীবিকার দাগিদে আমরা শিল্প ও বাণিজ্য সচল রাখতে পারলেও শিক্ষা পুরোপরি স্থবির। কবে কখন কীভাবে দেশের বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু করা যাবে, তা এখনও অনিশ্চিত। তবে বলা হচ্ছে, সব শিক্ষার্থীকে টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে- যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

করোনার প্রভাবে পার্শ্ববর্তী ভারতের আর্থিক কাঠামো অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। সে তুলনায় আমরা অনেকটাই ভালো অবস্থানে আছি। তবে অর্থনীতির এই গতিকে ধরে রাখতে হবে।

দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়ে টিকা প্রদান করা জরুরি। কারণ, তারা টিকার অভাবে সময়মতো কর্মস্থলে যেতে না পারলে তা রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া বিদেশি মিশনগুলোকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে। কে বৈধ কে অবৈধ- এটি বিবেচনা না করে তাদের সব বিপদ-আপদে পাশে থাকাটাই জরুরি। তারা যখন বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি করছে বা মহামারি করোনাকালে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে, সেই মুদ্রার কোনটি বৈধ প্রবাসীর আর কোনটি অবৈধ প্রবাসীর- তা কিন্তু মুদ্রার গায়ে লেখা থাকে না। আগামী ২১ জুলাই ঈদুল আজহা, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। এতদিনের লকডাউন সত্ত্বেও করোনা পরিস্থিতির উন্নতির কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাই ঈদ বলি আর উৎসব বলি- স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করাটাই হলো এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জে আমাদের জিততেই হবে।

কোরবানিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরের মতো এবারও দেশের খামারিরা প্রস্তুত। তাদের খামারে লাখ লাখ দেশি গরু-ছাগল বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে। অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করা গেলে সংক্রমণ রোধ করা কিছুটা সহজ হতো। সরকার বা সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। অন্যথায় গ্রামের হাটবাজারে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় করা কঠিন হয়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে দেশের অবনতিশীল করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

এদিকে দেশীয় খামারিদের কথা চিন্তা করে ভারত সীমান্তকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যাতে করে ভারত থেকে কোনো পশু দেশে প্রবেশ করতে না পারে। ভারত থেকে চোরাই পথে দেশে গরু প্রবেশ করলে একদিকে যেমন করোনার ভয়াবহতা বেড়ে যেতে পারে, অন্যদিকে দেশের গ্রামীণ প্রান্তিক খামারিরা লোকসানের সম্মুখীন হবেন। আমরা যদি করোনামুক্ত একটি দেশ দেখতে চাই, তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মান্য করা জরুরি। আসুন, সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি এবং করোনামুক্ত দেশ গড়ি।

লেখক : আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আমারসংবাদ/জেআই