Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

দেশের মূলধনও আক্রান্ত!

জুলাই ১৪, ২০২১, ০৭:১০ পিএম


দেশের মূলধনও আক্রান্ত!
  • ভবিষ্যৎ প্রতিবন্ধী জাতির শঙ্কা
  • ফুরিয়েছে সংসার প্রদীপের তেল
  • বিধ্বস্ত স্বাস্থ্য খাতের পরিস্থিতি
  • প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী অনিশ্চিত জীবনে
  • ঋণে জর্জরিত সবাই, কর্ম হারিয়েছে ২৬ লাখ মানুষ আরও ৯ লাখ শঙ্কায়
  • ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর ২  শতাংশকে টিকা দিতে পেরেছে আইসিইউর জন্য হাহাকার

আক্রান্ত! দেশের তিন মূলধনে— শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য খাতে। দীর্ঘ সময় বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভবিষ্যৎ প্রতিবন্ধী জাতির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ঘরে ঘরে গেমসের নেশায় আসক্ত সন্তানরা, দুশ্চিন্তায় অভিভাবকরা। আত্মহত্যার মতো অঘটনও ঘটছে। পাড়া-মহল্লায় তৈরি হয়েছে কিশোর গ্যাং। বই থেকে দূরে সরে গেছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার আলো থেকে হারিয়ে গেছে বিশাল অংশ। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কিভাবে এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ছাত্রজীবনের ইতি ঘটবে, কিভাবে তারা দেশের ভূমিকা পালন করবে তা এখনো অজানা। এদিকে অর্থের সংকট ঘরে ঘরে। ফুরিয়েছে সংসার প্রদীপের তেল। মধ্যবিত্তদের বেশির ভাগ তিনবেলা খেতে পাচ্ছে না; ঋণে জর্জরিত হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে কর্মসংস্থান হারিয়েছে ২৬ লাখের বেশি মানুষ। আরও ৯ লাখ কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে। পুঁজি ভেঙে জীবন চলছে অনেকের। বদলে গেছে স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা। এছাড়া দেশের আরেকটি বড় মূলধন স্বাস্থ্য খাত প্রায় তছনছ। হাসপাতালে সিট নেই। অক্সিজেনের জন্য হাহাকার, স্বাস্থ্য খাতের অনিয়মে ভর্তি গণমাধ্যমের পাতা। একটি দেশে ভর করায় টিকা ব্যবস্থায়ও আঘাত। এ পর্যন্ত দেশে ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর ২ শতাংশ মানুষ টিকা দিতে পেরেছে। স্বাস্থ্য নিয়ে আগামীতে আরও ভয়াল পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভবিষ্যৎ প্রতিবন্ধী জাতির শঙ্কা : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আলো বন্ধ! গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ  স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন প্রায় তছনছ। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ভুলে গেছে। বড় ঘাটতি ও বোঝায় ওপরের ক্লাসে উঠেছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। স্নাতক-স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরা অনিশ্চিত জীবনে। ঘরে ঘরে গেমসের নেশায় আসক্ত সন্তানরা, দুশ্চিন্তায় অভিভাবক। আত্মহত্যার মতো অঘটনও ঘটছে। পাড়া-মহল্লায় তৈরি হয়েছে কিশোর গ্যাং। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ ৩১ শতাংশ। ৫ শতাংশের নিচে না এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার পরামর্শ কোভিড-সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির। এদিকে বর্তমানে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এখনো আসেনি কোনো রোডম্যাপ, অনলাইনে ক্লাস হলেও পিছিয়ে গ্রামের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিশোরীদের অনেকে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে কর্মজীবনে প্রবেশে পিছিয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, ‘পরীক্ষা ছাড়া বা সামান্য কিছু পড়িয়ে ওপরের শ্রেণিতে ওঠালে দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ক্ষেত্রে হয়তো এক বছরের জায়গায় ৯ মাসে শিক্ষাবর্ষ শেষ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ক্ষতি অনেক বড় হয়ে গেছে। আর  কতটুকু হলো, তা পর্যালোচনা করতে হবে। চিন্তা করতে হবে। সমাধানে আসতে হবে।’

কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক) আমার সংবাদকে বলেন, ‘কিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায় তা অনেক বেশি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার জন্য এখনই পরিকল্পনা নেয়া দরকার। সেই পরিকল্পিত সমন্বয়ের আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দু’-একদিন হলেও ক্যাম্পাস খোলা রাখা যেতে পারে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক বেশি প্রভাব পড়ছে।  তারা বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাই এখনই শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করতে জাতীয় ঐক্যমত গড়ে তোলা প্রয়োজন। একটি কার্যত মতামতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের আঘাত এসেছে। সারাক্ষণ বাসায় থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক অবসাদ দেখা দিয়েছে। আমাদের এখানে মূল্যায়ন হয় শ্রেণিকক্ষে, বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় এবং জাতীয় কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু করোনার কারণে সব থমকে গেছে। এখন শিক্ষার্থীদের ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। কারণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অনলাইন বা টেলিভিশনে প্রচারিত শিক্ষার কোনো মাধ্যমেই যুক্ত হতে পারেনি।’

ফুরিয়েছে সংসার প্রদীপের তেল : এদিকে ঘরে ঘরে সংসার প্রদীপের তেল ফুরিয়ে গেছে। কৃষক, শ্রমিক, উদ্যোক্তা দেশের মোট কর্মক্ষম মানুষের ৭৬ শতাংশ। বাকি মাত্র ১৪ শতাংশ কাজ করে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। করোনাকালে সবাই দুঃসময়ে রয়েছে। বেশির ভাগ তিনবেলা খেতে পাচ্ছে না; ঋণে জর্জরিত হয়ে গেছে। প্যাডেল ঘোরানো রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, সবজি বিক্রেতা, বাস-টেম্পোর ড্রাইভার-কন্ডাক্টর; কাঠের আসবাব বানানো, তালা সারানো, দা-বঁটি শান দেয়ার কারিগর, মুচি, রাজমিস্ত্রি, পানির কল সারানোর মানুষ, রঙমিস্ত্রি, ইজিবাইকের তরুণ চালকদের চলছে মানবেতর জীবনযাপন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৯ লাখ কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে। এছাড়া সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, লকডাউনে মানুষ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮০ শতাংশ লোক ব্যবসার পুঁজি ভেঙে খাওয়া শুরু করেছে। ৬০ শতাংশ লোক সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে। ৮৬ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর দুঃসময় চলছে। কর্মসংস্থান হারিয়েছে ২৬ লাখের বেশি মানুষ। দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। দরিদ্র হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। এছাড়া করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ তথ্য জানান।

ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যারা রয়েছেন তাদের ৮০ শতাংশ লোক পুঁজি ভেঙে খাওয়া শুরু করেছেন। এভাবে আর কিছু সময় চলতে থাকলে সবারই পুঁজি শেষ হয়ে যাবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘বৈশ্বিক মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশেও বড় প্রভাব পড়েছে। কমে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ, একের পর এক বাতিল হচ্ছে পোশাক খাতের ক্রয়াদেশ, বন্ধ রয়েছে দেশের অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিনিয়তই লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।’

বিধ্বস্ত স্বাস্থ্য খাতের পরিস্থিতি : লণ্ডভণ্ড দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা। এ পর্যন্ত দেশে ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর ২ শতাংশ মানুষ টিকা দিতে পেরেছে। এর মধ্যেই অক্সিজেন সংকট, স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম। গ্রাম-গঞ্জে বাড়ছে রোগী, আইসিইউর জন্য হাহাকার। টেস্ট ভোগান্তি অব্যাহত, বাড়ছে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু। হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলারও ঘাটতি। জেলা-উপজেলা হাসপাতালে আরটিপিসিআর স্বল্পতা।

ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড অন্যতম চার হাসপাতালেই কোনো আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ফাঁকা নেই। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বেড খালি নেই। আসন মিলছে না ভিআইপি লোকদেরও। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশের করোনা পরিস্থিতি বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যু বাড়ছে। ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলার বাতাস অ্যাম্বুলেন্সের করুণ কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেক জেলায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করা হয়নি।

এক বছরেরও বেশি সময় পেলেও দেশে বাড়েনি আইসিইউ সক্ষমতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা কার্যকর করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী গত বছরের জুনে একনেকের বৈঠকে সারা দেশে সব জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাই-ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী আইসিইউ চালানোর জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে ৪০০ জুনিয়র কনসালট্যান্ট নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও অর্ধেক জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করা হয়নি, অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি এবং ৪০০ জুনিয়র কনসালট্যান্ট এখনো নিয়োগ দেয়া হয়নি।

সামপ্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন বলেন,  ‘সব জেলাতেই কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে এবং সংক্রমণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। আমরা যেভাবে সংক্রমিত হচ্ছি, হাসপাতালে রোগীর চাপ এভাবে যদি বাড়তেই থাকে তাহলে আগামীতে হাসপাতালের শয্যা আর খালি থাকবে না। আইসিইউ বেড খালি থাকবে না।

আমারসংবাদ/জেআই