Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

উকিলের ভুলে মামলা ঝুলে

জুলাই ১৪, ২০২১, ০৭:১০ পিএম


উকিলের ভুলে মামলা ঝুলে
  • অধিকাংশ বিচারক ও আইনজীবী প্রবেশন আইন সম্পর্কে অবগত নন
  • ইচ্ছা করেই মামলা শেষ করেন না আইনজীবীরা —অভিযোগ বিচারপ্রার্থীদের
  • লঘুদণ্ডের মামলা আপিলে আসায় বিস্মিত হয়েছেন আপিল বিভাগ
  • তদন্ত, চার্জশিট, সাক্ষী হাজিরে দেরিই নিষ্পত্তিতে মূল বাধা —দাবি আইনজীবীদের

১৯৮৬ সালের ১৪ জুলাই। এ দিন সন্ধ্যায় গাজীপুরের জয়দেবপুরের আহমদ আলীর ১০ বছরের নাতির সাথে প্রতিবেশী আব্দুল মতিনের কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ওইদিন গ্রাম্য সালিশে মতিনকে দোষী সাব্যস্ত করে জরিমানা করা হয়। সালিশে হেরে মতিন প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দেয়। পরের দিন সকাল ৬টায় মতিনের ভাই নুর মোহাম্মদ আহমদ আলীর ছেলে আব্দুল জব্বারকে আক্রমণ করে ও একটি ফালার চ্যাপ্টা অংশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে এবং শরীরের একাধিক স্থানে জখম করে। এ সময় তার বাম হাতের কব্জিও ভেঙে দেয়। এর জেরে জয়দেবপুরে মামলা করা হয়। বিচারিক আদালতে আট বছর বিচার শেষে ১৯৯৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বিচারক নুর মোহাম্মদকে দণ্ডবিধির ৩২৫ ধারার অপরাধের জন্য এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য দুই হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। অন্যান্য আসামিদের দণ্ডবিধির ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য যথাক্রমে দুই হাজার এবং পাঁচশ টাকা করে জরিমানা করেন। এরপর থেকেই শুরু হয় আইনি লড়াই।

ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন। তবে সেটা ১১ বছর পর ২০০৫ সালের ৭ জুলাই খারিজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আসামিরা হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২ মার্চ আবেদনটি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বিভাগের ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আসামি নুর মোহাম্মদ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেন। ওই আবেদন শুনানি নিয়ে রায় দেন আদালত। ইতোমধ্যে আবেদনকারী নুর মোহাম্মদ ৩১ দিন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। নুর মোহাম্মদের দোষী সাব্যস্তের আদেশ এবং জরিমানা বহাল রেখে তিনি যতদিন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন ততদিনই তার দণ্ড হিসেবে গণ্য হবে উল্লেখ করে নুর মোহাম্মদের আবেদন নিষ্পত্তি করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে সংশোধন করে দেন হাইকোর্ট বিভাগের রায় ও আদেশ। ফলে লঘু দণ্ডের মামলার বিচারও চলতে থাকে ৩০ বছর ধরে। শুধু এই ঘটনাই নয়, দেশে এমন অহরহ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাতাহাতি, তারপর মারামারি, জখম ও আহত। মেডিকেল সনদের জন্য হাসপাতালে ভর্তি। ২৫ ধারায় মেডিকেল সনদ নিয়েই মামলা। আসামিও করা হয় ডজন খানেক লোককে। শুরু হয় আদালতে দোড়ঝাঁপ। দলবেঁধে চলতে থাকে হাজিরা দেয়ার পালা। যে হাজিরার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। ফলে আপসযোগ্য মামলাও চলতে থাকে বছরের পর বছর। এমনকি মাঝেমধ্যে এসব লঘুদণ্ডের মামলা নিষ্পত্তিতেও কেটে যায় যুগের পর যুগ। মামলা শেষ করতে আদালতে হাজিরা দিয়ে ক্লান্ত হন বিচারপ্রার্থীরা। অনেকে হাজিরা খরচ ও মামলার ব্যয় মেটাতে নিঃস্ব হয়ে বিক্রি করেন জমি-জিরাতও। তবুও মামলা শেষ হয় না।

নিষ্পত্তিতে নিযুক্ত আইনজীবীরও নেই তোড়জোড়। মামলা জিইয়ে রেখেই হাজিরা প্রতি মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা, এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। বিচারপ্রার্থীদের অভিযোগ— মামলা ধরে রাখলেই আইনজীবীদের লাভ, তাই ইচ্ছা করেই তারা মামলা শেষ করতে চান না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিম্ন আদালতের অধিকাংশ আইনজীবীই জানে না যে, দেশে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ নামে একটি আইন আছে। এই আইনের মাধ্যমে ছোটখাটো লঘুদণ্ডের মামলাগুলো বিচারিক আদালত থেকেই নিষ্পত্তি করা সম্ভব। আইনজীবীরা এই আইনে জামিন চাইলে বিচারকরা বিবেচনা করতে পারেন। তবে উকিলরা এই আইনের বিষয়ে অবগত নয় বা অবগত থাকলেও তারা এ বিষয়ে উদাসীন। তাই উকিলদের ভুলেই মামলাগুলো হাইকোর্ট পেরিয়ে আপিল বিভাগ পর্যন্ত আসে। এদিকে তদন্ত, চার্জশিট দাখিলে গাফিলতি ও সময়মতো সাক্ষী হাজির না হওয়াই মামলা নিষ্পত্তির মূল বাধা, এমনটিই জানান আইনজীবীরা।

আহমেদ ও মতিনের মামলার রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়ে আদালত লঘুদণ্ডের মামলা আপিলে আসায় বিস্মিত হয়েছেন আপিল বিভাগও। গত ২৮ জানুয়ারি মামলাটি নিষ্পত্তি করে সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, দণ্ডবিধির ৩২৩ এবং ৩২৫ ধারা আপসযোগ্য অপরাধ এবং দুপক্ষ পরস্পর আত্মীয়, কাজেই মামলাটি আপস মীমাংসা করা যুক্তিযুক্ত ছিলো। রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, বিচারিক আদালতের বিচারক ও আপিল আদালতের বিচারক সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন যে, দেশে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ নামে একটি আইন আছে। মামলাটি সেই আইনের ৫ ধারা প্রয়োগযোগ্য। যখন বিচারক ৩২৫ ধারার অপরাধে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করেছে তখন উনার উচিত ছিলো ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ এর ৫ ধারা বিবেচনা করা। সেটা না করায় মামলাটি আপিলে এসেছে। আগের আদালতসমূহের তিনটি রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে, বিচারকরা এই আইনের বিষয়ে আদৌ অবগত নেই। এজন্য এই মামলা দেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত এসেছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, এই মামলায় ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ প্রয়োগ না করা শুধু দুঃখজনকই নয়, সেই সাথে প্রচলিত আইনের পরিপন্থি। এমন অবস্থায় আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলাজট কমাতে হলে আপসযোগ্য ধারার মামলাগুলো বিচারিক আদালতে স্বল্প সময়েই শেষ করা উচিত। লঘুদণ্ডের মামলা ৩৫ বছর ধরে চলতে থাকলে গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারে বাধা সৃষ্টি করবে। বাড়বে মামলাজট, এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আপসযোগ্য ছোটখাটো মামলাগুলোতে নিম্ন আদালতের বিচারকরা চাইলে প্রবেশন আইন ফলো করতে পারে, এতে সহজেই নিষ্পত্তি করা সম্ভব। তবে এই আইন ব্যবহার করতে বিচারকদের নির্দেশনা দেয়া উচিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৬০ সালের ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিনেন্স’র অধীনে ছোটখাটো অপরাধে দণ্ডিতদের প্রবেশনে ঘরে থেকেই সাজা ভোগের সুযোগ রয়েছে। ১৯৬০ সালের এ আইনটি কার্যত কাগুজে আইন হিসেবে বহাল ছিলো। এ অবস্থায় আইনটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সারা দেশের বিচারকদের প্রতি আদেশ দিয়ে একটি সার্কুলার জারি করেছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। ওই সার্কুলারে বলা হয়, ‘বর্তমানে দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রায় সব ক্ষেত্রেই দণ্ডিত অপরাধীদের সাজা ভোগের নিমিত্তে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এতে দেশের কারাগারগুলোর সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়াসহ দেশের একটি প্রচলিত আইনের বিধানকে সরাসরি অবজ্ঞা করা হচ্ছে। ফলে কারাগারের পরিবেশসহ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হতে চলেছে।’ এছাড়া এতে বলা হয়, ‘ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সব ক্ষেত্রেই সাজা আরোপ করা আইন সমর্থন করে না। কেননা সাজা প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য সংশোধনমূলক, হয়রানি ও প্রতিহিংসামূলক নয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ফরিদপুর জেলা দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোসাদ্দেক আহম্মেদ বশির আমার সংবাদকে বলেন, আসলে লঘু দণ্ডাদেশের মামলাও বিচার প্রক্রিয়ার ধাপে ধাপে উচ্চ আদালত পর্যন্ত যেতে পারে বা যাচ্ছে। মূল বিষয়টা হচ্ছে মামলাটি তখনই উচ্চ আদালতে যায় যখন আসামির নিম্ন আদালতে সাজা হয় অথবা জামিন না পায়। তখন আসামি জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করে এবং মামলাটি অটো হাইকোর্টে চলে যায়। হাইকোর্টও লঘু অপরাধ বিবেচনা করে জামিন দেন কিন্তু জামিন পাওয়ার পর আসামি বা বাদি কেউই সেই মামলার খবর রাখে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে এমন মামলা স্থগিতও হয়। এভাবেই ছোট মামলাগুলো বছরের পর বছর নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে থাকে আর মামলাজটও বাড়তে থাকে। তবে নিম্ন আদালতে বিচার প্রক্রিয়ায় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে এজন্য মামলাগুলো এখানে নিষ্পত্তি হয় না।

‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ মুক্তি দিতে পারে কি-না এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আসলে সব মামলায় প্রবেশন দেয়া যুক্তিযুক্ত নয়। যেমন- মাদক মামলার আসামিকে প্রবেশন দিলে সে আবার মাদক বিক্রির সাথে জড়িয়ে যাবে, এতে সমাজ আবার কলুষিত হবে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ‘প্রায় ৪০ লাখ মামলাজটে ভারাক্রান্ত বিচার বিভাগ। তাই লঘুদণ্ড ও আপসযোগ্য মামলাগুলো প্রথম বা দ্বিতীয় শুনানিতেই নিষ্পত্তি করা উচিত, এতে মামলাজট অনেক কমে আসবে। কিন্তু দুঃখজনক ও বাস্তব সত্য হলো লঘুদণ্ডের মামলাও বিচারিক আদালত শেষ করে হাইকোর্ট পেরিয়ে আপিল পর্যন্ত গড়ায়। এতে অতি গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ লঘুদণ্ডের মামলার বিচার করতে আদালতের অযথা অধিক সময় ব্যয় করতে হয়।’ লঘুদণ্ডের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে পরামর্শ দিয়ে এই আইনজীবী বলেন, নিম্ন আদালতের বিচারকরা চাইলে ছোট ও আপসযোগ্যে মামলার বিচারের ক্ষেত্রে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ এর ৫ ধারা বিবেচনা করতে পারেন। এতে আদালত ও বিচারপ্রার্থীদের সময় ও অর্থ দুটোই সেভ হবে। আবার কোনো আসামি মুক্ত থেকে প্রবেশন ও সংশোধনের সুযোগ পেলে অপরাধ করা থেকে নিরুৎসাহিত হবেন। এখন কথা হলো অধিকাংশ বিচারকই ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ আইন সম্পর্কে অবগত নয়, তাই তাদের মামলাজট নিরসন সহায়ক এই চমৎকার আইন সম্পর্কে জানানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, ‘১৯৬০ সালের ওই অধ্যাদেশে প্রবেশনে পাঠানোর যে বিধান রয়েছে সেটা প্রতিটি মামলায় অনুসরণ করা উচিত। এটা করলে একদিকে যেমন কারাগারের ওপর চাপ কমবে, অন্যদিকে ছোটখাটো অপরাধের আসামিরা প্রবেশনে থেকে সংশোধনের সুযোগ পাবে।

আমারসংবাদ/জেআই