Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

হজ্জের আহকাম এবং ধারাবাহিক কাজ

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

জুলাই ১৫, ২০২১, ০৬:৪০ পিএম


হজ্জের আহকাম এবং ধারাবাহিক কাজ

৮ই যিলহজ্জ প্রথম প্রহরের আগে ঐ স্থানে ইহরাম বাঁধা যেখান থেকে হজ্জ করার ইচ্ছা করা হয়। গোসল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে হজ্জের ইহরাম বাঁধতে হয়। এরপর হজ্জের ইহরামের নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করা- লাব্বাইকা হাজ্জান লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইকা ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা-শারীকা লাকা। অর্থ- আমি তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে হজ্জ আদায়ের জন্যে হাজির হয়েছি, আমি তোমার দরবারে হাজির, আমি তোমার দরবারে হাজির, তোমার কোনো শরীক নেই, আমি তোমার দরবারে হাজির, নিশ্চয়ই সমস্ত নিয়ামত এবং রাজত্ব তোমারই, তোমার কোনো অংশিদার নেই।

আর যদি হজ্জ সম্পাদন করতে কোনো বাধার আশংকা থাকে তাহলে শর্ত সাপেক্ষে নিয়ত করতে হয়। অর্থাৎ যদি কোনো বাধাদায়ক বস্তু আমাকে হজ্জ সম্পাদক করতে বাধা দেয়, তাহলে হে আল্লাহ! তুমি যেখানে আমাকে আটকিয়ে দিবে সেখানেই আমার হালাল হওয়ার স্থান হবে।কিন্তু যদি হজ্জ সম্পাদন করতে কোনো বাধার আশংকা না থাকে তাহলে শর্তের প্রয়োজন নেই বরং শর্ত ছাড়াই নিয়ত করতে হবে। অতঃপর মিনার দিকে রওয়ানা দিতে হবে। মিনায় পৌঁছে যোহর, আসর, মাগরিব, এশা এবং ফজর এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নির্ধারিত সময়ে কছর করতে হয়। জমা বা দুই ওয়াক্তের স্বলাত একত্রে পড়া যাবেনা। আরাফার দিন সূর্য উঠার পর মিনা থেকে আরাফার দিকে রওয়ানা দিতে হবে। সম্ভব হলে নামিরা নামক স্থানে অবস্থান করা। আর তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে কোনো ক্ষতি নেই। কেননা নামিরায় অবস্থান করা সুন্নত। যখন সূর্য ঢলে যাবে, তখন যোহর ও আসরের স্বলাত একসাথে প্রথম ওয়াক্কতে দু-দু রাকাআত করে পড়তে হবে। যেমনি নবী (স.) করেছিলেন। নামাজের পর মহান আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি, যিকর ও দো‘আয় সময় কাটানো। আর নিজ পছন্দানুযায়ী দু’হাত উঁচু করে কিবলামূখী হয়ে দো‘আ করা। যদি জাবালে রাহমাত পিছনে পড়ে যায় তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা কিবলামূখী হওয়া সুন্নত, আর জাবালের দিকে মুখ করা সুন্নত নয়। এই মহান অবস্থান স্থলে রাসূল (স.) বেশী বেশী করে এই দোয়া পাঠ করতেন- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা-কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদীর। অর্থ- একমাত্র আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো মা‘বুদ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তারই এবং তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।

যদি কোনো ক্লান্তি অনুভূত হয় আর এই ক্লান্তি দূর করতে সাথীদের সাথে লাভজনক কথাবার্তা অথবা কল্যাণকর কিতাবাদি, বিশেষ করে যে সমস্ত কিতাব আল্লাহ তায়ালার দয়া ও দান সম্পর্কে লিখিত ঐ সমস্ত কিতাব পাঠ করতে ইচ্ছা হয় তাহলে তা হবে উত্তম। অতঃপর বিনয়ের সাথে আল্লাহর দিকে রূজু হয়ে দো‘আ করা এবং দিনের শেষ ভাগটা দো‘আর মাধ্যমে কাটাবার সুযোগ গ্রহণ করা। কেননা আরাফার দো‘আ হল সর্বশ্রেষ্ঠ দো‘আ।

সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুজদালিফার দিকে যাত্রা করা। সেখানে পৌঁছে মাগরিব ও এশার স্বলাত একত্রে পড়া। হ্যাঁ যদি মুজদালিফায় এশার সময়ের পূর্বেই পৌঁছা যায় তাহলে মাগরিবের স্বলাত মাগরিবের সময় এবং এশার স্বলাত তার নির্ধারিত সময়ে আদায় করতে হবে। তবে যদি ক্লান্তি বা পানির স্বল্পতার দরুন জমা বা একত্র করতেই হয় তাহলে কোনো অসুবিধা নেই, যদিও এশার সময় না হয়। আর যদি আশংকা হয় যে, অর্ধরাতের পূর্বে মুযদালিফায় পৌঁছাতে পারবে না তাহলে মুযদালিফায় পৌঁছার পূর্বে হলেও স্বলাত পড়ে নিবে, কেননা অর্ধরাত পর পর্যন্ত স্বলাত পিছিয়ে নেওয়া জায়েয নয়। আর মুযদালিফায় রাত্রিযাপন এবং ফজরের সময় হওয়ার পরপরই আজান ও ইক্বামত দ্বারা স্বলাত আদায় হবে। অতঃপর মাশ‘আরে হারামে গিয়ে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ ও বড়ত্ব বর্ণনা করে এবং সম্পূর্ণ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দো‘আয় মগ্ন থাকবে। যদি মাশ‘আরে হারামে যাওয়া সম্ভব না হয় তাহলে নিজ অবস্থান স্থলে থেকেই ক্বিবলামূখী হয়ে দু’হাত উঠিয়ে দো‘আ করতে হবে। যখন পূর্ণ ফর্সা হয়ে যাবে তখন সূর্য উঠার পূর্বেই মিনার দিকে রওয়ানা দিতে হবে এবং মুহাসসির নামক উপত্যাকায় আসলে দ্রুতগতিতে চলতে হবে। মিনায় পৌঁছার পর নিকটবর্তী পরপর সাতটি কংকর নিক্ষেপ করা। কংকরগুলি বুটের দানা পরিমাণ হতে হবে। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় ‘‘আল্লাহু আকবার’’ বলা। কংকর নিক্ষেপের পর কোরবানির পশু যবেহ করা। তারপর পুরুষেরা মাথা মু্লন করবে। আর মহিলারা আঙ্গুলির অগ্রভাগ পরিমাণ চুল ছোট করবে। এরপর মক্কায় গিয়ে হজ্জের তাওয়াফ ও সা‘ঈ করবে। কংকার নিক্ষেপ ও মাথা মু্লনের পর যখন তাওয়াফ করার জন্য মক্কায় যাওয়ার মনস্থ করবে, তখন সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নত। তাওয়াফ ও সা‘ঈ শেষে মিনায় ফিরে এসে ১১ ও ১২ তারিখের রাত্রি যাপন করতে হবে এবং দিনে সূর্য ঢলার পর তিনটি জামরায় পর পর সাতটি কংকর নিক্ষেপ করতে হবে। এই জামরাটি মক্কা থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী মসজিদে খায়ফের নিকট অবস্থিত। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করতে হবে। কংকর নিক্ষেপ শেষে সামান্য এগিয়ে নিজ পছন্দ মোতাবেক দীর্ঘক্ষণ ধরে দো‘আ করা। যদি দো‘আর জন্য সময় কাটানো অসম্ভব হয় তাহলে দো‘আ সংক্ষেপে করা, যাতে সুন্নতের উপর আমল হয়ে যায়। তারপর মধ্যবর্তী জামরায় পরপর সাতটি কংকর নিক্ষেপ করা। কংকর নিক্ষেপের পর বাম দিকে সামান্য এগিয়ে কিবলামূখী হয়ে দু’হাত উঁচু করে সম্ভব হলে সম্ভব হলে দীর্ঘক্ষণ ধরে দো‘আ করা। আর না হয় সম্ভব পরিমাণ দাঁড়িয়ে দো‘আ করা। তারপর জামরায়ে আকাবায় পরপর সাতটি কংকর নিক্ষেপ করতে হবে। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় আল্লাহু আকবার বলা। এই জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর দো‘আর জন্য না থেকেই চলে যেতে হবে। এভাবে ১২ তারিখে কংকর নিক্ষেপ করার পর যদি প্রত্যাবর্তন করতে ইচ্ছা হয়, তাহলে মিনা থেকে বের হয়ে যেতে হবে। আর যদি ইচ্ছা হয়, তাহলে মিনায় ১৩ তারিখের রাত্রি যাপন করা এবং দিনে উপরোল্লেখিত নিয়ম অনুযায়ী তিনটি জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা। ১২ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে মিনা থেকে বের না হয়, তাহলে আরেক দিন অবস্থান করে ১৩ তারিখ সূর্য ঢলার পর তিনটি জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। যখন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার ইচ্ছা করবে, তখন তাওয়াফে বিদা বা বিদায়ী তাওয়াফ না করা পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন না করা। কেননা নবী (স.)  বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন তার সফরের শেষে আল্লাহর ঘরের সঙ্গে শেষ য়িয়ারত না করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে না। তবে ঋতুবতী ও নেফাসওয়ালী মহিলাদের উপর বিদায়ী তাওয়াফ নেই। আর তাদের পক্ষে বিদায়ের জন্য মসজিদে হারামের গেইটের পাশে অবস্থান করা উচিত নয়। হজ্জ ও উমরাহ্ আদায়কারীর উপর নিম্নের বিষয়গুলি  ওয়াজিব- ১. আল্লাহ তা‘আলা যে সমস্ত বিষয় ওয়াজিব করে দিয়েছেন তা পুংখানুপুংখরূপে সম্পাদন করা। সঠিক সময়ে জামাতের সাথে স্বলাত আদায় করা। ২. নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা। যেমন- স্ত্রী সম্ভোগ, বেহুদা ও বিবাদ বিসংবাদমূলক কাজ ও কথা-বার্তা ইত্যাদি। ৩. কথা ও কাজে কোনো মুসলিমকে কষ্ট না দেওয়া। ৪. ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কার্যাদি থেকে দূরে থাকা।

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহ- ক. চুল বা নখ না কাটা। তবে কাঁটা বিধলে তা খুলতে কোনো অসুবিধা নেই, যদিও রক্ত বের হয়ে যায়। খ. শরীর, কাপড়, পানীয় বস্তু অথবা খাদ্য-দ্রব্যে সুগন্ধি ব্যবহার না করা। অনুরূপ সুগন্ধিযুক্ত সাবানও ব্যবহার না করা। কিন্তু যদি ইহরামের পূর্বেকার ব্যবহূত সুগন্ধি (শরীরে) থেকে যায়, তাতে কোনো দোষ নেই। গ. কোনো হালাল স্থলচর জন্তু শিকার না করা। ঘ. উত্তেজনাসহ স্ত্রীর গা স্পর্শ না করা অথবা চুমু না দেয়া। আর স্ত্রী-সহবাস এর চেয়েও দোষণীয়। ঙ. নিজের জন্য কিংবা অপরের জন্য বিবাহের প্রস্তাব দিবে না এবং আকদও করবে না। চ. হাত মোজা ব্যবহার করবে না। তবে ছেঁড়া কাপড় দিয়ে তা বাঁধলে কোনো অসুবিধা নেই।

ইহরাম অবস্থয় আরো কিছু নিষিদ্ধ কাজ- ক. এমন কিছু দিয়ে মাথা না ঢাকা- যা মাথায় লেগে যায়। তবে ছাতা ব্যবহার করা, গাড়ী ও তাঁবুতে অবস্থান করা, অথবা মাথায় বোঝা চাপানো দোষণীয় নয়। খ. জামা, কাপড়, বুরনুস (এক প্রকার টুপি সংযুক্ত জামা), পায়জামা এবং মোজা ব্যবহার করা যাবে না। তবে যদি লুঙ্গি না পায় তাহরে পাজামা ব্যবহার করা যাবে। এমনিভাবে যদি জুতা না পায় তাহলে মোজা ব্যবহার করা যাবে। গ. উপরোল্লেখিত পরিধেয় বস্তুর সাথে যা সামঞ্জস্য রাখে তাও ব্যবহার করা যাবে না। যেমন ‘আবা (এক প্রকার জামা), টুপি, গেঞ্জি ইত্যাদি। তবে জুতা, আংটি, চশমা, শোনার জন্য কানের মেশিন, হাতঘড়ি ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও টাকা পয়সা রাখার জন্য কোমরবন্দ ও পেটি ব্যবহার করা জায়েয আছে। অনুরূপ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য এমন কিছুর ব্যবহার যাতে সুগন্ধি নেই তাও জায়েয আছে। মাথা ও শরীর ধোয়া জায়েয আছে। অনুরূপ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য এমন কিছুর ব্যবহার যাতে সুগন্ধি নেই, তা জায়েয আছে। মাথা ও শরীর ধোয়া জায়েয আছে, এমতাবস্থায় যদি অনিচ্ছাবশতঃ চুল পড়ে যায় তাহলে কোনো ক্ষতি নেই। আর মহিলারা মুখাচ্ছাদন অথবা বোরকা পরিধান করবে না। ইহরাম অবস্থায় মহিলাদের জন্য মুখ খুলে রাখা সুন্নত। তবে পর পুরুষের সামনে মুখ ঢেকে রাখা ওয়াজিব। এখানে উল্লেখ্য যে, অমুহরিম অবস্থাতেও নারীদের জন্য পর পুরুষের সামনে মুখ ঢেকে রাখা ওয়াজিব।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী

আমারসংবাদ/জেআই