Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাঘাতে হতে পারে ইনসোমনিয়া

মাছুম বিল্লাহ

জুলাই ৩০, ২০২১, ০৬:১৫ পিএম


মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাঘাতে হতে পারে ইনসোমনিয়া
  • গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রেস বা চাপ মাঝেমধ্যে উপকারী কিংবা ধনাত্মক। এটি আমাদের বেশি সতর্ক করে এবং কোনো কোনো অবস্থায় ভালো কাজ করতে সহায়তা করে। তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হলেই হূৎযন্ত্রের ব্যাধি, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, হতাশা বাড়িয়ে দেয়। নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস স্ট্রেস কমাতে সহায়তা করে এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করে। অতএব, সেসব অভ্যাসকে আমরা অনুশীলন করতে পারি। আমাদের স্বাভাবিক কাজের সময়ের মধ্যেই অবকাশের জন্য একটু সময় বের করে নিতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, আমার শরীর ও মন যখন ভালো লাগবে, আমার কাজও তখন ভালো লাগবে। আর ভালো লাগা-খারাপ লাগা বিষয় অনেকটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থেই খারাপ লাগার কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

‘স্ট্রেস’ এক ধরনের অনুভূতি- যা আমাদের অনুভব করায় যে, আমরা অনেক বেশি কিংবা অসম্ভব রকমের চাপের মধ্যে আছি। আমাদের মনের মধ্যে এক অস্থিরতা তাড়া করে বেড়ায়। এটি আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের বিভিন্ন বিষয় থেকে আসতে পারে। সেটি হতে পারে বেশি পরিমাণে কাজের চাপ, এক কাজ থেকে অন্য কাজে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময় কিংবা নতুন কর্মস্থলে গিয়ে কাজ শুরু, পুরাতন কাজ ছেড়ে দেয়ার চিন্তা ও কাজের শেষ সময়, পরিবার কিংবা সহকর্মীদের কারো সঙ্গে কথা কাটাকাটি কিংবা যুক্তিতর্ক করা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, কাউকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, অথচ বাহ্যিক কিছু বাধা সেটি হতে দিচ্ছে না। এ অবস্থা আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে ফেলে, মনকে অস্থির করে তোলে। মনের এই অস্থিরতায় শরীর এক ধরনের সাড়া দেয়। এ বিষয়টিই স্ট্রেস। এর প্রকাশ হতে পারে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন ধরনের। যেমন, আমাদের আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে, আমরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে যেতে পারি। এ ধরনের অবস্থা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে থাকে।

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দরকার ৫ ধরনের খাবার। বর্তমান সময়ে আমাদের কর্মক্ষেত্র, পরিবার, সমাজ, আকাঙ্ক্ষা, চারদিকের চাকচিক্য, অর্থবিত্ত পাওয়া-না পাওয়ার দ্বন্দ্ব, পদোন্নতি না পাওয়া, অন্যের সঙ্গে তুলনা, প্রতিপত্তি, ক্ষমতার মোহ আমাদের এত বেশি ব্যস্ত ও সন্ত্রস্ত রাখে যে, আমরা মানসিকভাবে সর্বদাই চাপের মধ্যে থাকি। প্রত্যেক মানুষই এ ধরনের চাপ অনুভব করে থাকে। তবে এটি যখন স্বাস্থ্যের জন্য কিংবা জীবনের মঙ্গলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। মানসিক চাপের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা। এটি যদি সপ্তাহে তিন দিন হয় এবং তিন মাস যাবৎ চলতে থাকে, তাতে ইনসোমনিয়া হতে পারে। যার অর্থ হচ্ছে ঘুমাতে না পারা, মানসিক চাপের চক্র ও নির্ঘুম অবস্থা। আর ঘুমাতে না পারা মানে আরও মানসিক চাপ বেড়ে যাওয়া।

জীবনকে চালাতে হলে বিশেষ করে ছন্দময়, গতিশীল ও সুন্দরভাবে সামনে এগিয়ে নিতে হলে এই স্ট্রেসকে আমাদের ম্যানেজ করতে জানতে হবে; একে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়- সেটি জানতে হবে। এটি কীভাবে না হয়, তার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যায়াম একটি চমৎকার স্ট্রেস উপশমকারী বিষয়। ব্যায়াম ঘুম আনতে সহায়তা করে। আর সুনিদ্রার অর্থ হচ্ছে চমৎকার মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। চমৎকার পরিমিত ঘুম মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। ব্যায়ামের ফলে এনডরফিন ও এন্ডোক্যানাবিনয়েড নামের হরমোন নিঃসৃত হয়- যা ব্যথা কমায়, ঘুমের উন্নতি ঘটায় এবং মনের উত্তেজনা কমিয়ে প্রশান্তি আনে। ব্যায়াম করার যদি সেভাবে সময় ও সুযোগ না থাকে, সেক্ষেত্রে গাড়ি চালানোর পরিবর্তে সাইকেল কিংবা হাঁটার পথ হলে হেঁটে কর্মক্ষেত্রে যেতে পারেন। অফিসে লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করতে পারেন। পাশাপাশি কাজ থেকে সামান্য একটু বিরতি নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটার অভ্যাস করলে হতোদ্যম মন ভালো হয়ে যায়। আর উন্মুক্ত মাঠ কিংবা পার্কে হাঁটা শরীর ও মনকে সতেজ করে এবং নতুন উদ্যম সৃষ্টি করে। মনে রাখতে হবে, শরীর ও মনকে প্রশান্তির মধ্যে রাখার উল্লেখযোগ্য একটি পদ্ধতিই হচ্ছে ব্যায়াম, যা আমাদের মনের অবস্থা পরিবর্তন করে দিতে পারে।

যদি কোনো বিষয় আপনার বিরক্তির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে সেটি নিয়ে আপনার পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব, ডাক্তার, বিশ্বস্ত ধর্মীয় নেতার সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। নিজের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন। আমরা আমাদের নিজেদের সঙ্গে কথা বলতে পারি, তবে তা হতে হবে পজিটিভ। কোনো কাছের আত্মীয়র মৃত্যু, মারাত্মক অসুস্থতা, পরিবারে কারো মৃত্যু, কিংবা দুঃসহ জীবন- এগুলো মানসিক চাপ বাড়ায়; কিন্তু মনে করতে হবে এগুলো পুরোটাই প্রাকৃতিক, যার ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। আর মানুষের যেখানে হাত নেই, সেটি তো হবেই। সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তা করে কোনো লাভ নেই।

আপনি যা পছন্দ করেন, তা করার জন্য একটি সময় আলাদা করে রাখতে হবে। আপনার যা করতে ভালো লাগে, তা প্রতিদিনই করতে পারেন- যা আপনার মানসিক চাপকে কমিয়ে দেবে। এজন্য ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময়ই যথেষ্ট। এসব হতে পারে বই পড়া, সেলাই করা, কিছু অঙ্কন করা, খেলাধুলা করা, সিনেমা দেখা, পাজল খেলা করা। আধুনিক জীবন অত্যন্ত ব্যস্ত। তাই মাঝেমধ্যে আমাদের কাজের গতি কিছুটা কমিয়ে আনতে হবে। আমরা যখন চাপের মধ্যে থাকি, তখন মাংসপেশিগুলো উত্তেজিত থাকে। আমরা তখন হাত-পা প্রসারিত করে, ম্যাসাজ করে, হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করে, পর্যাপ্ত ঘুম দিয়ে হালকা করতে পারি।

ধনাত্মক আত্মকথন একটি চমৎকার দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম দিতে পারে। আশাবাদী ও সহানুভুতিশীল আলোচনা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে ভালো কাজ সম্পাদিত হয়। নিজের সামর্থ্যে সন্দেহ জাগলে নিজেকে সহানুভূতির সঙ্গে বোঝাতে হবে। এজন্য নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলার ধরন অনেকটাই মূল্যবান; কারণ এটি অনেক কিছু প্রভাবিত করতে পারে। নিজ সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা, সন্দেহ, ধ্বংসাত্মক পূর্বলক্ষণ প্রকাশ করা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। এ ধরনের চিন্তা নিজেকে স্ট্রেসের মধ্যে ফেলে দেয়। নিয়মিত ও সুষম খাবার আপনার ভেতর সুন্দর অনুভূতি জাগাবে এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করবে। তাই খাবারে যথেষ্ট ফলমূল, শস্যদানা আর প্রোটিন থাকতে হবে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য।

দেখা যায়, আমাদের প্রায়ই খুব অস্থির মনে হয়। কাজে মনোনিবেশ করা যায় না। ঘন ঘন মত পরিবর্তন, মেজাজ সহজে বিগড়ে যাওয়া, সান্ত্বনা না পাওয়া, আত্মসম্মানবোধ কমে যাওয়া, স্বাভাবিকের চেয়ে কম কিংবা বেশি খাওয়া, ঘুমের পরিবর্তন হওয়া; অর্থাৎ অস্বাভাবিক ঘুম কিংবা একেবারে কম ঘুম, তামাক বিড়ি, অ্যালকোহল খাওয়ার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়া, মাংসপেশিতে ব্যথা, ডায়রিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য, অস্থিরতা এমন যে এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসতে না পারা, যৌনক্ষমতা কমে যাওয়া, কোনো কিছুতে সহজেই বিস্মিত হওয়া- এ লক্ষণগুলো যখন কোনো মানুষের মধ্যে প্রকাশ পেতে থাকে, তখন বুঝতে হবে তিনি মানসিক চাপের মধ্যে আছেন। আর এগুলো দীর্ঘদিন চলতে থাকলে মানুষের শরীর, মন ও মানসিকতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ক্ষেত্রে মানসিক ডাক্তারের পরামর্শ নেয়াটাই শ্রেয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রেস বা চাপ মাঝেমধ্যে উপকারী কিংবা ধনাত্মক। এটি আমাদের বেশি সতর্ক করে এবং কোনো কোনো অবস্থায় ভালো কাজ করতে সহায়তা করে। তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হলেই হূৎযন্ত্রের ব্যাধি, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, হতাশা বাড়িয়ে দেয়। নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস স্ট্রেস কমাতে সহায়তা করে এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করে। অতএব, সেসব অভ্যাসকে আমরা অনুশীলন করতে পারি। আমাদের স্বাভাবিক কাজের সময়ের মধ্যেই অবকাশের জন্য একটু সময় বের করে নিতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, আমার শরীর ও মন যখন ভালো লাগবে, আমার কাজও তখন ভালো লাগবে। আর ভালো লাগা-খারাপ লাগা বিষয় অনেকটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থেই খারাপ লাগার কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)

আমারসংবাদ/জেআই