Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

স্যারে স্বস্তি-ভাইয়ে অস্বস্তি

আগস্ট ১, ২০২১, ০৬:২৫ পিএম


 স্যারে স্বস্তি-ভাইয়ে অস্বস্তি
  • ‘স্যার’ ডাক সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন —অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
  • ‘স্যার’ না ডাকলে রুষ্ট হওয়া স্ববিরোধী —ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, সাবেক প্রসিকিউটর, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল
  • উন্নত দেশে গণকর্মচারীরাই সেবাগ্রহীতাকে ‘স্যার’ বলেন —অ্যাডভোকেট সিদ্দিক উল্যাহ মিয়া, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
  • সেবকের স্থান কীভাবে মালিকের ওপরে হয় —ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
  • ‘স্যার’ ডাক প্রত্যাশা  কলোনিয়াল মানসিকতা —অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট 

‘স্যার’-এ স্বস্তি, ‘ভাই’ বললেই বিপত্তি। সম্বোধন নিয়ে নাগরিকরা সরকারি দপ্তর-পরিদপ্তরগুলোতে প্রায়ই চরম দুর্ব্যবহারের শিকার হচ্ছেন। ‘স্যার’ না বললে পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত সেবা। হচ্ছেন লাঞ্ছিত ও সেবাবঞ্চিত। শুধু জনগণই নয়, তথ্য চাইতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরাও। প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। সমাধান মিলছে না। ‘স্যার’ সম্বোধন না করলেই বিরক্তি প্রকাশ করছেন কর্মকর্তারা। ফলে নানা সময়ে ‘স্যার’ না বলায় নাগরিকদের উপর সরকারি কর্মচারীদের ক্ষুব্ধ বা রুষ্ট হওয়ার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। এ নিয়ে বিতর্ক যেনো থামছেই না। থেমে নেই সমালোচনাও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনরাও পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন। তবুও বারবার ঘটছে একই ঘটনা। সম্বোধন নিয়ে আপত্তির মাঝে জনগণ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘স্যার নাকি ভাই’ কী বলে ডাকবে জানতে চেয়ে গত বছর তথ্য অধিকার আইনে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেন উন্নয়নকর্মী সালেহীন চৌধুরী। তার জবাবে বলা হয়েছে, সম্বোধন সংক্রান্ত কোনো আইন বা বিধি জেলা প্রশাসকের দপ্তরে নেই। তাই ‘স্যার’ সম্বোধন নিয়ে সুস্পষ্ট আইনি ব্যাখ্যা কী? জানতে চাওয়া হলে আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন— প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ‘স্যার’ বলার কোনো আইনগত বৈধতা নেই। এর কোনো আইনি ভিত্তিও নেই। সরকারি চাকরিবিধিতেও এর কোনো উল্লেখ নেই। নেই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও।

তারা জোর দিয়ে বলছেন, এটা শুধু একটা ‘কলোনিয়াল লিগ্যাসি’ এবং ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া মনোভাব। আইন, বিধি ও সাংবিধানিক বৈধতা না থাকার পরও কর্মচারীদের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। ‘স্যার’ বিতর্ক যেনো পিছুই ছাড়ছেই না। সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ‘স্যার’ ডাক শোনার প্রবণতাও বেড়েছে। ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক লাঞ্ছনার ঘটনা শুধু সমালোচনাই নয়, পাশাপাশি উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। শুধু সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাই নন, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাও  সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন প্রত্যাশা করেন বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।

এদিকে ‘স্যার’ না ডাকায় এক সরকারি কর্মকর্তা সাংবাদিককে অফিস থেকে বের করে দেয়ার সমালোচনা করেছেন সাবেক কয়েকজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তারা বলছেন, ‘এই সম্বোধন শোনার আকাঙ্ক্ষা ঔপনিবেশিক মানসিকতা ছাড়া কিছু নয়। এটা বলতেই হবে এমন কোনো কথা চাকরিবিধিতে নেই। বরং সংবিধান নাগরিককে সকল ক্ষমতার উৎস হিসেবে বিবেচনা করেছে। সরকারি কর্মকর্তাকে নাগরিকদের কেন ‘স্যার’ ডাকতে হবে, সে প্রশ্নও তুলেছেন তারা। তারা বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রজাতন্ত্রে সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণ জনগণের সেবক। জনগণই বরং ‘স্যার’ সম্বোধন প্রাপ্য। কোনো কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন না করলে, তিনি যদি রেগে যান, দুর্ব্যবহার করেন, তবে সেটা একান্তই তার মূর্খতা এবং বোকামির বহিঃপ্রকাশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য ও দায়িত্ব। তাদের দাবি, প্রজাতন্ত্রের সংবিধান কাউকে লর্ডের মর্যাদা দেয়নি। বেতন নেবো জনগণের টাকায়, শপথ নেবো সংবিধান সমুন্নত রাখার, অঙ্গীকার করবো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করার কিন্তু জনগণ ‘স্যার’ না ডাকলে রুষ্ট হবো, জনগণকে অনুগ্রহভাজন হিসেবে অবহেলা করবো এটা হতে পারে না। এ অবস্থান স্ববিরোধী। এই বিধানের আলোকে ২০১৮ সালে সরকারি কর্মচারী আইন করা হয়। এ আইনের প্রথম অধ্যায়ের ১৬ ধারায়ও ‘সরকারি কর্মচারী’ অর্থ লেখা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তি। এ ছাড়া সংবিধানের (অনুচ্ছেদ ১২০, ১৩৪, ১৫২) অনুচ্ছেদও ব্যাখ্যা রয়েছে, সেখানেও ‘সরকারি কর্মচারী’ অর্থ লেখা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে বেতনাদিযুক্ত পদে অধিষ্ঠিত বা কর্মরত কোনো ব্যক্তি’। এখানেও ‘কর্মকর্তা’ শব্দটি নেই। সংবিধান ও আইনের কোথাও যেখানে কর্মকর্তা বলে কোনো শব্দে নেই, সেখানে সরকারের কর্মচারীরা কীভাবে এবং কোন এখতিয়ারে নিজেদের ‘কর্মকর্তা’ বলে দাবি করেন তা মোটেও যৌক্তিক নয়। আর ‘স্যার’ আশা করা আরো অযৌক্তিক। তারা বলেন, প্রজাতন্ত্রের মালিক যে জনগণ, সেই জনগণের সঙ্গে বাজে আচরণ করা, সেটি স্পষ্টত সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন তো বটেই, মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন।

এদিকে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছিলেন, দুদক চায়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করবেন। ওই সময় তিনি বলেন, এটি খুবই প্রত্যাশিত এবং স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। কিন্তু ‘কলোনিয়াল লিগ্যাসির’ ধারাবাহিকতায় আমরা একে অস্বাভাবিক একটি ব্যাপার করে তুলেছি। ঔপনিবেশিক কায়দায় উল্টো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘স্যার’ বলে সেবাপ্রার্থীর জান জেরবার হয়ে যায়। দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, সরকারি কর্মচারীরা জনগণের কাছ থেকে যে ‘স্যার’ সম্বোধন পেতে চান, এটি এক ধরনের হীনম্মন্যতাবোধ। ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স। সরকারি কর্মচারীদের প্রতি তার প্রশ্ন, ‘আপনাকে যদি অসম্মান না করে কেউ নাম ধরে ডাকেন তবে একটা বিষয় ছিলো, কিন্তু ভাই বললে আপনার সমস্যা কী? আপনি তো প্রভু নন। আর সেবাপ্রার্থী জনগণও আপনার দাস নন। যে তার কাছ থেকে ‘স্যার’ ডাক শুনতেই হবে।’

এ বিষয়ে আইনজীবীরা বলছেন, শপথ ও অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা শপথগ্রহণকারীর সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। সংবিধান যেহেতু জনগণের সুপ্রিমেসি নিশ্চিত করেছে, সুতরাং কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা পাবলিক সার্ভেন্ট জনগণকে ‘স্যার’ বলতে প্রকাশ্যে বা আচরণে বাধ্য করতে পারেন না। সার্ভিসে সিনিয়রিটি, পদমর্যাদার ভিত্তিতে ‘স্যার’ সম্বোধনের বিষয়টি একান্তভাবে সার্ভিসের নিজস্ব রীতি-নীতি। সেটি তাদের প্র্যাক্টিসের বিষয়। তবে জনগণকে ‘স্যার’ সম্বোধনে বাধ্য করা সংবিধানবিরোধী। কেউ শ্রদ্ধা করে, ভালোবেসে বা স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য স্বীয় সিদ্ধান্তে কাউকে ‘স্যার’ সম্বোধন করলে সেটি একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু কেউ পাবলিক সার্ভেন্টকে ‘স্যার’ ডাকতে বাধ্য নয়। বরং পাবলিক সার্ভেন্টদের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দেশকে শাসন করার জন্য ব্রিটিশ যে আইন প্রণয়ন করেছিল সে আইনে এখনো দেশ চলছে। ‘অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট-১৯২৩’-এর মতো অনেক আইন আজো কার্যকর রয়েছে, যা ব্রিটিশরা তাদের স্বার্থরক্ষায় প্রণয়ন করেছিলেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, ‘অস্বীকার করা যাবে না, কিছু মানুষকে সবাই স্বপ্রণোদিত হয়েই ‘স্যার’ সম্বোধন করেন। বিশেষত শিক্ষকদের। এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন ইউএনও বা ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা পুলিশ অফিসার যদি মনে করেন যে, জনগণ তাদের ‘স্যার’ বলবে বা বলতে বাধ্য। তবে সেটি হবে কলোনিয়াল মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। এর কোনো সাংবিধানিক বা আইনগত বৈধতা নেই। তবে সাধারণ মানুষ যদি একজন ইউএনওকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে, তাতেও দোষের কিছু নেই। এটা মানুষে মানুষে ভিন্ন হতে পারে। কেউ হয়তো ‘স্যার’ বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কেউ হয়তো সম্মানার্থেই     ‘স্যার’ বলেন। কিন্তু কোনো পাবলিক সার্ভেন্ট (গণকর্মচারী) যদি নিজেকে ‘কর্মকর্তা’ বা জনগণের প্রভু ভাবা শুরু করেন এবং তিনি যদি মনে করেন, তাকে ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করতে হবে তাহলে এটি তার মানসিক সমস্যা। তিনি আদৌ এই পদের যোগ্য কি-না, সেই প্রশ্নটিই বরং তোলা দরকার।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘সংবিধান, আইন, নৈতিকতা কোনো দিক দিয়েই জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্মকর্তা জনগণের উপরে নন। স্বাধীন দেশের জনপ্রতিনিধি, বিচারপতি, কর্মকর্তা কেউ রাজকর্মচারী নন, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রজাতন্ত্রের সংবিধান কাউকে লর্ডের মর্যাদা দেয়নি। বেতন নেবো জনগণের টাকায়, শপথ নেবো সংবিধান সমুন্নত রাখার, অঙ্গীকার করবো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করার। কিন্তু জনগণ ‘স্যার’ না ডাকলে রুষ্ট হবো, জনগণকে অনুগ্রহভাজন হিসেবে অবহেলা করবো এটি হতে পারে না। এ অবস্থান স্ববিরোধী। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণ প্রদত্ত ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্র চলে। যারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন-ভাতা, যানবাহন, আবাসনসহ অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্ত হন, তা জনগণের প্রদত্ত করের টাকায়। সংবিধানের প্রথম ভাগে ৭-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিদ্দিক উল্যাহ মিয়া বলেন, ‘উন্নত দেশের গণকর্মচারীরা অর্থাৎ জনগণের করের পয়সায় যাদের বেতন হয়, তারাই জনগণকে বা সেবাগ্রহীতাকে ‘স্যার’ বলেন। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তো বটেই, দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীরাও প্রত্যাশা করেন বা মনে করেন, সেবাগ্রহীতারাই তাদের ‘স্যার’ বলবেন। শুধু সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষই নন, তথ্যগ্রহীতা সাংবাদিকরাও তাদের ‘স্যার’ বলবেন, অনেকে এটিও প্রত্যাশা করেন। যে কারণে অনেক সময় সাংবাদিকরা তাদের ‘স্যার’ না বললে ক্ষেপে যান। যার সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জে। তাই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংবিধান অনুসরণ করা উচিত আর ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া ঔপনিবেশিক মনোভাব পরিহার করা উচিত। ‘স্যার’ নয়, সেবাই প্রধান— এ বিষয়টি ধারণ করা উচিত।’

জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ‘আমাদের সংবিধান নাগরিককে রাষ্ট্রের মালিকের স্বীকৃতি দিয়েছে। আর সরকারি কর্মকর্তারা হলেন জনগণের সেবক। সুতরাং সেই নাগরিকরা যদি  ‘স্যার’ না বলায় তাদের সেবকদের কাছে হয়রানি ও দুর্ব্যবহারের শিকার হন তাহলে এটা দুঃখজনক। অথচ উন্নত দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবা নিতে আসা  নাগরিকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। সরকারি অফিসারদের ‘স্যার’ বা জনাব বলতে হবে এর কোনো আইনগত ও সাংবিধানিক ভিত্তিও নেই। তারা যদি জনগণের কাছ থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন আশা করেন তাহলে সেটা হবে ঔপনিবেশিক মনোভাব ও হীনম্মন্যতা। একজন নাগরিক কখনো কোনো কর্মকর্তার অধীনস্থ নন, বরং নাগরিকের ট্যাক্সের টাকায়ই তাদের বেতন হয়। সুতরাং তাদের প্রতি সহনীয় আচরণ সবার কাম্য। সেবকের স্থান কিভাবে মালিকের উপরে হয়।’

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটলেও আমাদের ভাগ্যে কার্যত সে স্বাধীনতা জোটেনি। ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে বাংলাদেশে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জনসাধারণের কাছ থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাবি করা। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্টই বলা হয়েছে— ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সব ব্যয় বহন করে দেশের জনগণ। তাই যাদের টাকায় আপনার সংসার চলবে তারাই আপনাকে ‘স্যার’ বলবে এটা হতে পারে না। আমাদের দেশের যে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা তা দুই শতাধিক বছরের পুরনো। ব্রিটিশ যে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিল সে আদলেই এখনো বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র চলছে। ‘সেবার’ চেয়ে ‘শাসনের’ মনোভাব ও মানসিকতা নিয়েই স্বাধীন দেশ চলছে। ব্রিটিশরা যখন ভারত উপমহাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তখন বিভিন্ন পদ-পদবি সৃষ্টি করে এ দেশবাসীকে শাসন করত। অথচ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ দেশবাসীকে গোলাম বানিয়ে শাসন করার ট্রেনিং এবং বর্তমান ট্রেনিংয়ে কোনো পার্থক্য নেই।’

সাবেক সচিব শফিক আলম মেহেদী বলেন, ‘এটা ঔপনিবেশিক মানসিকতা। একটি স্বাধীন দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের এমন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন প্রয়োজন। আমরাও চাকরি করেছি কখনো এমন প্রত্যাশা করিনি।’

সাবেক মহা হিসাব নিরীক্ষক মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘কাউকে ‘স্যার’ বলার জন্য জোর করা যাবে না। কারণ তিনি তো আমার অফিসের অধীন কেউ নন। কেউ যদি সম্মান করে ‘স্যার’ বলেন, তো বলবেন, না বললেও কিছুই বলার নেই।’

পশ্চিমা বিশ্বে সরকারি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গেলে সেখানকার কর্মীরাই সাধারণকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে জানতে চান, কী উপকার করতে পারেন তারা। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এটি কখনো দেখা যায় না। জনগণকে ‘স্যার’ ডাকতে পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েও তা করা যায়নি।

সরকারি কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না ডাকায় যেসব লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে—

১. ময়মনসিংহের ত্রিশালে সেবা নিতে আসা নাগরিককে বিদ্যুতের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেন বলেন ‘আমাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে কথা বলুন, আমি ডিসির সমমান। আমার সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন, আমি ডিসির সমমান পদমর্যাদায় আছি। আমি ২০তম বিসিএসে ক্যাডার হিসেবে যোগদান করার পর পঞ্চম গ্রেডে কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছি। আমাকে আগে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে পরে কথা বলুন’ বলেই ফোন কেটে দেন ত্রিশাল বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেন। দৈনিক সমকাল প্রতিনিধি মতিউর রহমান সেলিম নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেনকে ফোন দিলে তিনি এমন কথা বলেন।

২. ম্যাডাম না বলায় স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর ওপর চটেছেন পাবনার বেড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা খানম। উত্তেজিত হয়ে এ সময় সাংবাদিককে বলেন, ‘আপনি কতদিন ধরে সাংবাদিকতা করেন। আপনি জানেন না একজন ইউএনওকে ‘স্যার’ বা ম্যাডাম বলতে হয়। আমাদের চাকরিতে নিয়ম-কানুন আছে। অবশ্যই আমাকে ‘স্যার’ বা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করতে হবে। অন্য কারোর সঙ্গে আমাকে বিবেচনা করা যাবে না। এদিকে, বেড়ায় কর্মরত একাধিক সাংবাদিক জানান, সমপ্রতি জাতীয় দৈনিক বাংলা খবর প্রতিদিনের সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা খানমকে আপা বলায় চরম ক্ষিপ্ত হয়ে আশালীন আচরণ করেন।

৩. ‘দিদি’ ডাকায় লাথি দিয়ে দোকানির মাছ ড্রেনে ফেলে দিলেন এসিল্যান্ড : ‘দিদি’ ডাকায় লাথি দিয়ে মাছ বিক্রেতার মাছ ড্রেনে ফেলে দিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি)। ঘটনাটি ঘটেছে গত ১২ মে  সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। এদিন সকালে এসিল্যান্ড কার্যালয়ের গেটের পাশে বসে মাছ বিক্রি করছিলেন কয়েকজন মাছ বিক্রেতা। এ সময় গাড়ি নিয়ে অফিসে প্রবেশ করছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকার। অফিসের প্রবেশ পথে গাড়ি থামিয়ে দেন সঞ্চিতা কর্মকার। গাড়ির ভেতরে বসেই এক ব্যবসায়ীকে মাছের ঝুড়ি সরাতে বলেন। এ সময় লায়েক আহমেদ নামের এক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, ??দিদি সরিয়ে নিচ্ছি। আর এ কথা শোনার পরেই ক্ষেপে যান এসিল্যান্ড সঞ্চিতা কর্মকার। গাড়ি থেকে নেমে বলেন, ‘আমি কিসের দিদি! এর পরই লাথি দিয়ে লায়েক আহমেদ ও তার সঙ্গী হাসান মিয়ার মাছের ঝুড়ি পাশের ড্রেনে ফেলে দেন।

৪. ঢাকার ধামরাই বাজার শাখার কৃষি ব্যাংক কার্যালয়ে ম্যানেজারকে ‘স্যার’ না বলায় এক সেবাগ্রহীতার সাথে দুর্ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ধামরাই বাজার কৃষি ব্যাংক শাখায় ব্যাংক ম্যানেজার সোহরাব জাকিরের কক্ষে গিয়ে তার কাছে জানতে চান— একটি গবাদিপশুর খামারের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে কি কি কাগজপত্রাদি লাগবে। এ সময় জাকির হোসেন ব্যাংক ম্যানেজার সোহরাব জাকিরকে দুইবার ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। আর এতে সোহরাব জাকির ক্ষিপ্ত হয়ে জাকিরের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেন। এতে ম্যানেজারের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডার সৃষ্টি হয় জাকিরের। একপর্যায়ে জাকিরকে ব্যাংক থেকে বের করে দেন ম্যানেজার।

৫. টাঙ্গাইলের ঘাটাইালে ‘স্যার’ সম্বোধন না করায় সংবাদকর্মীদের ওপর এক চিকিৎসক ক্ষিপ্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘাটাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ ঘটনা ঘটে। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না, এ ধরনের অভিযোগসহ নানা অভিযোগ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে যান সংবাদকর্মীরা। এ সময় মেডিকেল অফিসার ডা. শুভময় পাল তার কক্ষে তাদের ডেকে নেন।

সংবাদকর্মীদের অভিযোগ, ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার সময় তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করায় ক্ষিপ্ত হন তিনি। এ সময় সাংবাদিকদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অশালীন মন্তব্যও করেন এই চিকিৎসক।

৬. ‘ভাই’ সম্বোধনে সাংবাদিকের ওপর ক্ষেপলেন দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফি উল্লাহ। একটি সংবাদের প্রয়োজনীয় তথ্য নেয়া শেষে কল কেটে দেয়ার সময় ‘স্যার’ না ডেকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করায় স্থানীয় এক সাংবাদিকের উপর বেজায় ক্ষেপেছেন সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের দায়িত্বরত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফি উল্লাহ। তখন ওই প্রতিবেদক বলেন, ‘আমরা তো ডিসি সাহেবকেও শ্রদ্ধা রেখেই ভাই বলে সম্বোধন করি।’ তখন ইউএনও শফি উল্লা বলেন, ‘ডিসি সাহেবকে ডাকছেন ডাকেন। কিন্তু আমাকে ভাই ডাকা যাবে না।’

৭. ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করায় প্রতিদিনের সংবাদের কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি আকিব হূদয়কে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউসের সামনে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা জুলহাস হোসেন সৌরভ। এ সময় তার সাথে ছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওবায়দুর রহমান সাহেল, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর মাহমুদুল হাসান, মো. ইব্রাহিম। এর আগে সাংবাদিক আকিব হূদয়কে তারা আটক করে পুলিশের গাড়িতে করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে সেখানে একটি রুমে আবদ্ধ করা হয় এবং গালাগালি ও খারাপ আচরণ করা হয়।

৮. ইউএনওকে ‘স্যার’ না বলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করেছেন নেত্রকোনা জেলা কলমাকান্দা থানার অফিস ইনচার্জ মাজহারুল ইসলাম। কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরবাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।

৯. বরিশালের বাউফলে ‘স্যার’ না বলায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন এক সিভিল সার্জন। এ সময় তিনি সাংবাদিককে বলেন, ‘আমি আপনার ভাই হলাম কিভাবে? আমাকে ‘স্যার’ বলেন। ডিসি-এসপিকে তো ঠিকিই ‘স্যার’ বলেন, আমাকেও ‘স্যার’ বলেন? আপনাকে তথ্য দিতে আমি বাধ্য নই। তথ্য দেবো সরকারকে।’ —এই বলে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন পটুয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম।

১০. ‘স্যার’ না বলায় তথ্য দেয়নি ঝিনাইদহ কৃষি অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পাপিয়া খাতুন। এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনারা কী আমাদের ‘স্যার’দের ভাই বলা শুরু করে দিয়েছেন? ভাই, ভাই বলেন কেন। ‘স্যার’ বলতে পারেন না? আপনারা এ অভ্যাস শুরু করেছেন কেন?’ তথ্য চাইতে গেলে ক্ষেপে গিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলেন ঝিনাইদহ কৃষি সমপ্রসারণ অধিপ্তরের জেলা অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পাপিয়া খাতুন। অভিযোগ রয়েছে, তথ্য চাইতে গেলে তিনি বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের হয়রানি করেন।

১১. গত ১২ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসককে ‘স্যার’ না ডেকে ‘দাদা’ বলে ডাকায় ব্রেন স্ট্রোকের রোগীকে চিকিৎসা না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এরপর চিকিৎসার অভাবে রোগী মারা গেছেন বলে দাবি স্বজনদের। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তার অমিতকে ‘দাদা’ সম্বোধন করে চিকিৎসার কথা বললে তিনি বলেন, ‘সবাই আমাকে ‘স্যার’ বলে ডাকেন কিন্তু আপনি আমাকে দাদা বললেন কেন?’

১২. যশোরের অভয়নগর উপজেলা কৃষি সমপ্রসারণ কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না বলে ভাই বলে সম্বোধন করায় চার সাংবাদিককে অফিস থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ এসেছে। উপজেলা কৃষি অফিসে এই ঘটনা ঘটে। ওই কর্মকর্তার নাম আব্দুস সোবহান। এ ঘটনায় অভয়নগরে সাংবাদিকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

১৩. ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করায় কক্সবাজার শহরের এক চাল ব্যবসায়ীকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন সদরের এসিল্যান্ড মং। এ ঘটনায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টায় শহরের চালবাজার এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটে।

আমারসংবাদ/জেআই