Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

অতিকথনে তোলপাড় রাজনৈতিক মাঠ

আগস্ট ৪, ২০২১, ০৮:০৫ পিএম


অতিকথনে তোলপাড় রাজনৈতিক মাঠ
  • বয়সভেদে টিকার ঘোষণা দিয়ে ২৪ ঘণ্টা না যেতেই প্রত্যাহার করলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী
  • বয়সভেদে টিকার খবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নয় —স্বাস্থ্যমন্ত্রী, জাহিদ মালেক
  • ৮ বছরের ঊর্ধ্বদের টিকা দেয়া নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি —ড. হাছান মাহমুদ   যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
  • এটি অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শী এবং সমন্বয়হীনতার বহিঃপ্রকাশ —জি এম কাদের বিরোধীদলীয় উপনেতা
  • জনগণের চাহিদার ভাষা বুঝছেন না মন্ত্রীরা —মুজাহিদুল ইসলাম, সভাপতি, সিপিবি 
  • সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে —গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, মহাসচিব, ন্যাপ
  • মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বক্তব্য হাস্যকর —এমরান সালেহ প্রিন্স, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএনপি

২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রত্যাহার! মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বক্তব্য। এ নিয়ে রাজনৈতিক বাজার গরম। রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, মন্ত্রীর বক্তব্য হাস্যকর ও অবাস্তব। বক্তব্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে প্রমাণ হলো, সরকারের ভেতর সমন্বয়হীনতা চলছে। দেশে ১৮ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে জনসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি, আর সরকারের টিকার ব্যবস্থা এ পর্যন্ত হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি। এর মধ্যে ১১ আগস্টের মধ্যে সরকার ১২ কোটি মানুষের টিকার ব্যবস্থা করতে পারবে কি-না তা নিয়ে এখনো বড় প্রশ্ন রয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে বিধায় অভিজ্ঞানসম্মত কথাও রাজনৈতিক বাজারে বলে দেয়া হচ্ছে। সরকার বারবার ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ জন্য জনগণের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তালগোল পাকিয়ে কথা বলছে। জনগণও এই সরকারের কোনো কথা শুনছে না।

অনেকে এ-ও বলছেন, কোভিড টাস্কফোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, টিকা কর্মসূচিতে বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে টিকা কর্মসূচিতে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। সারা বিশ্ব যখন টিকা দিয়ে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করছে, মনে হচ্ছে তখন টিকা দিতে ব্যর্থতার দায় এড়াতে উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর ১৮ বছরের বেশি বয়সি নাগরিকদের টিকা না নিয়ে চলাচল ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ হবে জানিয়ে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছিল তা প্রত্যাহার করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

গতকাল বুধবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সকল নাগরিককেই পর্যায়ক্রমে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তবে ‘টিকা নেয়া ছাড়া ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কেউ ১১ আগস্টের পর থেকে বাইরে বের হতে পারবে না’ মর্মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মন্ত্রীর যে বক্তব্য প্রচার হয়েছে, বক্তব্যের সে অংশটুকু প্রত্যাহার করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

এর আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের হুঁশিয়ারি নিজেদের বক্তব্য নয় জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মাইদুল ইসলাম প্রধান বিভিন্ন গণমাধ্যমের ‘জরুরি দৃষ্টি আকর্ষণ’ করে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের নিউজ স্ক্রলে ‘টিকা নেয়া ছাড়া ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কেউ বাইরে বের হতে পারবে না’ বলে যে সংবাদটি প্রচার হচ্ছে তা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়নি। ‘দ্রুতই ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সবাইকেই ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোথাও দেয়া বা নেয়া হয়নি বলেও জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। কোভিড পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও পরবর্তী করণীয় নিয়ে মঙ্গলবার সচিবালয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে করোনা ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে চলমান লকডাউনের সময়সীমা আরও পাঁচদিন বাড়িয়ে ১০ আগস্ট পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, ‘১১ আগস্ট থেকে ১৮ বছরের ওপরের কোনো মানুষ ভ্যাকসিন ছাড়া মুভমেন্ট করলে সেটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। রাস্তাঘাটে, গাড়িঘোড়ায়, মোটরসাইকেল, সাইকেল, টেম্পু, বাস বা ট্রেনে হোক, চলাচল করলে টিকা নেয়া থাকতে হবে।’

এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বক্তব্য সরকারের ‘অপরিকল্পনা, অদূরদর্শিতা এবং সমন্বয়হীনতার’ ফল বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘টিকা না নেয়া ১৮ বছরের বেশি বয়সের কেউ বের হলেই নেয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, গতকাল মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রীর এমন ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মাথায় স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রণালয় এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে বিবৃতি দিয়েছে। অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শী এবং সমন্বয়হীনতার কারণে বারবার এমন ঘটনা ঘটছে। মন্ত্রীদের বক্তব্যে বিভ্রান্ত হচ্ছেন দেশবাসী। একই সঙ্গে সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে সাধারণ মানুষ।’

বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের তার বিবৃতিতে বলেন, ‘১১ আগস্ট থেকে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স, অথচ টিকা নেয়নি এমন কেউ বাইরে বের হলেই নেয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা— সরকারের এমন সিদ্ধান্ত শুধু অযৌক্তিক, অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য নয়, এটি পুরোপুরি হাস্যকর। বর্তমান বাস্তবতায় দেশে দুই ডোজ টিকা নেয়া মানুষের সংখ্যা এক কোটির নিচে। কোভিড টাস্কফোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, টিকা কর্মসূচিতে বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে টিকা কর্মসূচিতে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। সারা বিশ্ব যখন টিকা দিয়ে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করছে, মনে হচ্ছে তখন টিকা দিতে ব্যর্থতার দায় এড়াতে উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার।’

জিএম কাদের বলেন, ‘এখন টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়সসীমা ২৫ বছর নির্ধারিত। সে ক্ষেত্রে কীভাবে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সি গার্মেন্ট শ্রমিক কারখানায় যাবে? এই বয়সের গণপরিবহনের শ্রমিক কীভাবে কাজে বের হবে? অথবা এই বয়সি দোকানি কীভাবে দোকান খুলবে? করোনার টিকা গ্রহণ ছাড়া কেউ বইরে বের হলে শাস্তি হবে কি-না, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘সরকারের এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মাস্ক পরার ওপর এবং সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দেয়া হয়েছে এবং মাস্ক না পরলে যাতে শাস্তি দেয়া সে জন্য পুলিশের ভূমিকাকে আরো কার্যকর করা প্রয়োজন বলেও মঙ্গলবারের সভায় সকলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।’

বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ‘১১ আগস্ট থেকে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কেউ টিকা গ্রহণ না করে বাইরে বের হলে শাস্তির যে বিধানের কথা সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা ছিলো তা হাস্যকর ও অবাস্তব। আর সকালেই মন্ত্রী এই বক্তব্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে প্রমাণ করলেন, সরকারের ভেতর সমন্বয়হীনতা চলছে। যে যার দায়িত্ব পালন করছেন না। না ভেবেই দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলছেন।’ তিনি বলেন, ‘দেশে ১৮-এর ঊর্ধ্বে জনসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি, আর সরকারের টিকার ব্যবস্থা এ পর্যন্ত হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি। এর মধ্যে ১১ আগস্টের মধ্যে  সরকার ১২ কোটি মানুষের জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে পারবে কি-না তা না ভেবেই কথা বলেছেন তিনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দায়িত্বপ্রাপ্তদের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে অথবা প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্যই এসব কথা বলছেন তারা।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আমার সংবাদকে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা এই সরকারের দায়িত্বহীনতায় উঠে এসেছে। এ সরকার করোনা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ। দেশে লুটেরাদের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ জন্যই তারা আবোল-তাবোল বলছে। জনগণের চাহিদার জনগণের ভাষা তারা বুঝছে না।’

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স আমার সংবাদকে বলেছেন, ‘এই সরকার শুরু থেকে অদূরদর্শিতা সমন্বয়হীনতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। তারা বারবার জনগণের সেবা ও সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বারবার ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ জন্য জনগণের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। মানুষ হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেও সিট পাচ্ছে না। আইসিউ খালি নেই। হাসপাতালে টেকনোলজিস্ট নেই। পরীক্ষা হচ্ছে না যথাযথভাবে, মানুষ পথে মারা যাচ্ছে। সরকার দায়িত্বহীনতা উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন। এটা হাস্যকর, অবাস্তব ছাড়া আর কিছুই নয়। এরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় তারা তালগোল পাকিয়ে কথা বলছেন। এ জন্য জনগণও এই সরকারের কোনো কথা শুনছে না।’

আমারসংবাদ/জেআই