Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বঙ্গমাতা : সংকটে সংগ্রামে নির্ভীক সহযাত্রী

মো. কামাল হোসেন

আগস্ট ৭, ২০২১, ০৬:১৫ পিএম


বঙ্গমাতা : সংকটে সংগ্রামে নির্ভীক সহযাত্রী

‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের জন্য কাজ করাই আপনার সবচেয়ে বড় বিষয়। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজে যান। আল্লাহর ওপর আমার ভার ছেড়ে দিন।’ এই নির্ভয় বাণী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি শুনিয়েছিলেন- তিনি তার সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় নিজের ঘরের আসবাবপত্র, অলংকার বিক্রি করেও দল ও নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন যিনি, তিনি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। একজন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন তিনি। তার বাড়িতে কোনো বিলাসী আসবাবপত্র ছিলো না, ছিলো না কোনো অহংবোধ। সন্তানদের যেমন ভালোবেসেছেন, তেমনি শাসনও করেছেন। পালন করে গেছেন পিতা-মাতা উভয়েরই কর্তব্য। কোমল-কঠোরে মিশ্রিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই সাহসী নারী স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছেলেমেয়েদের যোগ্যরূপে গড়ে তোলেন।

বেগম মুজিব বিরূপ পরিস্থিতিতেও ছিলেন অবিচল, নিয়েছেন সঠিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত। দেশের মানুষের জন্য স্বামীর ত্যাগ ও সংগ্রামে নিরন্তর সহযোগিতা করেছেন, যা সত্যিই অনন্য। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তার ভাবনা ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে আছে। স্বামীর প্রতি বেগম মুজিবের ছিলো অগাধ বিশ্বাস। তারা একে অপরের আত্মা হয়ে থেকেছেন, কাজ করেছেন। দুজনের তীব্র ভালোবাসা ছাপিয়ে দেশের মানুষের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রাধান্য পেয়েছে আমৃত্যু।

১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ফজিলাতুন্নেছা। তার বাবার নাম শেখ জহুরুল হক ও মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। দাদা শেখ আবুল কাশেম নাতনির নাম রাখেন ফজিলাতুন্নেছা। ফুলের মতো গায়ের রঙ বলে মা হোসনে আরা ডাকতেন রেণু বলে। এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। শৈশবে মা-বাবাকে হারানোর পর ফজিলাতুন্নেছা বেড়ে ওঠেন দাদা শেখ কাশেমের কাছে। সম্পর্কে তিনি জাতির পিতার আত্মীয় হতেন। খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয় বঙ্গমাতার। শেখ বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি ও দেবর-ননদের সঙ্গেই বেড়ে ওঠেন তিনি।

মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবা, জওহরলাল নেহরুর স্ত্রী কমলা ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে ‘বঙ্গমাতা’ অভিধায় ভূষিত করেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান।

২০১৭ সালের ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার জন্মদিন জাতীয়ভাবে পালনের সুপারিশ করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের পর বঙ্গমাতার জন্মদিন জাতীয়ভাবে পালন হয়ে আসছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবারই প্রথম বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হচ্ছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বঙ্গমাতা সংকটে সংগ্রামে নির্ভীক সহযাত্রী’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার পেছনে মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার অনন্যসাধারণ ভূমিকা ছিলো। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে পর্দার অন্তরালে থেকে তিনি পরামর্শ, সাহস, অনুপ্রেরণা ও সব কাজে সহযোগিতা দিয়ে গেছেন। বঙ্গমাতার অবদান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : ‘রেণু খুব কষ্ট করতো; কিন্তু কিছুই বলতো না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখতো, যাতে আমার কষ্ট না হয়।’

[media type="image" fid="136034" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ প্রেক্ষাপটে নেপথ্যে থেকে বেগম মুজিব অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি দুঃসময়ে প্রেরণা জুগিয়েছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী হয়ে তার প্রতিটি কাজে প্রেরণার উৎস হয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে জাতির পিতার সঙ্গে বুলেটের নির্মম আঘাতে জীবন দিতে হয়েছে বঙ্গমাতাকেও।

বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিবকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। দেশের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে পরিবারের জন্য বিশেষ করে নিজের স্ত্রীকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেননি। স্ত্রীর প্রতি জাতির পিতার ভালোবাসার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তার বিভিন্ন লেখায়। তিনি লিখেছেন : ‘রেণু তো নিশ্চয় পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে; কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’ সারা জীবন শেখ মুজিবকে আগলে রেখেছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বেগম মুজিবের গভীর ভালোবাসার কথাও উঠে এসেছে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায়। বিদায় দেয়ার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : ‘রেণু আমাকে বিদায় দেয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিল। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমো দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবার তো কিছুই আমার ছিলো না, সবই তো ওকে বলেছি।’

বঙ্গবন্ধু বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন; কিন্তু ভেঙে পড়েননি বেগম মুজিব। সব সময় জাতির পিতাকে সাহস জুগিয়েছেন। পরিবারের সদস্য ও দলের নেতাকর্মীদের আশ্রয়স্থল ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। হামলা-মামলা, বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়ে বেগম মুজিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিলো। শেখ মুজিব যখন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে নেতাদের সঙ্গে বসতেন, বেগম মুজিব সব সময় খেয়াল রাখতেন কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তিনি সময়মতো তার মতামত দিতেন; কিন্তু কখনও তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতেন না। তিনি তার বার্তাটি বঙ্গবন্ধুকে পৌঁছে দিতেন।

মায়ের জন্মদিন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অসহযোগ আন্দোলনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি দেখেছি মায়ের দৃঢ় ভূমিকা।’

বঙ্গবন্ধু জীবনে যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন, সবটাতেই বঙ্গমাতা তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন, সাহায্য করেছেন। তার উৎসাহে বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসেই লেখেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’। জাতির পিতার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক অজানা ইতিহাসের সম্ভার এ গ্রন্থ দুটি।

বঙ্গমাতার ভূমিকা নিশ্চয়ই ইতিহাস মনে রাখবে। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন,‘৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কী বলবেন- তা নিয়ে যখন অনেক আলোচনা, সেই ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন আমার মা। বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে আমার মাকে দেখেছি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি তিনি নিতে পারতেন। ৭ মার্চের ভাষণের সময়ও মা বলেছিলেন- তুমি সারাটা জীবন মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছো। তুমিই সবচেয়ে ভালো জানো কী বলতে হবে। তোমার মনে যা আছে, তা-ই বলো।’ বঙ্গবন্ধু সে কথাই বলে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণ। তিনি তার মনের কথাগুলো বলেছিলেন বলে আজ এটি শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছেছে। ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এ ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের আগে তিনি ঘোষণা করেন এদেশের স্বাধীনতা। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব বিলাসী জীবনে ফিরে যেতে পারতেন; কিন্তু নিজেদের ৩২ নম্বরের বাড়িতেই থেকে যান তারা। সারা জীবন ছায়ার মতো স্বামীর পাশেই ছিলেন বঙ্গমাতা। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি বলেছিলেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছো, আমাকেও মেরে ফেলো।’

প্রচারবিমুখ মহীয়সী নারী শেখ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। একটি স্বাধীন দেশের ইতিহাসের সঙ্গে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জাতির পিতার দীর্ঘ সংগ্রামে অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি ক্রমেই হয়ে উঠেছেন রেণু থেকে বঙ্গমাতা।

তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবন সংগ্রাম, শেখ মুজিবুর রহমানের কারাবাসকালে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংগঠিত করা এবং তার দেশপ্রেমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের আরও বেশি কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

সম্প্রতি সরকার ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ পদক প্রবর্তন করেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া, সমাজসেবা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য এ বছর (২০২১ সাল) থেকে পাঁচ বাংলাদেশি নারীকে এই পদক প্রদানের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। ৮ আগস্ট বঙ্গমাতার জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীতদের হাতে পদক, সনদ ও শুভেচ্ছা স্মারক তুলে দেবেন। ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ পদকটি নারীদের জন্য ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক হিসেবে গণ্য হবে। মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মদিনে তার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা।

লেখক : পিআরও, খাদ্য মন্ত্রণালয়

আমারসংবাদ/জেআই