Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রাথমিক চিকিৎসার রোল মডেল কমিউনিটি ক্লিনিক

মাহমুদুল হাসান

আগস্ট ৯, ২০২১, ০৬:০৫ পিএম


প্রাথমিক চিকিৎসার রোল মডেল কমিউনিটি ক্লিনিক

সুবিধাবঞ্চিতদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা। এখন প্রায় ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে ক্লিনিক গড়ে তোলা হচ্ছে। যেখানে চিকিৎসা ও ওষুধ বিনামূল্যে মিলছে। গ্রামের মানুষের ভরসাস্থল কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রায় চৌদ্দ হাজার ক্লিনিকে প্রতিদিন চার লাখের বেশি মানুষ পাচ্ছেন পরিবার পরিকল্পনা সেবা, পুষ্টিসেবা, কিশোর-কিশোরী, মা ও শিশুসহ বয়স্কদের নানা রোগের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা। ক্লিনিকে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগ শনাক্ত করা হয় এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে (এনসিডি কর্নার) পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে এটি অন্যতম। একজন কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রভাইডার বা সিএইচসিপি এই কমিউনিটি ক্লিনিকের মূল দায়িত্ব পালন করে থাকেন সপ্তাহে ছয় দিন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত।

প্রথমে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকল্পটি পরিচালনা করা হলেও ২০১৮ সালের নতুন আইনের মাধ্যমে এই কমিউনিটি ক্লিনিক এখন চলছে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের আওতায়। সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৮ শতাংশ জমিতে চার কক্ষবিশিষ্ট নতুন নকশায় কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছে। ১০৬টি উপজেলার প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক কর্ম এলাকায় পাঁচ থেকে সাতজন করে মোট ২৪ হাজার মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ার (এমএইচভি) নির্বাচন করা হয়েছে। থানা পর্যায়ের স্বাস্থ্য তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিটি নাগরিকের জন্য হেলথ আইডি প্রদান কার্যক্রম ৯টি উপজেলায় সম্পন্ন হয়েছে পর্যায়ক্রমে সারা দেশে হেলথ আইডি প্রদান করা হবে। সরকারের এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্য খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

অনেকের দাবি— কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এক অনন্য বিপ্লব ঘটিয়েছে। ক্লিনিকের সাফল্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পুস্তিকার নাম কমিউনিটি ক্লিনিক-হেলথ রেভল্যুশন ইন বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে সেখানকার কমিউনিটি যত বেশি সংযুক্ত ও সক্রিয় হয় ততই সেই ক্লিনিক থেকে মানুষ বেশি সেবা পায়। কমিউনিটির লোকজন আগের তুলনায় অনেক বেশি বুঝতে শিখেছে যে এই ক্লিনিক সরকারের নয়, বরং তারাই এর মালিক। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদেরই বেশি, সরকার তাদের কিছুটা সহায়তা দিচ্ছে মাত্র। কমিউনিটি ক্লিনিক সক্রিয় থাকা মানে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যকর হবে সহজে। এমন বিষয়গুলো আকৃষ্ট হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে। কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম আজ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক প্রশংসিত হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টিস্তর উন্নয়ন, জীবনমান বৃদ্ধি ও সার্বিক জনস্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৩ হাজার ৮৮১টি ক্লিনিক চালু রয়েছে। এসব ক্লিনিক থেকে দৈনিক গড়ে ৩০-৪০ জন রোগী প্রাথমিক সেবা গ্রহণ করছে। আর ১৪৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৯৫ লাখ মানুষ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকে। কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হওয়ার পর থেকে ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর চাপ কমে গেছে।

কমিউনিটি ক্লিনিক : বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব শিরোনামের এক প্রতিবেদনে সরকার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই যৌথ প্রতিবেদনে ২০১৩ সালের ১২ জুন কমিউনিটি ক্লিনিকের জননী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে তিনি তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধারণা ও চিন্তার সমপ্রসারণ করেছে মাত্র। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তার চিন্তা ও পরিকল্পনাগুলো আমি তার কাছ থেকেই শুনতাম। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কীভাবে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায়, সেটা নিয়ে তিনি প্রায়ই ভাবতেন। এ নিয়ে তার ভাবনাগুলো তিনি আমাকে বলতেন। পরে ওই চিন্তা-ভাবনাগুলোই আমি বিস্তৃত করেছি এবং বাস্তবে রূপায়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্লিনিক এখন বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আলমাআটায় অনুষ্ঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানে ‘২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ এই বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। তারপর থেকে বিভিন্ন দেশে কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের নানা উদ্যোগ নেয়া শুরু হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় আসলে, শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠনের পর প্রথমে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রতি ছয় হাজারের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। প্রাথমিকভাবে ১৩ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, পরে ২৬ এপ্রিল ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রথম শুভ সূচনা করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশে ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিকের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল। তার মধ্যে চালু হয়েছিল প্রায় চার হাজার। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশের মানুষ স্বাস্থ্যসেবার মতো অন্যতম মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর সরকার গঠন করলে আবার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম শুরু হয়। নতুন নতুন ভবন নির্মাণের মাধ্যমে গত ১২ বছরে মোট ১৩ হাজার ৮৮১টি কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু করা হয়। ২০২২ সালের মধ্যে অসমাপ্ত প্রায় চার হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করতে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

সিবিএইচসির তথ্যানুয়ায়ী, ২০০৯-২০১৭ সাল পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬১ কোটি ৫০ লাখ, ক্লিনিক থেকে জরুরি এবং জটিল রোগী রেফারের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ ৪৮ হাজার, স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩০৯টি, গর্ভবতী মায়ের প্রসব পূর্ববর্তী সেবা (এএনসি) ২৩ লাখ, ৮৬ হাজার ২০৪টি, প্রসব-পরবর্তী সেবা (পিএনসি) আট লাখ, ১১ হাজার ৬৬৩টি।

দেশব্যাপী সরকারের এই মহৎ উদ্যোগ কতটুকু কার্যকরী, যাদের জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হলো তারা সন্তুষ্ট কি-না, তা নিয়ে একাধিক মূল্যায়ন হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন বিভাগ ২০১৩ সালে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৮২ শতাংশ জনগোষ্ঠী সেবা নিয়ে থাকে। ক্লিনিকগুলো বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এবং বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়া যায় বলে মানুষ এখানে সেবা নিতে আগ্রহী। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) জরিপে জানা যায়, বাড়ির পাশের ক্লিনিক থেকে বিনামূল্যে ওষুধ ও পরামর্শ পেয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। জাতীয় রোগ প্রতিরোধ এবং সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) জরিপে উঠে এসেছে, ক্লিনিকের সেবা নিয়ে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। বিশ্ব সমপ্রদায়ের কাছে কমিউনিটি ক্লিনিক আজ প্রশংসিত। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক বাংলাদেশ সফরের সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে দেখেছিলেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় গ্রামপর্যায়ে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের এই ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার ও একটি বড় সাফল্যের দৃষ্টান্ত। সিএইচসিপিরা সপ্তাহে ছয়দিন ক্লিনিকে ডিউটি করেন। তাকে সহায়তা করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী। তারা তিনদিন করে ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবা প্রদান করেন।

আমারসংবাদ/জেআই