Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন

এম মজিবুর রহমান

আগস্ট ১০, ২০২১, ০৬:৩০ পিএম


বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন
  • বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আদর্শ ছিল জোটনিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা। সমগ্র বিশ্বের, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের প্রতি বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সমর্থন জানিয়েছেন। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনগণ বহু বাধাবিপত্তি জয় করে অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আমাদের প্রত্যাশা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবেন। যেখানে বিরাজ করবে শান্তি, থাকবে না দুর্নীতি, দারিদ্র্য, ক্ষুধা আর সব নাগরিক অধিকার থাকবে সুনিশ্চিত

১৯৬৯ সাল। আমরা তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। স্কুল হতে বের হয়ে আমাদের সিনিয়রদের সাথে স্লোগানে যেতাম- ‘জেলের তালা ভেঙেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি’। তিনি কে বা কি করেন, কেন জেলে গেলেন- সবই অজানা। শুধু জানা ছিল পাকিস্তানিরা আমাদের সব সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে, চাকরি দেয় না। সে জন্য আমরা লড়াই করব, তাদের খেদাতে হবে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব লাভ করেন- যা আমরা পরে পাশের বাড়ির এক ভাই থেকে জেনেছি। তিনি এসে বললেন, শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, এসো আমরা স্লোগান দিই- ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধ’। আমরা গ্রামের রাস্তায় নেমে পড়লে অনেকেই তাতে শামিল হতেন। আমরা অনেক সময় স্লোগানের জন্য অপেক্ষা করতাম। আমার বয়স স্বাধীনতার সময় ১০ বছর। আমি সবে ক্লাস ফাইভে উঠেছি। যুদ্ধ লেগে গেল। ১৫ বছরের ওপরে বয়সী আমাদের গ্রামের অনেকে রাতের অন্ধকারে মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণে চলে গেছেন। অনেকের মা নিজে আদেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন; কারণ রাজাকাররা ১৫-৪০ বছরের লোকদের তালিকা পাকসেনাদের হাতে তুলে দিয়েছে। তারা এ বয়সের সবাইকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলতো। বর্ষাকাল, খাল দিয়ে কত লাশ ভেসে যেতে দেখেছি। অনেক দেখা স্মৃতি রয়েছে মানুষের মুক্তির যাত্রার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান নিয়ে যখন কটাক্ষ করা হয়, তখন কষ্ট হয়। এ বছর তার জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আমাদের বাংলাদেশ সৃষ্টির মুহূর্ত এবং সেই সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর অনন্য ভূমিকার কথা একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমরা যারা বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে আবির্ভূত হতে দেখেছি, তার পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে অসামান্য অবদান রয়েছে- তা প্রত্যক্ষ করেছি। বিরোধী পক্ষকে বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ড ও তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার মূল্যায়ন করা অত্যন্ত কঠিন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন করেন এই ভেবে যে, এই নতুন রাষ্ট্রে দরিদ্র মুসলমান ও কৃষকরা জমিদার আর মহাজন শ্রেণির নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে। আমরা দেখতে পাই, ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের লোকদেরই উদ্ধার করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু বাঙালির বিভিন্ন অধিকার আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন; ফলে বারবার কারাবরণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর হতে স্বাধীনতার জন্য তিনি তৈরি হচ্ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ‘উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে’- এর প্রতিবাদে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তাকে জেলে রাখা হয়। ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর সামরিক শাসনামলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি টানা ১৪ মাস জেলে ছিলেন। ১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এ সময় আলোড়িত ব্যক্তি হিসেবে তিনি সবার হূদয়ে স্থান করে নেন। ১৯৬১ সালের ১ মে আমার জন্ম। বাবা-মা এই মহান নেতার নামে আমার নাম রাখেন মজিবুর রহমান। ১৯৬২তে আবার তিনি গ্রেপ্তার হন জননিরাপত্তা আইনে এবং মুক্তি পান ১৮ জুন। ১৯৬৩ সালে তিনি পরামর্শের জন্য লন্ডনে অসুস্থ সোহরাওয়ার্দী স্যারকে দেখতে যান। সে বছরই ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী স্যার মারা যান। ১৯৬৪ সালে আইউববিরোধী আন্দোলনের জন্য আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৫ সালে তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্যের কারণে এক বছরের জন্য আবারও কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি, যা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত, তা নিয়ে তিনি দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং একই বছর ৮ বার জেলে যান। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৯ সালে ৬ দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফা রাওয়ালপিন্ডিতে আইউব খানের গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থাপন করেন। একই বছরের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবস পালন অনুষ্ঠানে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ বলে ঘোষণা করেন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ আসন পেয়েও ক্ষমতায় যেতে দেয়া হয়নি। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’-এর মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে আহ্বান জানান। এ জন্য ২৫ মার্চ রাত ১.৩০ মি. তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৩ দিন পর তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে কারাবাস দেয়া হয়। পাকিরা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসেন। টানা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে স্থান দেয়ার জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।

জাতির দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে একদল বিভ্রান্ত সেনা হত্যা করে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১- এই ২৪ বছরে তার নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন ক্রমাগত বেগবান হয়েছে; কিন্তু তিনি সব সময়ই শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই ছিলেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুন্দরভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে একই সঙ্গে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন হিসেবে সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। শান্তি, মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়তে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘প্রথমে মানুষ এবং তারপর বাঙালি। একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি।

একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।’ এই অনবদ্য উক্তি নিরন্তর ভালোবাসা মানুষের জন্য। মানুষের জন্য ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডের প্রেরণা এবং মানুষের কল্যাণই ছিল তার কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য। এই মানবিক মূল্যবোধই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে, যা প্রতিফলিত হয় তার বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে; যেমন- গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতন্ত্র। তিনি বলতেন, তার সারা জীবনের স্বপ্ন হচ্ছে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর আকাঙ্ক্ষা খুব ছোটবেলা থেকেই আমরা বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ করি। তার রাজনৈতিক সচেতনতার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল দরিদ্র, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি। তিনি ধর্মের অপব্যাখ্যা, ধর্মের নামে সহিংসতা, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রভাবেই গঠিত হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, যার মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বশান্তি ও আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। ‘সবার সঙ্গে মৈত্রী, কারও সঙ্গেই বৈরিতা নয়’- এ-ই ছিল তার পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আদর্শ ছিল জোটনিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা। সমগ্র বিশ্বের, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের প্রতি বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সমর্থন জানিয়েছেন।

বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনগণ বহু বাধাবিপত্তি জয় করে অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আমাদের প্রত্যাশা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবেন। যেখানে বিরাজ করবে শান্তি, থাকবে না দুর্নীতি, দারিদ্র্য, ক্ষুধা আর সব নাগরিক অধিকার থাকবে সুনিশ্চিত।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, নাইস ফাউন্ডেশন, খুলনা

(তথ্য উৎস : ইন্টারনেট, অসমাপ্ত আত্মজীবনী)

আমারসংবাদ/জেআই