Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪,

টিকা নিয়ে বৈষম্য

আগস্ট ১২, ২০২১, ০৯:২৫ পিএম


টিকা নিয়ে বৈষম্য
  • ডিএনসিসির ৬০ ও ২৬ নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের লোক ছাড়া অন্যদের বেশির ভাগকেই লাইন থেকে ফিরে যেতে হয়েছে
  • কাউন্সিলরদের সিল পেয়েছেন এমন টিকাপ্রত্যাশীরাই প্রবেশ করতে পারছেন কেন্দ্রের ভেতরে 
  • আগের দিন রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকা মিলছে না অধিকাংশের 
  • দেশের বিভিন্ন স্থানে টিকা সংকট  আবার কাউকে একদিনেই দেয়া হয়েছে দুই ডোজ
  • সাতক্ষীরায় এসএমএস পেয়েও মিলছে না টিকা, অপেক্ষায় আড়াই লাখ টিকাপ্রত্যাশী  

টিকাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ উপেক্ষা করেই রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতাশীন ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য আছে এমন ব্যক্তিরাই পাচ্ছেন করোনার টিকা। অন্যদিকে সাধারণ টিকাপ্রত্যাশীরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও টিকা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও টিকা পাচ্ছেন না অনেকে। দিন যতই যাচ্ছে প্রথম ডোজের গতিও তত কমতে থাকায় টিকার জন্য অপেক্ষার পালা দীর্ঘই হচ্ছে। এদিকে অনেকে নিবন্ধন করে এক মাসেও টিকার ক্ষুদেবার্তা না পাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিদিনই টিকার নিবন্ধনকারীর সংখ্যা ১২ থেকে ১৫ লাখ করে বাড়ছে। নিবন্ধনকারীদের জন্য এই মুহূর্তে প্রায় তিন কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন। অথচ টিকা হাতে আছে মাত্র ৭৭ লাখ ডোজ। ্ন হিসাব করে দেখা যায়, দেশে আড়াই কোটির বেশি টিকার ঘাটতি রয়েছে। এই মাসের মধ্যে টিকার বড় কোনো চালান দেশে না এলে সমস্যায় পড়বেন টিকাপ্রত্যাশী নিবন্ধনকারীরা। সংকট সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে স্বাস্থ্য বিভাগকেও। এরই মধ্যে টিকা নিয়ে উঠেছে বৈষম্যের অভিযোগ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৬০ নং ওয়ার্ডের জনতবাগ হাইস্কুল ও টিঅ্যান্ডটি শহীদ ফরুক উচ্চ বিদ্যালয়ে টিকাপ্রত্যাশী কয়েক যুবক অভিযোগ করে বলেন, কাউন্সিলরের লোকজনদের লাইন থেকে ডেকে নিয়ে টিকা দেয়া হচ্ছে। হ্যান্ডমাইকেও ডেকে নিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ভোররাত থেকেই লাইনে দাঁড়ানো টিকাপ্রত্যাশীরা লাইনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দিন শেষে টিকা না নিয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের। এ ছাড়া দক্ষিণ সিটির ২৬ নং ওয়ার্ডেও ঘটেছে একই ঘটনা। টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন কিন্তু মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা না আসায় কাউন্সিলরের সঙ্গে সখ্য থাকায় সরাসরি কেন্দ্রে চলে যান ওমর ফারুক (ছদ্মনাম) নামে এক যুবক। তিনি বলেন, লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। সরাসরি কেন্দ্রে প্রবেশ করে টিকা নিয়েছেন তিনি। কেন্দ্রে প্রবেশের সময় কাউন্সিলরের রেফারেন্স দিয়েই তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন এবং টিকা গ্রহণ করেন। কিন্তু সকাল থেকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিরা দাঁড়িয়েই আছেন। টিকা মিলছে না। এর আগে রাজধানীর দক্ষিণ কমলাপুরের সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ডাক না পাওয়ার অভিযোগ করছেন টিকাপ্রত্যাশীরা। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, কমিশনারের পরিচিত লোক লাইনে না দাঁড়িয়েই আগে টিকা পাচ্ছেন আর আমরা দিনভর দাঁড়িয়েও ডাক পাইনি। একই অভিযোগ পাওয়া যায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের মালিবাগ চৌধুরীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও। সেখানে বিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে টিকাপ্রত্যাশীদের বড় জটলা। তাদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে হ্যান্ডমাইকে নাম ধরে ডেকে টিকাকেন্দ্রে প্রবেশের অভিযোগ করেন টিকাপ্রত্যাশীরা। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় কাউন্সিলরের স্বেচ্ছাসেবীরা একটি তালিকা তৈরি করেছেন। এ তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তারাই শুধু সেখানে টিকা পাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় কাউন্সিলরের সিলসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি কার্ড) ফটোকপি জমা দিলেই নাম ওঠে ওই তালিকায়। সিল ছাড়া মেলে না সিরিয়াল, এ ছাড়া দেয়া যায় না টিকা। টিকাপ্রত্যাশীরা বলছেন, সরকার এই টিকার নাম দিয়েছে গণটিকা। জনগণ এটা পাবে। কিন্তু এখানে কমিশনারের সিল ছাড়া পাওয়া যায় না। এটা কোনো কথা!

একই অভিযোগ করে আরও কয়েকজন বাসিন্দা জানান, কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে গত দুদিন ঘোরাঘুরির পর তাদের এ সিল মিলেছে। কেউ আবার পরিচিত না থাকায় পাননি। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, পরিচিতরাই পাচ্ছেন এমন সিল। এসব অভিযোগ স্বীকার করে কাউন্সিলরের একজন সহযোগী বলেন, ভিড় ও জটলা এড়াতে এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। অল্প টিকা সবাইকে দেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য বেছে বেছে দেয়া হচ্ছে।

পুরান ঢাকার একটি কেন্দ্রে কেউ কেউ এসেই করোনার টিকা নিতে পারছেন। আবার অনেকে ভোররাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকা না পেয়ে ফিরে গেছেন। এ ঘটনায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর রোকন উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে রোকন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, স্বেচ্ছাসেবীরা পরিবারের সদস্যদের টিকা দিতে চাইলে তিনি বাধা দিতে পারেন না। এই ঘটনা ঘটছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের হাটখোলার মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ কমিউনিটি সেন্টার টিকাকেন্দ্রে। শতাধিক নারী-পুরুষ লাইন ধরে টিকার জন্য অপেক্ষা করছেন। লাইনের অনেকে বলেন, এর আগেও টিকার জন্য এসেছিলেন, কিন্তু না পেয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। টিকা নেয়ার জন্য রাজধানীর বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে রাতে বা ভোরে মানুষকে লাইনে দাঁড়াতে দেখা যায়। তাদের কেউ কেউ টিকা দিতে পারেননি। টিকাপ্রত্যাশী অনেকের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনের লোক এবং টিকাদাতা কর্মকর্তারাও কোনো সহায়তা করছেন না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা।

এদিকে টিকার মজুত না থাকায় অসংখ্য মানুষ টিকা নিতে এসে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় আবার টিকা প্রদানকারীদের ভুলে কেউ কেউ একই সাথে পাচ্ছেন দুই ডোজ টিকা। ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় গতকাল এক বৃদ্ধাকে পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে কোভিড-১৯ এর দুটি টিকা (সিনোফার্মা) পুশ করার ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, ধোবাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকা নিতে এলে উপজেলার ভুট্টা গ্রামের আব্দুর রহিমের স্ত্রী খোদেজা আক্তারকে দুটি টিকা পুশ করা হয়। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খোদেজা আক্তার জানান, প্রথমে একটি টিকা নেয়ার পর আমি বসেছিলাম, শরীর দুর্বল তাই উঠতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে আরেকটি টিকা দেয়া হয়। ধোবাউড়া স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবু হাসান শাহীন জানান, মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তবে আমরা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।

এ ছাড়াও গতকাল সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালেও করোনা টিকার মজুত শেষ হয়ে যাওয়ায় মোবাইলে ম্যাসেজ পেয়েও টিকাদান কেন্দ্র থেকে ফিরে গেছেন টিকাপ্রত্যাশীরা। হতাশ হয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করছেন তারা। সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, টিকা শেষ হয়েছে, বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে। গত ১৩ জুলাই টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন জেলার সদর উপজেলার ফিংড়ি ইউনিয়নের কৃষ্ণপদ সরকার। গতকাল তার দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেয়ার দিন ধার্য ছিলো। তবে হাসপাতালে গিয়ে দেখেন গেট বন্ধ। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, জেলায় প্রথম ধাপে ২১ হাজার ডোজ টিকা এসেছিল। দ্বিতীয় ধাপে আসে এক লাখ ২৪ হাজার ৪০০ ডোজ টিকা। এরই মধ্যে এক লাখ ২৩ হাজার ২৭৮ ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষ রেজিস্ট্রেশন করে টিকার জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছেন।

আমারসংবাদ/জেআই