Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

আগস্ট ১২, ২০২১, ০৯:২৫ পিএম


আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা

ইসলাম সার্বজনীন ও বিশ্ব মানবতার পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায়ও রয়েছে ভারসম্যপূর্ণ উদার আন্তর্জাতিক নীতিমালা। যা বিশ্ব ঐক্য, সংহতি, বিশ্ব শান্তি ও প্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে ইসলামের মূলকথা হচ্ছে সমস্ত মানবজাতি এক আদম (আ.) এবং হাওয়ার (আ.) বংশধর। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে একজন নর ও একজন নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বহু জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো,(হুজুরাত, ৩)। এই আয়াতকে মূলভিত্তি ধরেই ইসলাম আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনার অনুপম নীতিমালা সাজিয়েছে। ইসলাম একমাত্র আন্তর্জাতিক জীবন ব্যবস্থা। পৃথিবীর সব যুগের ও মানুষের জন্য এ হলো এক আভিন্ন জীবন ব্যবস্থা। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ইসলাম একমাত্র মনোনীত জীবন ব্যবস্থা, (সূরা আল-ইমরান, ১৯)। আন্তর্জাতিক জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের বিধান দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে সভ্য ও স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিরাজমান পারস্পারিক সম্পর্ক বোঝায়।  সম্পর্কে সর্বজনগ্রাহ্য স্বতঃসিদ্ধ কোনো সংজ্ঞা দেওয়া বেশ কঠিন। তা সত্ত্বেও বলা যায়, যেসব নিয়মকানুন, বিধিবিধান, মূলনীতি ও সংবিধানের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জাতির পারস্পারিক অধিকার এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের নীতি নির্ধারিত হয় তার আলোকে জাতিসমূহের মধ্যে গড়ে উঠা সম্পর্কই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। আর জীবনব্যবস্থার একটি অনিবার্য বাস্তবতা হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। কেননা পৃথিবীর কোন ব্যক্তি যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তেমনি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় পৃথিবীর কোন দেশ। কেননা কোন বিষয়ে এক রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতে হয়। পারস্পরিক নির্ভরশীলতায় রাষ্ট্র ও জাতিসমূহ যে সম্পর্ক বজায় রাখে তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।

ইসলামে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধু আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নয়। জাতিসমূহের পারস্পারিক সম্পর্ককেই ইসলাম কেবল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলে অভিহিত করে না। ইসলামে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি অধিকতর ব্যাপক। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকর্তা। তিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। মানুষ আল্লাহ তায়ালার খলিফা। খিলাফতের এ দায়িত্ব পালনের জন্যে মানুষের কাছে ইসলাম পাঠানো হয়েছে। ইসলাম বিশ্বজনীন এবং সর্বকালীন ধর্ম। ইসলামের ধারক এবং আল্লাহর খলিফা হিসেবে মানুষের মূল দায়িত্ব হলো এ আদর্শের বিশ্বায়ন করা। যে জন্য মানবিকতা ও দায়িত্ববোধের দাবিতে বিশ্বমানব পরস্পরের মধ্যে একটা বাধ্যতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলে।

সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদকে (সা.) মহান আল্লাহ তায়ালা বিশ্ব জাহানের শান্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। কোন বিশেষ জাতি, গোষ্ঠী কিংবা সমপ্রদায়ের জন্য নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি, (আম্বিয়া, ১০৭)। তাই ইসলাম বিশেষ কোন সমপ্রদায়ের শান্তির কথা চিন্তা করে না। বরং জাতি, ধর্ম, বর্ণ সমপ্রদায় নির্বিশেষে আন্তর্জাতিক পরিম্ললের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছে। ইসলামের এই ঘোষণার প্রথম কথা হলো- পৃথিবীর সকল মানুষ ভাই ভাই হিসেবে সবার সাথে ভ্রাতৃত্বের সুসম্পর্ক বজায় থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন- হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের সেই প্রভুকে ভয় করো, যিনি এক আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার থেকে জোড়া ও তাদের থেকে সকল নারী ও পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন, (নিসা, ১)। তিনি আরো বলেন- মানুষ একই উম্মাহর অন্তর্ভূক্ত, (বাকারাহ, ২১৩)।  কাজেই মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই সমান। এভাবে ইসলাম আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার নীতিমালা ঘোষণা করেছে।

তাছাড়া মানুষ একটি সামাজিক জীব। সে বিশ্ব মানব সমাজের সদস্য। দেশ, কাল, জাতির সংকীর্ণ বেড়াজাল ছাড়িয়ে তার বড় পরিচয় সে মানুষ। কিন্তু পৃথিবীতে পরিচিতির সুবিধার্থে এবং সুশাসন ও সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য মানব সমাজ বিভিন্ন দেশ ও জাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশা ইসলাম বিভক্ত এসব মানুষের মধ্যে এক অভিন্ন চেতনার সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ইসলামী জীবন দর্শনের এটাই মূলকথা। ইসলাম আন্তর্জাতিক ধর্ম। বিশ্ব মানবের মুক্তির জন্যেই ইসলাম নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন মুহাম্মদ (সা.)। সে জন্যে তাঁকে বিশ্বনবী বলা হয়। স্বাভাবিক কারণেই তাই আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ইসলাম বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। ১. বিশ্বমানব একজাতি: পৃথিবীর সব মানুষ জাতিগত অভিন্ন পরিচয়ের অধিকারী। রাজা, প্রজা, ধনী-নির্ধন, দেশ, কালের পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে তারা মানুষ। কুরআন অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সাথে এ বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করেছে। মানুষ হিসেবে অপর মানুষের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখার তাগিদ দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- হে মানুষ! নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে এক জন পুরুষ ও এক জন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রভূক্ত বানিয়েছি, কেবল এ জন্য যে, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার, (সূরা হুজরাত, ১৩)।  মহান আল্লাহ আরো বলেন- সব মানুষ একই উম্মতভূক্ত, (সূরা বাকারাহ, ২১৩)। ২. বিশ্বমানবের সম্মান ও অধিকার সমান: আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্যে ইসলাম মানুষে মানুষে কোন বিভেদ সৃষ্টি করেনি। মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার ও সম্মানের সাম্য ঘোষণা করেছে। বলেছে- শুধু বিশেষ কোন বংশে, ধর্মে বর্ণে বা অঞ্চলে জন্মহনের জন্য মানুষ শ্রেষ্ঠ হবে না। বরং মানুষ হিসেবে তারা হবে সমান অধিকার ও সম্মানের অধিকারী। কোন আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্বও নেই অনারবের উপর, শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হতে পারে কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন- নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সে, তোমাদের মধ্যে যে বেশি তাকওয়াবান, (হুজুরাত, ১৩)।  ৩. বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব: বিশ্ব মানবের পারস্পরিক সম্পর্ক সুন্দর ও সৌহার্দপূর্ণ করে তোলার জন্যে ইসলাম তাদের মধ্যে এক অভিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এ সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)-এর সন্তান হিসেবে তারা একজন অপর জনের ভাই। আল্লাহ তায়ালা বলেন- হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের সেই প্রভুকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার সাথী। আর তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারীর বিস্তার ঘটিয়েছেন, (সূরা নিসা, ১)।  ৪. আদর্শিক ভ্রাতৃত্ব: বিশ্বজনীন এই ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ইসলাম আদর্শিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ইসলামী আদর্শে বিশ্বাস এবং ইসলামী আদর্শের অনুশীলন ও অনুসরণের ফলে কেবল মুসলিমদের মধ্যে এ সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের চেয়ে এ ভ্রাতৃত্বের পরিসীমা ছোট। কিন্তু এর আবেদন ও দাবি যে কোন ভ্রাতৃত্বের চেয়ে বেশি। আদর্শিক ভ্রাতৃত্ব বিশ্বমুসলিমের মধ্যে সীসাঢালা প্রাচীরের সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে দেয়। যা আন্তর্জাতিক সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপুল অবদান রাখে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই। কাজেই তোমাদের ভাইদের সম্পর্ক সংশোধন করে দাও, (সূরা হুজরাত, ১০)।  ৫. অন্যন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধা: বর্তমান বিশ্বে অশান্ত ও অবিশ্বাস অনেকটাই দূর হয়ে যাবে যদি তাদের পারস্পারিক বর্ণের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে। ইসলামে সকল নবী-রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। কেননা পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ছাড়া কোন সুসম্পর্কই গড়ে উঠে না। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- আমরা রাসূলদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না, (সূরা বাকারা, ২৮৫)।  মহান আল্লাহ আরও বলেন- ধর্ম নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি নেই, (বাকারা, ২৫৬)। ৬. চুক্তি পালন ও প্রতিশ্রুতি পূরণ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সুন্দর ও সৌহার্দপূর্ণ করার ক্ষেত্রে পারস্পরিক চুক্তিসমূহ পালন করা এবং প্রতিশ্রুতিসমূহ পূরণ করার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ বিষয়ে ইসলাম সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন- মুমনিগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূরণ কর, (সূরা মায়িদাহ, ১)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- তোমরা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কর, নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, (১৭:৩৪)।  পারস্পরিত সম্মান ও সমঝোতার ভিত্তিতে যদি কাফির ও মুশরিকদের সাথেও চুক্তি হয়- তাও পালন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: পৌত্তলিকদের মধ্যে যাদের সাথে তোমরা চুক্তি করেছো তাদের চুক্তি মেয়াদ পর্যন্ত পালন কর। যারা চুক্তির পর তোমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে- তাদের উপর অভিশাপ বর্ষিত হবে এবং তাদের জন্যে রয়েছে অত্যন্তখারাপ বাসস্থান, (১৩:২৫)।  ৭. সংঘর্ষ পরিহার: আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার জন্য ইসলাম সর্বোতভাবে যুদ্ধ পরিহারের মূলনীতি করেছে। যে কোন যুদ্ধই অহেতুক প্রাণহানির কারণ হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। সে কারণে ইসলামের নীতি হলো যতটা সম্ভব সংঘাত এড়ানো। এ জন্য সমঝোতা-সন্ধিকেই কাঙ্খিত বিষয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- আর সন্ধি সমঝোতাই উত্তম, (সূরা নিসা, ১২৮)।  ৮. ন্যায়নীতি ও দয়া প্রদর্শন : আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক স্থাপন ও সুন্দর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার জন্য ইসলাম আন্তঃরাষ্ট্রীয় লেদদেন ও আচারণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ন্যায়নীতি অবলম্বন করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখার জন্যে ইসলাম দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শনের বিধান দিয়েছে। এর আওতায় গরিব দেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। অন্যায় করার পর কোন দেশ অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা প্রদর্শন করতে হবে। এভাবে সুন্দর ও সহূদয়তাপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। ৯. হজ্জ্বের বিশ্ব সম্মেলন : বিশ্বের প্রতিটি দেশের মুসলিমগণ হজ্জ্ব মৌসুমে মক্কায় সমবেত হন। এখানে তারা দীর্ঘ সময় একটা পবিত্র ও আন্তরিক পরিবেশে কাছাকাছি থাকেন। আন্তর্জাতিক অসহিষ্ণুতা ও সংঘাত প্রতিরোধে প্রতিবছরের এ সমাবেশ বিশেষ ভূমিকা রাখে।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী

আমারসংবাদ/জেআই