Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

লক্ষ্য যার ট্রিপল জিরো!

মাহমুদুল হাসান

আগস্ট ১৪, ২০২১, ০৬:৪০ পিএম


লক্ষ্য যার ট্রিপল জিরো!

ট্যাবু নয়, পরিবার পরিকল্পনা এখন বাস্তবতা। শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে পরিবার পরিকল্পনা সেবা। এসব সহজ কোনো কাজ ছিলো না। একসময় নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়েই কাজ করতে হতো এ অধিদপ্তরকে। এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজ করতে হয়। পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে মানুষের ধারণা পাল্টেছে কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সীমিত জনবল এসব এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। করোনা মহামারিকালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তখনো অধিদপ্তরের কর্মীরা ঘরে বসে থাকেননি। তারা জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল ও পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে গ্রাম থেকে শহরে ছুটে বেড়িয়েছেন। দুর্গম চরে এখনো মাঠকর্মীদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সেবা প্রদান করতে হচ্ছে। যদিও আশার আলো হয়ে জ্বলছে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকসহ দেশের ৩০ হাজার স্যাটেলাইট ক্লিনিক। যেখানে নিরলসভাবে নিরাপদ মাতৃত্ব ও প্রসূতিসেবা, মা ও শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ধরনের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। কোভিডকালেও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন অধিদপ্তরের ৫২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। করোনাকালে সেবা প্রদান করতে গিয়ে অনেকে কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন। এখনো হচ্ছেন। এমনকি প্রাণহানিও নেহায়েত কম নয়। তবুও শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দক্ষ কর্মী বাহিনী নিয়ে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। করোনার তীব্রতায় সেবায় কোনো ঘাটতি তৈরি হয়নি। ফলে জনসংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বাড়েনি। সম্প্রতি গণটিকাদানেও প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে অংশগ্রহণ। এসব সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক সাহান আরা বানু।

তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূরের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করছেন। এখন তিনি তিনটি সূচকে জিরোতে নামার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি চাইছেন এই জনবল নিয়ে শতভাগ জনগোষ্ঠীর মাঝে পরিবার পরিকল্পনার সেবা পৌঁছে দিতে। মাতৃমৃত্যু শূন্যে নামাতে এবং নারী ও কিশোরীদের প্রতি কোনো রকম সহিংসতা বন্ধ করতে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, সাহান আরা বানু দায়িত্বগ্রহণের পর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে নতুনত্বের ছোঁয়া লেগেছে। ইতোমধ্যে চারটি জেলার কার্যক্রম পেপারলেস হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও জেলায় এই ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উপজেলাপর্যায়ে একটি করে মা ও শিশু সেবাকেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সুখী পরিবার কল সেন্টারের পরিধি। করোনাকালেও কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা রাখা হয়েছে। পোশাকশিল্পের তরুণ-তরুণীদের পরিবার পরিকল্পনা ও পরামর্শসেবা সমপ্রসারণের জন্য স্যাটেলাইট ক্লিনিকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের ১০০টি কমিউনিটি ক্লিনিককে মডেল ক্লিনিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করা হচ্ছে। এছাড়াও নতুন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার কল সেন্টার ১৬২৬৩ স্বাস্থ্য বাতায়নে যুক্ত করা হয়েছে যৌন স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে দেশের ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে চালু ছিলো সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা। করোনার ভয় জয় করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রায় ৫২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী সারা দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

টেলিমেডিসিন সেবারও হয়েছে অগ্রগতি। জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার কল সেন্টার ১৬২৬৩ স্বাস্থ্য বাতায়নে যুক্ত করা হয়েছে যৌন স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা। বাংলাদেশ সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সর্বস্তরে তথ্যপ্রযুক্তি প্রবর্তন ও প্রচলনের যে যুগান্তকারী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তারই প্রতিফলন হিসেবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতাধীন চারটি জেলার মাঠ পর্যায়ের সব কার্যক্রম কাগজমুক্ত (পেপারলেস) ঘোষণা করা হয়েছে। জেলাগুলো হলো— নাটোর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ঝিনাইদহ। ঘরে বসে নিরাপদ মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের লক্ষ্যে চালু করা হয়েছে ‘সুখী পরিবার’ কল সেন্টার ১৬৭৬৭। যেখান থেকে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা মিলছে। ট্যাবু ধারণা দূর করে স্কুলগুলোতে দেয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যসচেতনতা ও প্রজনন স্বাস্থ্যের পরামর্শ।

কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যেও কৈশোরবান্ধব কেন্দ্রগুলো খোলা ছিলো। বর্তমানে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি করে মডেল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র করা হয়েছে। এছাড়া উপজেলাপর্যায়ে একটি করে ও জেলাপর্যায়ে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা সেবা দেয়ার জন্য সরকার জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে এবং কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে কৈশোরবান্ধব সেবা নিশ্চিতসহ যারা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, তাদেরও সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পোশাকশিল্পের তরুণ-তরুণীদের পরিবার পরিকল্পনা ও পরামর্শসেবা সমপ্রসারণের জন্য স্যাটেলাইট ক্লিনিকের ব্যবস্থা করেছি। ইতোমধ্যে ১০টি পোশাকশিল্পে এ সেবা চালু করেছি। ৩২টি জেলায় অনলাইনের মাধ্যমে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। টাঙ্গাইল ও হবিগঞ্জকে সম্পূর্ণ অনলাইন সেবার আওতায় আনা হয়েছে। ধীরে ধীরে এ সেবার আওতা বাড়ানো হবে। এর ফলে সবাই সহজে সেবা গ্রহণ করতে পারছে। অনলাইনে তথ্য গ্রহণের মাধ্যমে গাজীপুরের কাপাসিয়াকে মাতৃমৃত্যুমুক্ত কাপাসিয়া মডেল তৈরি করা হয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে আরও ১০০টি কেন্দ্রে এই মডেল সমপ্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠকর্মীরা প্রতি মাসে প্রায় ৩০ হাজার স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিদর্শনের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। ফলে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে এবং এই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জিত হয়েছে এমডিজি অ্যাওয়ার্ড-২০১০।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু বলেন, কোভিডকালে টেলিমেডিসিন সেবা গুরুত্ব পেয়েছে। আমরা সে বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। কিশোর-কিশোরীবান্ধব সেবা দেয়ার জন্য আমাদের অধিদপ্তরে একটি কল সেন্টার সার্বক্ষণিক কাজ করছে। এর নম্বর হচ্ছে ১৬৭৬৭। তিনটি জিরোতে আমরা আসতে চাই। এর একটি হলো শতভাগ পরিবার পরিকল্পনার সেবা পৌঁছে দিতে চাই। দ্বিতীয় হলো আমরা কোনো মাতৃমৃত্যু চাই না। এ জন্য আমাদের যেসব নবদম্পতি রয়েছেন, তারা যেনো পরিবার পরিকল্পনার সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। আমরা নারী ও কিশোরীদের প্রতি কোনো রকম সহিংসতা দেখতে চাই না। এ জন্য আইনের যেনো সঠিক প্রয়োগ হয়। আমি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে ছিলাম। আমি মনে করি, আইন প্রয়োগের জন্য দরকার সর্বস্তরে সচেতনতা। সরকার সেবা দেয়ার জন্য অনেক কিছু করছে। কিন্তু যারা সেবা গ্রহণ করবেন, তারা যদি সচেতন না হন, তাহলে কোনো উদ্যোগই ফলপ্রসূ হবে না। সবার ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রচেষ্টায় সামনে এগিয়ে যাবো। তরুণ জনগোষ্ঠীকে সম্পদে পরিণত করবো। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সুখী-সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে উঠবো।

আমারসংবাদ/জেআই