Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

বাবা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন, মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নেই (২)

শেখ ফজলে শামস পরশ

আগস্ট ১৫, ২০২১, ০৬:১০ পিএম


বাবা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন, মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নেই (২)

(পূর্বে প্রকাশের পর) ওটাই ছিলো আমার আর তাপসের একমাত্র ভরসা, একমাত্র আশার সম্বল। ঠিক বর্ডারের কাছেই আমরা একটা চরের মতো জায়গায় আশ্রয় নিলাম। চারদিকে থৈথৈ পানি; ঘন অন্ধকার রাত। আমরা অনেক ভয় পেয়েছিলাম। জায়গাটা ছিলো অত্যন্ত দুর্গম। আমাদের সাথে সেলিম কাকা নজরুল নামে একটা লোক ঠিক করে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক আমাদের সম্পূর্ণ সহায়তা করেছেন। উনি না থাকলে হয়তো বা আমরা আসতেই পারতাম না। একটা সময় ইঙ্গিত এলো যে, এখন ফাঁকা আছে, আমাদের দৌড় দিতে হবে। তাপসকে কোলে নিয়ে আমরা রাতের অন্ধকারে দৌড় দিলাম। হাঁটু পর্যন্ত পানি অতিক্রম করে আমরা বিএসএফ বর্ডারে পৌঁছলাম।

বিএসএফ বর্ডারে একটা অফিসে আমাদের বসানো হলো। ওখানে উর্দি পরা মানুষজন ঘোরাফেরা করছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে অনেকক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হলো। তবে ওরা অনেক আদর-যত্ন করেছে। আমাদের নাশতাও খেতে দিয়েছিল। সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাকে দেখে আমাদের আনন্দ আর ধরে না! আমরা যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আমাদের সব কষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং আমাদের মা-বাবার কাছে নিয়ে যাবে। আমাদের আর পায় কে? সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাও আমাদের বুকে জড়িয়ে ভীষণ কান্না করছিলেন। তাদের কান্না দেখে আশপাশের সবার চোখেই পানি এসেছিল সেই দিন। তারা আমাদের কলকাতার বাঙ্গর নামক এলাকায়, সিন্ডারেলার বাসায় নিয়ে এলো। বাসাটা সংলগ্ন সিন্ডারেলা নামে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিলো। এ কারণেই বাসাটা সিন্ডারেলার বাসা নামে পরিচিত। ওই বাসায় আমরা দুই ভাই বাবা-মাকে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি সেখানে চাচি, মামি, কান্তা আপু ও শিশু সাদেকও (বর্তমান বরিশালের মেয়র) আছে। কান্তা আপু আমাদের থেকে দুই-তিন বছরের বড়। এ ছাড়া ওখানে ততদিনে বেশ কিছু আমাদের বাংলাদেশি আত্মীয় স্বজন যাদের হয়রানি করছিল মোশতাক সরকার বিভিন্নভাবে, তারাও পালিয়ে এসেছিল। অনেকে ছিলো কিন্তু বাবা-মা ছিলো না।

আস্তে আস্তে আমাদের না পাওয়ার যন্ত্রণা সয়ে আসছিল কি-না জানি না। কিন্তু আমার মধ্যে এক ধরনের বিরক্তি কাজ করছিল। আমি যেনো বাবা-মাকে চাইতে চাইতে, আর না পাইতে পাইতে অতিষ্ঠ। জিদ করে মা-বাবার কাছে যেতে চাওয়াও কমিয়ে দেই একসময়। তবু অবচেতন মনে একটা আশা ছিলো হয়তো বা বাবা-মা আসলেই লন্ডনে আছেন। কারণ আমাদের সেটাই বলে সান্ত্বনা দেয়া হতো। আমি মনে হয়, ১৯৭৯ সালে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত আশা করতাম বাবা-মাকে কোনো একদিন ফেরত পাবো। একসময় বুঝতে পারলাম, বাবা-মা লন্ডনে থাকার কথাটা একটা অবাস্তব কল্পনা। যেহেতু এক বাসায় বেশি মানুষ হয়ে গিয়েছিল, কিছু মাস পরে আমরা বাসা বদলি করে আরেকটা বাসায় উঠি। ছোট্ট একটা তিন রুমের একতলা বাসা। পাশেই দুই কামরার অন্য একটা বাসা। ওইখানে আরেকটা পরিবার থাকতো। দুই বাসার মাঝখানে শুধু কলাপসিবল গেটের একটা দেয়াল। ওখানে এক সনাতন ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করতো। ভদ্রলোক চাকরিজীবী ছিলেন, নিয়মতান্ত্রিক এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। মৃদুভাষী ওই ভদ্রলোকের নামটা আমার মনে নেই, তবে তার স্ত্রী, তন্দ্রা কাকি আমাদের পড়াতেন এবং অনেক আদর করতেন। তাদের দুই সন্তান— নান্টু আর মালি। মালি আমার বয়সি হবে, আর নান্টু আমার থেকে দুই-এক বছরের বড় হবে। শিগগিরই ওদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। ওদের প্রতি মাসেই কোনো না কোনো ধর্মীয় উৎসব থাকতো। প্রথমটাতে যাওয়ার পরে আমার লোভ হয়ে গেলো। আমি তারপর থেকে সবগুলো পূজার উৎসবে যেতে বায়না ধরতাম। দাদি ভয় পেতেন, যেতে দিতে চাইতেন না। আমিও জিদ করতাম। চাচি দাদিকে বুঝিয়ে ব্যবস্থা করে দিতেন। পূজা উৎসবগুলোর গানবাজনা আর আনন্দমুখর পরিবেশ আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগতো।

কান্তা আপুও মাঝে মাঝে আসত। আমরা একসাথে খেলা করতাম। একদিন আমি, কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু একটা অভিযানে বের হলাম যে, আমরা চিরাচরিত গণ্ডি পেরিয়া দূরে যে দমদম বিমানবন্দর দেখা যায় ওইখানে যাবো। আমরা মাঠঘাট পেরিয়া যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আমি সবার আগে আগে দৌড়াচ্ছিলাম। সামনে দেখি কালো চকচকে নিচু একটা পিচঢালা জায়গা। পা দিতেই হঠাৎ করে আমি অনুভব করলাম যে, আমি কাদায় পা দিয়েছি। কিন্তু কাদা থেকে পা উঠাতে পারছি না। দেখলাম যে যতই চেষ্টা করছি, আমি কাদার ভেতরে আরও ঢুকে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এসে দেখে আমি কোমর পর্যন্ত ঢুকে গেছি। তাপস আমার এই অবস্থা দেখে কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না দেখে আমিও কান্না শুরু করলাম। কান্তা আপু আর নান্টু আমাদের মধ্যে বড়। এরা দুজন আমাকে উঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। যেহেতু আমরা অভিযানের জন্য শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছিলাম, জায়গাটা ভীষণ জনশূন্য ছিলো। অনেক কসরত করে ওরা আমাকে চোরাবালি থেকে উদ্ধার করলো। আমাকে তুলতে গিয়ে নান্টুর একটা পা-ও চোরাবালিতে পড়ে গিয়েছিল। পা উঠাতে গিয়ে ওর স্যান্ডেলটা খোয়া যায়। এই ছিলো আমার জীবনের প্রথম অভিযানের ফলাফল, আর দাদির কথা অবাধ্য হওয়ার শাস্তি। ফেরার পথে আমরা সবাই খুবই ভীত এবং মন খারাপ করছিলাম।

স্যান্ডেল হারিয়ে নান্টুর কি পেরেশানি! স্যান্ডেল জোড়া গত মাসে পূজার সময় ওর বাবা কিনে দেন এবং সামনের বছরের পূজার আগে ওকে আর স্যান্ডেল কিনে দেয়া হবে না। এই হচ্ছে ওর ডিলেমা। কথাটা শুনে আমি বুঝতে পারিনি প্রথমে। পরে বুঝলাম, ওর বাবা চাকরিজীবী, সীমিত আয়। তাই আর এক জোড়া স্যান্ডেল কিনতে ওর সামনের বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই নিয়মটা আমাকে ভাবায় এবং অবাকও করে। আমরা একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে সামনের ঘরে খেলছি। হঠাৎ দেখি কে যেনো বাইরের দরজায় কড়া নাড়ছে। শুনলাম পাশের ঘরে কান্নার আওয়াজ। দৌড়ে দাদির ঘরে গিয়ে দেখি দাদি একটা দাড়ি ও লম্বা চুলঅলা অল্প বয়সি লোককে ধরে কাঁদছে। আমার বেশ খানিকটা সময় লাগল চিনতে যে, লোকটা আমার মারুফ কাকা। ১৫ আগস্টের পর মারুফ কাকার সাথে মনে হয় ওই প্রথম আমার দেখা। মারুফ কাকাকে চেনাই যাচ্ছিল না। তার যে জংলি অবস্থা! সারা শরীরে তার দাগ আর ক্ষত। পরে শুনলাম মারুফ কাকা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মারুফ কাকা ’৭১ আর ’৭৫-এ মোট দুবার যুদ্ধ করেছেন। শুধু ’৭৫-এ তিনি দুবার তার বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। দুর্ভাগ্যবশত দুবারই সেই প্রচেষ্টা বিফল হয়।

চাচি আমাদের বিভিন্নভাবে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করতেন। চাচির প্রধান লক্ষ্য ছিলো আমাদের যেনো মন খারাপ না হয়; কান্নাকাটি না করি। সুভাষ (শেখ ফাহিম, এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট) তখন ছয় মাসের হবে। সেলিম কাকা আর দাদির কাছে সুভাষকে রেখে আমাদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য সার্কাস দেখতে, অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দেখতে, আর শিশুপার্কে নিয়ে যেতেন। আমরা কোনো কিছুতেই ‘না’ করতাম না। চাচি আমাদের মায়ের মতোই ভালোবাসতেন। কারো বোঝার উপায় ছিলো না যে, আমরা চাচির সন্তান না। ২৪ ঘণ্টা চাচি আমাদের পেছনে সময় দিতেন। শুধু রাতে ঘুমাতাম দাদি আর রেখা ফুফুর সাথে। চাচি সারাক্ষণ আমাদের আগলে রাখতেন। মায়ের শেষ কথাটা, ‘আমার পরশ-তাপসকে তুমি দেইখো’, চাচি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। একদিন চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের নিয়ে বের হয়েছেন। ব্যস্ত রাস্তাঘাট। রেখা ফুফুও তখন ছোট, ১৫ বছর বয়স হবে। চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের দুই ভাইয়ের হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অস্থির আমি, চাচির হাত থেকে ছুটে দৌড় দেই একটা বাসের সামনে দিয়ে রাস্তার ওপারে। বাসটা বিকট আওয়াজ করে কষে ব্রেক করে। চাচি আর রেখা ফুফু সেদিন বড্ড ভয় পেয়েছিলেন। চাচি তো রীতিমতো কাঁপছিলেন। তিনি কেঁদে বলছিলেন, ‘আমার শাশুড়িকে আমি কি জবাব দিতাম, যদি কিছু হইত।’তখন বুঝলাম, আমার এমনটা করা উচিত হয়নি। দেখতে দেখতে এভাবে প্রায় বছর খানেক পেরিয়ে যায়। আমাদেরও বাসা পরিবর্তন করার সময় চলে আসে। বাসা পরিবর্তন করা মানেই মায়ার টানাপড়েন। আমার তন্দ্রা কাকি, আর নান্টুকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছিল। আমরা বাঙ্গরের আরেকটা এলাকায় বাসা নেই। নতুন বাসাটা দোতলা বাসা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আর নতুন এলাকা। আশপাশের প্রতিবেশীরা বন্ধুত্বপূর্ণভাবে আমাদের গ্রহণ করলো। আমাদের মা-বাবা না থাকার ঘটনাটা মনে হয় ওরা জানত। আমরা নিজেরাই তখনো সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত নই ব্যাপারটাতে। আমি শুধু এটুকু বুঝতাম যে, মানুষজন আমাদের একটু আলাদা চোখেই দেখত, আর আমাদের একটু বেশি মায়া করতো। ওখানে আশপাশে অনেকগুলো পরিবার, বেশির ভাগই অল্প বয়স্ক মেয়ে। চাচি ও রেখা ফুফুর সাথে ওদের ভালো সখ্য হয়ে গেলো। আমার বয়সি মনে হয় তেমন ছেলেপেলে ছিলো না। বা থাকলেও ওদের সাথে আমার নান্টুর মতো বন্ধুত্ব হলো না।

(শেষাংশ আগামীকাল)

লেখক : ১৫ আগস্টের শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি ও আরজু মণির জ্যেষ্ঠ পুত্র। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

আমারসংবাদ/জেআই