Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

উচ্চ আদালতে অধিকাংশ মামলায় হারছে দুদক

আগস্ট ১৭, ২০২১, ০৬:২৫ পিএম


উচ্চ আদালতে অধিকাংশ মামলায় হারছে দুদক
  • হারলেও প্যানেল আইনজীবীদের নেই জবাবদিহি
  • উচ্চ আদালতে এসেই আটকে যায় স্থগিতাদেশে
  • বিচারও চলছে ধীরগতিতে
  • প্রভাবশালী আসামিরা আইনের ফাঁক দিয়ে বিলম্বিত করেন বিচারপ্রক্রিয়া
  • প্রসিকিউশন না থাকা, আইনজীবীদের গাফিলতি দপ্তর-পরিদপ্তরের অসহযোগিতাই হেরে যাওয়ার প্রধান কারণ : দাবি বিশ্লেষকদের

দেশের মাঠ পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি বিদ্যমান। নানা সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সত্যতা যাচাইয়ে অনুসন্ধানে নামে  দুদক। তদন্তে দুর্নীতির আলামত পেলেই হয় মামলা। দ্রুত সময়ের মধ্যে চার্জশিটও জমা পড়ে। তবে আদালতে এসেই থমকে যায় বিচার কাজ! মামলার আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিলম্বিত করেন  বিচার প্রক্রিয়া। যার ফলে দুদক আইনে দায়ের হওয়া অধিকাংশ মামলাই বছরের পর বছর ধরে অনিষ্পন্ন থেকে যায়। কখনো স্থগিতাদেশে যুগ যুগ ঝুলে থাকে মামলা। স্পর্শকাতর এসব মামলার অনুসন্ধান ও তদন্তে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি সময় লাগছে। বিচারও চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। দ্রুত নিষ্পত্তি করতে কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগও নেই। অভিযোগ রয়েছে, বিচার প্রক্রিয়া শেষে অধিকাংশ মামলায় আইনি লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এই হারের মাত্রা বিচারিক আদালতে ৫৩ ভাগ, উচ্চ আদালতে ৯৫ ভাগ। অথচ দুদকের পরিসংখ্যানে বিচারিক আদালতে নিষ্পত্তির হার কমিশনে ৭১ শতাংশ এবং ব্যুরোয় ৪৭ শতাংশ দেখানো হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতের কোনো পরিসংখ্যান দেখানো হয়নি। এদিকে নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট না থাকা, আইনজীবীদের গাফিলতি, দপ্তর-পরিদপ্তরের তথ্য প্রদানে অসহযোগিতার কারণে দুদকের মামলা হারের পরিমাণ বেশি বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি, মামলায় হারলেও প্যানেল আইনজীবীদের কার্যকর জবাবদিহি নিশ্চিত করেনি সংস্থাটি। দুদকও বিষয়টি ‘ব্যয়সাপেক্ষ’ এবং কখনো ‘টেকনিক্যাল অসুবিধা’ বলে এড়িয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দেড় দশকে আবুধাবির সাবেক রাষ্ট্রদূত নাজিম উল্লাহ চৌধুরী ও বনখেকো ওসমান গনি (তিনি আপিল করেননি) ছাড়া কারো শাস্তি বহাল থাকার কোনো তথ্য দুদকের হাতে নেই। ফলে আপিল বিভাগে দুদকের পক্ষে দণ্ড বহাল থাকার হার প্রায় শূন্য। বিচারিক আদালত থেকে উচ্চতর আদালত পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণ কমিশনকে লিখিতভাবে কখনো ব্যাখ্যা করতে হয়নি আইনজীবীদের। অভিযোগ উঠলে প্যানেল থেকে বাদ দেয়াই হচ্ছে এ পর্যন্ত দুদক আইনজীবীদের ‘সর্বোচ্চ জবাবদিহি’।

এদিকে বিচারিক ও উচ্চ আদালতে কোথায় কতজন আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হবে, তাদের মানদণ্ড কি হবে- এমন একটি নীতিমালা প্রণয়নের চেষ্টা চললেও সেটি দৃশ্যমান করতে পারেনি কমিশন। এছাড়াও প্রতি বছর দুর্নীতি বন্ধে একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সুপারিশ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো দুর্নীতি বন্ধে দুদকের সুপারিশগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না বলে জানিয়েছে দুদক। এছাড়াও দুদক প্যানেল আইনজীবীদের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও আশানুরূপ ফল আসছে না। আইনজীবী খরচ বাবদ  বছরে গড়ে সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে- যা দুদকের বার্ষিক বাজেটের প্রায় অর্ধেক। বিপুল অর্থ ব্যয় করেও ২০১১ সালে বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হয়েছেন ২০ শতাংশ আসামি। যদিও বিগত কমিশন দাবি করছে, অধিকাংশ মামলায় আসামির সাজা হচ্ছে। বিশেষ করে অর্থ পাচার মামলায় সাজার হার শতভাগ। এসব শুধু বিচারিক আদালতের ফলাফল। হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে দুদক কতটি মামলায় জয় পেয়েছে- সেটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বিচারিক আদালতের এ পরিসংখ্যান দিয়ে দুদক সাফল্যের সাফাই গাইলেও হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে কত শতাংশ শাস্তি বহাল থাকছে- সে পরিসংখ্যান বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয় না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গত দেড় দশকে দুদক রাজনৈতিক আনুগত্য, ব্যক্তি সম্পর্ক, তদবির ও অনুরোধের ভিত্তিতে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে। সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও যোগ্যতার মানদণ্ড থেকেছে উপেক্ষিত। কজন পেশাদার, প্রতিশ্রুতিশীল আইনজীবী ছাড়া দুদকের অধিকাংশ আইনজীবীর সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী সময়ে দুদক হত্যা মামলার আসামিকেও প্যানেলের আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। ওই আইনজীবী এখনো বহাল রয়েছেন। প্রকাশ্যে দুদকের পক্ষে, নেপথ্যে আসামি পক্ষের হয়ে লড়ছেন- এমন একাধিক অভিযোগ সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে প্যানেল থেকে বাদ দেয়া হয়নি। আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আসামি পক্ষের সুবিধা অনুযায়ী শুনানিতে বারবার তারিখ চাওয়া, আদালতে দুদকপক্ষীয় সাক্ষীকে অনুপস্থিত দেখানো, জামিনে জোরালো বিরোধিতা না করা, রেকর্ডপত্র উপস্থাপন না করার মতো অভিযোগ প্রায়ই আসে। অর্থ পাচার মামলায় ‘পলাতক’ তারেক রহমানের খালাস প্রাপ্তি, হলমার্ক মামলায় আসামি জেসমিন ইসলামের জামিন মঞ্জুর, ডিএন স্পোর্টসের মালিক পলাতক মোতাহারউদ্দীন চৌধুরী ও ফাহমিদা আক্তার শিখার জামিন লাভের মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলায়ও দুদকের প্যানেল আইনজীবীদের বিরুদ্ধে রয়েছে আসামির পক্ষে কাজ করার অভিযোগ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী প্রথম ১০ বছরে দুদক ৩ হাজার ৬০০ ৬২টি মামলা করেছে। কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রথম ১০ বছর বিচারের জন্য আদালতে উঠেছে ৩ হাজার ৭১২ মামলা। এসব মামলায় বিভিন্ন আদালতে দুদকের পক্ষে আইনি লড়াই করছেন ৩১৬ আইনজীবী। এর মধ্যে ঢাকার বিশেষ আদালতে ১৩, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে ৩৯ এবং অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড হিসেবে রয়েছেন ৭ জন। তাদের সঙ্গে দুদকের মামলাভিত্তিক (কেস টু কেস) চুক্তি। অর্থাৎ, মামলা অনুসারে তাদের ফি বা অর্থ পরিশোধ করা হয়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ৩৩ ধারায় দুদকের নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিটের কথা বলা হয়েছে। আইনটির (১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন কমিশন কর্তৃক তদন্তকৃত এবং স্পেশাল জজ কর্তৃক বিচারযোগ্য মামলাগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে কমিশনের অধীন উহার নিজস্ব একটি স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট থাকিবে।’ প্রতিষ্ঠার দেড় দশকেও দুদক আইনের এ ধারাটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৭ বছরে ৫টি কমিশন গঠিত হলেও কোনো কমিশন আইনের এ অংশটি কার্যকর করেনি। যখনই নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ উঠেছে, তখনই ‘টেকনিক্যাল অসুবিধা’র কথা বলে কমিশন উদ্যোগ গ্রহণ থেকে নিবৃত থেকেছে। অথচ দুদক আইনের সংশোধনীতে বেশ কিছু ধারা বাদ দেয়া হলেও বাতিল করা হয়নি ৩৩ ধারা। একদিকে ধারা বহাল রাখা, অন্যদিকে ধারাটি কার্যকর না করাকে দুদকের ‘বৈপরীত্ব’ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মঈদুল ইসলাম বলেন, ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী সরকার একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেটি পরে এগোয়নি। সেটি হলে দুদকও তা অনুসরণ করতে পারতো। যখন যার জমানা আসবে, তার পছন্দের আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ রাখার জন্যই হয়তো দুদকও নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট গঠন করছে না। আন্তরিকভাবে চাইলে এটি অবশ্যই সম্ভব। নিজস্ব প্রসিকিউশন না থাকায় দুদক বিচারের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে পারছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হকের কাছে জানতে চাইলে এ বিষয়ে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান। দুদক আইনের অকার্যকর ধারা প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদক আইনের ৩৩ ধারা বাস্তবায়নে এক ধরনের অ্যাডহক ইজম লক্ষ করা যাচ্ছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও তদন্তের সুফল আসে আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। অথচ যেখান থেকে ফল আসবে- সেটিই দুর্বল করে রাখা হয়েছে। এ অবস্থার স্থায়ী সমাধান দরকার। দুদকের মামলা নিষ্পত্তির হার কম কেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান বলেন, দুদকের মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক বেশি। আগের তুলনায় অনেক সন্তোষজনক। এ সংস্থার মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির হার কম- এটা যদি কেউ বা কোনো সংস্থা বলে থাকে, তাহলে তারা মিথ্যাচার করছে। আর কোনো বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান গ্রহণযোগ্য নয়- ওটা আমরা গ্রহণ করি না।

দুদকের হেরে যাওয়া কয়েকটি মামলা : কেন মামলাগুলোয় দুদক হেরে যায়, তার কারণ ফুটে উঠেছে  নিষ্পত্তি হওয়া চার ধরনের দুর্নীতির কয়েকটি মামলার রায়ের কপিতে। এতে তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদক আইনজীবীদের গাফিলতির একটি চিত্রও সুস্পষ্ট হয়েছে। নিচে এসব মামলার রায় ও আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হলো।

১. পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একেএম আলী আজমের বিরুদ্ধে ১২ লাখ ৮০ হাজার ৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছিল দুদক। মামলা দায়েরের পর তদন্তে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আলী আজমের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এরপর প্রায় দুবছর পর ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল আসামির বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় চার্জ গঠন করা হয়। বিচার শুরুর ৫ বছর পর ঢাকার ৪নং বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আতাউর রহমান মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে দুদক থেকে আনীত অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থতায় আসামি আলী আজমকে খালাস দেয়া হয়। এ খালাসের পরিপ্রেক্ষিতে রায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, দুদকের প্রসিকিউশন ৫ সাক্ষী আদালতে হাজির করে। এর মধ্যে দুদকের মামলার বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তাও রয়েছেন। রায় থেকে জানা যায়, আলী আজমের সঙ্গে বিরোধ ছিল সিরাজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির। তিনি ২০০৭ সালে আলী আজমের বিরুদ্ধে দুদকে একটি অভিযোগ করেন। অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য নিয়ে আলী আজমের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুদক। তার ভিত্তিতেই মামলাটিও দায়ের করা হয়। বিচার চলাকালে আসামি পক্ষ আদালতকে জানায়, আলী আজমের ২০০৭-০৮ করবর্ষে আয়কর নথিতে অর্জিত আয় ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৭৭ টাকা প্রদর্শন করলেও দুদক কর্মকর্তা তা কমিয়ে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ২৭৭ টাকা দেখিয়েছেন। একইভাবে ২০০৮-০৯ করবর্ষে ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৪৯৮ টাকা কম দেখিয়েছেন। এভাবে তার প্রদর্শিত বৈধ আয় ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ১২২ টাকা বিবেচনায় না নিয়ে ১২ লাখ ৮০ হাজার ৩৪ টাকার আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা করেন। রায়ে বলা হয়, তদন্তকারী কর্মকর্তা কেন আসামির আয় কম দেখিয়েছেন, তার কোনো ব্যাখ্যা তদন্ত প্রতিবেদনে দেননি। এমনকি সাক্ষীর সাক্ষ্যেও কোনো বর্ণনা বা ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। ফলে আসামির আয় কম দেখানো বেআইনি ও কর্তৃত্ববহির্ভূত। রায়ে আরও বলা হয়, মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য এবং তাদের প্রতিবেদনে আসামির নেট আয় দেখানো হয়েছে ৫০ লাখ এক হাজার ৭৩৬ টাকা। অথচ তার সম্পদের পরিমাণ ৬২ লাখ ৮১ হাজার ৭৯৯ টাকা। তদন্ত প্রতিবেদনে আসামির ১২ লাখ ৮০ হাজার ৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া গেছে মর্মে দুদক থেকে অভিযোগ আনা হলেও তা বিচারে প্রমাণিত হয়নি বলে বিচারক তার রায়ে উল্লেখ করেন। রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। মামলার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আসামি আলী আজমকে খালাস দেয়া হয়। দুদকের পক্ষে নিয়োজিত পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে যাবো। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মামলা প্রমাণের। তারপরও বিচারক যে রায় দিয়েছেন, তা মেনে নিতে হচ্ছে।

২. কারা অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী আবদুল হকের বিরুদ্ধে ৪০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছিল। আবদুল হক কারা অধিদপ্তরের স্টেশনারি শাখার দায়িত্বে থাকাকালীন তেজগাঁও মুদ্রণ লেখসামগ্রী ফরম ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে স্টেশনারি মালামাল বুঝে নিয়ে তা কারা অধিদপ্তরে জমা না করে বিক্রি করে ওই অর্থ আত্মসাৎ করেন বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়। দুদকের মামলার আগে আবদুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করা হয়। এ সময় তাকে আত্মসাৎ করা অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য বলা হলেও তিনি তা করেননি। দুদক তদন্ত শেষে ২০১২ সালের ৮ আগস্ট আবদুল হকের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। তদন্তে তার বিরুদ্ধে ৪ লাখ ২৭ হাজার ১৩৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ‘প্রমাণিত’ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মামলায় বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ১২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে বিচারক ২০১৬ সালের ২৯ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আবদুল হককে খালাস দেন ঢাকার ৪নং বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আমিনুল হক। রায় দেয়ার আগে বিচারক তিনটি বিষয়ের দিকে নজর দেন। আসামি আবদুল হক স্টেশনারি মালামালের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কি না- প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছেন কি না এবং আসামির বিরুদ্ধে আনীত ধারায় তিনি শাস্তি পাবেন কি না। বিচার চলাকালীন বিচারক ১২ জনের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করেন। এর মধ্যে ৭ জনই হলেন কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের অনেকেই সাক্ষ্য প্রদানকালে আবদুল হকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের কথা শুনেছেন বলে বক্তব্য দেন। তবে তারা বলেছেন, আবদুল হক চাহিদামাফিক স্টেশনারি মালামাল অফিসে জমা করতেন। তিনি সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ বলেছেন, আত্মসাতের বিষয়ে শুনলেও এর চেয়ে বেশি কিছু তারা জানেন না। বিচারক বলেন, শোনা সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কারণ, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলে সবাই জেনে থাকেন। আবদুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হলেও আত্মসাতের অভিযোগে তাকে দায়ী করা হয়নি। বরং বেআইনিভাবে অফিসে অনুপস্থিত থাকার কারণে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। দুদকের প্রসিকিউশনও তাদের তদন্ত কিংবা আদালতে আনা সাক্ষীদের কাছ থেকে আবদুল হকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সপক্ষে অকাট্য প্রমাণ করতে পারেনি। এমনকি তারা অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্ক শুনানির সময় সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যাও আদালতে দিতে পারেনি। স্টেশনারি মালামাল সম্পর্কিত স্টক রেজিস্টারের বিষয়ে আসামি আবদুল হককে দায়ী করা হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন মর্মে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেননি। আসামির বিরুদ্ধে স্টেশনারি মালামাল উত্তোলন করে অফিসে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করার ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়নি। ফলে তাকে অভিযোগের দায় থেকে খালাস দেয়া হলো।

৩. কমলাপুর আইসিডির ইন্সপেক্টর (প্রিভেন্টিভ শাখা) আবুল হাসেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, ২০০৮ সালে জনৈক আমদানিকারক তাকে দুই হাজার টাকা (৫০০ টাকার চারটি নোট) ঘুষ দিতে বাধ্য হন। একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আবুল হাসেমের অফিস তল্লাশি করে মানিব্যাগ থেকে ৪ হাজার ৬৮২ টাকা উদ্ধার করেন। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রাসেল নামে এক যুবকের কাছ থেকে ৬ হাজার ৫২০ টাকা ও তার অফিস কক্ষের পাশের গুদাম ঘরে পুরোনো স্টিলের ফাইল কেবিনেট থেকে ৫৮ হাজার ৪০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। ওই টাকাসহ তাকে আটক করা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে মামলা করে দুদক। ঢাকার ২নং বিশেষ জজ আদালতের বিচারক হোসনে আরা বেগম ২০১৬ সালের মার্চে এ মামলার রায়ে আসামি আবুল হাসেমকে খালাস দেন।

বিচারক তার রায়ে বলেন, মামলার বিচার চলাকালীন ঘুষের চারটি ৫০০ টাকার নোটের ফটোকপি সম্পর্কে মামলার বাদী কিছু জানেন না বলে উল্লেখ করেন। বাদী তার এজাহারের সমর্থনে বক্তব্য দিলেও আইনজীবীদের জেরায় তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ১৪ আগস্ট তিনি কমলাপুর আইসিডির প্রিভেন্টিভ কক্ষে যাননি। এজাহারে যে আমদানিকারকের মাধ্যমে ঘুষ প্রদানের অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই আমদানিকারককে তদন্তকালে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাও আদালতে বলেছেন, মামলার বাদী ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন না। রায়ে বলা হয়, জব্দ তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ ঘটনা সংবলিত নথি-৫ জব্দ করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই নথি আদালতে দাখিল বা উপস্থাপন করেননি। ঘটনার সময় উপস্থিত আইসিডির যুগ্ম কমিশনার ওয়াহিদা রহমান তার জবানবন্দিতে জব্দকৃত আলামত হিসেবে নথি ও টাকা তার জিম্মায় থাকার কথা বললেও পরে জানান, ওই নথি ঢাকার কাস্টম হাউসের কমিশনার বরাবর পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কাস্টম হাউস থেকে কোনো দালিলিক নথি সাক্ষ্য হিসেবে এ মামলায় প্রেরণ করা হয়নি। বহিরাগত রাসেলের কাছ থেকে এবং স্টিলের ক্যাবিনেট থেকে ঘুষের টাকা উদ্ধারের বিষয়টি পরোক্ষ, মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ হয়নি। সার্বিক বিচার-বিবেচনায় বিচারক আসামি আবুল হাসেমকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেন।

এরকম অসংখ্য মামলায় দুদকের হেরে যাওয়ার অনেক রেকর্ড আছে। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। কিন্তু কেন ‘অকাট্য তথ্যপ্রমাণের’ ভিত্তিতে মামলা করেও দুদক হেরে যাচ্ছে- এমন প্রশ্নে দুদকের এক পিপি বলেন, বাইরে থেকে অনেক কথাই শোনা যায়। কিন্তু আমরা যখন বিচার শুনানি করি, তখন দেখতে পাই মামলাভেদে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু অসংগতি থেকে যায়। আবার সাক্ষীরা এসে আদালতে সত্য প্রকাশ করতে চান না। অনেকে আবার সাক্ষ্য দিতেই আসেন না। সম্পদের মামলার ক্ষেত্রে আয়কর বিভাগ যে সম্পদ বৈধ ঘোষণা করে, তার সপক্ষে আসামিপক্ষ থেকে জোরালো যুক্তি তুলে ধরা হয়। বিচার দীর্ঘায়িত হলে অনেক আলামত আবার নষ্টও হয়ে যায়। তিনি বলেন, কাউকে হয়রানির জন্য মামলা হচ্ছে কি না, সেদিকেও নজর দেয়া উচিত। সে সঙ্গে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের সংজ্ঞাও ঠিক করা উচিত।

আমারসংবাদ/জেআই