Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

রাজনীতির চোখ ক্যাম্পাসে

আবদুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম

আগস্ট ২১, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


রাজনীতির চোখ ক্যাম্পাসে
  • ক্যাম্পাস খোলার আগেই ছাত্ররাজনীতির আড্ডা জমে উঠছে  
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিনই রুটিন কাজে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ 
  • ছাত্রদলও নেতাকর্মীদের নিয়ে ক্যাম্পাস আঙিনায় মহড়া দিচ্ছে
  • বামপন্থি সংগঠনগুলোর ক্যাম্পাস খোলার দাবি নিয়ে দফা পেশ
  • ছাত্র আন্দোলনে তৎপর বিরোধীরা  প্রতিরোধে মাঠে সরকার সমর্থকরা  
  • ক্যাম্পাস রাজনীতিতে গুণগত প্রভাব নেই —দাবি বিশেষজ্ঞদের

৫২৪ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ! গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে করোনা আতঙ্কে শিক্ষালয়ে প্রবেশে বাধা শিক্ষার্থীদের। ক্যাম্পাসে নেই প্রাণের সঞ্চার। নানা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চলছে ভ্যাকসিন প্রক্রিয়া। সশরীরে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণাও এসেছে। এরপরই রাজনৈতিক আশ্রয়ের ছাত্রসংগঠন ফের ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করেছে।

গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে দেখা গেছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ভাতৃত্ব সংগঠন ছাত্রলীগের ২০-২৫ জনকে একসাথে বসে আড্ডা দিতে। ক্যাম্পাস খুলবে শুনে অনেকেই বড় ভাইদের ডাকে ঢাকায় চলে এসেছেন। এদের মধ্যে একজন একটি হলের সাধারণ সম্পাদক। ক্যাম্পাস বন্ধ হলেও তিনি হল ছাড়েননি। রাজধানীর হাতিরপুল জজ গলিতে একটি বাসায় তিনি ভাড়ায় ছিলেন। নিয়মিতই ক্যাম্পাসে আসতেন দু-একজন নিয়ে ঘুরে যেতেন। এখন তিনি দলবেঁধে ক্যাম্পাসে ঘুরছেন।

কথা বললে ওই নেতা জানান, ক্যাম্পাস খোলার ঘোষণায় সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো যাতে ক্যাম্পাসে এসে কোনো প্রভাব বা বিশৃঙ্খলা করতে না পারে সে জন্য আগ থেকেই আমরা ক্যাম্পাসের পরিবেশ রক্ষায় অবস্থান করছি। একইভাবে দেখা গেছে, একসময়কার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের নেতাকর্মীদেরও ক্যাম্পাসে আনাগোনা করতে। এদের মধ্যে একজন কেন্দ্রীয় সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও তিনি ঢাকা ছাড়েননি। কয়েকজন কর্মীকে নিয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় ফ্ল্যাট নিয়ে ভাড়ায় থাকতেন। সমপ্রতি কমিটি গঠন ও ক্যাম্পাস খোলার আভাসে ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় অতীতের মতো আড্ডা জমাচ্ছেন।

কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পাস খুললেই সরকারবিরোধী একটা ছাত্র আন্দোলন হবে। এটিকে আগ থেকেই নিজেদের ঘরে রাখতে এখন থেকেই সতর্ক অবস্থানে থেকে নিজেদের করণীয় ও ভূমিকা ঠিক করছেন। তা ছাড়া লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নির্বাচনের আগে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। তার আগে দলকে সাজাতে এবং জাতীয় ইস্যুতে জনগণের সাথে ভূমিকা পালন করতে বার্তা দেয়া হয়েছে। 

এদিকে পার্শ্ববর্তী অনেক দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় অভিভাবক ও শিক্ষকরাও প্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে জোর দাবি জানান। তারা বলছেন, অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে মৌলিকভাবে কোনো উপকার হচ্ছে না।  ডিভাইস, প্রয়োজনীয় ডাটা ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা না থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। যার ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া যেসব বিভাগের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রয়োজন তাদের অধিকাংশই ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়াই অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শেষ করছেন যা ভবিষ্যতে ওই শিক্ষার্থীকে বিপদগ্রস্ত করবে। এর দায় সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনোভাবেই এড়াতে পারে না বলে দাবি অভিভাবক ও শিক্ষকদের। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোও দাবি জানিয়ে আসছে।

ইতোমধ্যে করোনা পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাস খোলার বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়নের পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এ নিয়ে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি রথীন্দ্র নাথ বাপ্পী বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষার্থীরা বাসার মধ্যে বন্দি থাকার ফলে তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেরও অবনতি হচ্ছে। এমনকি এই মহামারির ভেতর শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হারও বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে ক্যাম্পাস খুলে দেয়ার এবং দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশও ক্যাম্পাস খোলার দাবি নিয়ে মাঠে কথা বলে যাচ্ছেন। সমপ্রতি নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা নঈম জাহাঙ্গীর ছাত্র অধিকার পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মুহাম্মদ রাশেদ খান ও ইসতিয়াক আজিজ উলফাতসহ একটি শ্রেণি প্রকাশ্যে ও পর্দার আড়ালে ছাত্রদলের মাঠে নামা নিয়ে কাজ করছেন। কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো একটি আন্দোলন চাচ্ছেন।

সরকারবিরোধী অংশটি মনে করছে, দেশের প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী সরকারের উপর ক্ষোভ। অনেকের জীবন তছনছ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা হারিয়ে ফেলছে করোনার এই দীর্ঘ সময়ে। জীবনাবসানের ঘটনাও ঘটেছে। এ জন্য সরকারবিরোধী একটা গণবিস্ফোরণ একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এ নিয়ে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা-মামলা বন্ধ করতে হবে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের নামে কোনো মামলা হবে না বললেও  তিন বছর ধরে সেই মামলা ঝুলছে। একইভাবে নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদ করায় গ্রেপ্তার ৫৪ জন ছাত্রের এখনো জামিন হয়নি। এই মামলাও প্রত্যাহার করা উচিত। ক্যাম্পাস খুলে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। না হয় আমাদের এ দেশে কাবুলের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হওয়া আশ্চর্য কিছু হবে না।’

ছাত্রলদলের সহ-সভাপতি মামুন খান আমার সংবাদকে বলেন, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় থাকায় এখন প্রায় মাঠের রাজনীতি নেই। তবে মানুষের পাশে থাকার রাজনীতি ছাত্রদল করে যাচ্ছে। দুঃসময়ে মানুষের পাশে আছে। অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে দলের কাজ করে যাচ্ছে। আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে। আজ হাট-বাজার সব খোলা। যেখানে মানুষ শিক্ষিত নয়, সচেতন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীই সচেতন। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানবে শতভাগ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে সব সংগঠন মিলে একটা সুন্দর পরিবেশে ক্যাম্পাস রাজনীতি বজায় থাকবে। কিন্তু ছাত্রলীগের যদি ক্ষুধা বেশি থাকে নানা টেন্ডার বাণিজ্য করে, ভাই লীগ করে তাহলে হয়তো পরিবেশ নষ্ট হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী করোনার টিকার আওতায় এসে গেছে। আমরা প্রত্যাশা করি— খুব দ্রুতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সুসংবাদ পাবো এবং  উৎসবের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা ছাত্ররাজনীতি আবার ক্যাম্পাসে ফিরে আসবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর শিক্ষার্থীদের যেনো শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা থাকলে রাজনীতির সব ক্ষেত্রেই তার ভালো প্রভাব পড়তো। আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য যতটা না, তার চেয়ে বেশি হয়েছে নিজেদের সুবিধা প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই আমাদের দেশে মৌলিক রাজনীতি বলি আর ক্যাম্পাস রাজনীতি বলি তার কোনো গুণগত প্রভাব পড়ছে না।’

আমারসংবাদ/জেআই