Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন জরুরি

মোতাহার হোসেন

আগস্ট ২২, ২০২১, ০৬:১০ পিএম


বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন জরুরি
  • এবারের শোক দিবসের সর্বত্র একই আওয়াজ ওঠেছে— বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত শুধু খুনি নয়, নেপথ্যের কুশীলবদেরও দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। এ জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও নেতাদের মুখ থেকেও এ দাবি উঠেছে বেশ জোরালোভাবে। তাই জাতিকে সম্পূর্ণরূপে কলঙ্কমুক্ত করতে হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের  মুখোশ ও মরণোত্তর বিচার হওয়া প্রয়োজন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিলো বৃষ্টিঝরা দিন। সেদিন শ্রাবণের এই দিনে বৃষ্টি নয়, ঝরেছিল জাতির জনকের রক্তবৃষ্টি। সেই থেকে প্রতি বছর এটি আমাদের ইতিহাসে একই সঙ্গে বেদনার, হূদয়ে রক্তক্ষরণের এবং কালো দিন। সেই দিন তার বুক থেকে রক্তগোলাপের মতো লাল রক্ত ঝরেছিল ঘাতকের বুলেটে। সেদিন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসগৃহে, ৩২ নম্বরের সেই বাড়িতে, আমাদের ইতিহাস তীর্থে, তিনি সেদিন কবরে শায়িত হয়েছিলেন কেবল তার নশ্বর শরীর নিয়ে, কিন্তু তার অবিনশ্বর চেতনা ও আদর্শ ছিলো মৃত্যুঞ্জয়ী। ঘাতকের সাধ্য ছিলো না ইতিহাসের সেই মহানায়কের অস্তিত্ব, আদর্শ ও চেতনাকে বিনাশ করা। আজ ইতিহাসের বেদনাবিধুর ও বিভীষিকাময় দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনের কালো রাত্রিতে ঘটেছিল ইতিহাসের সেই কলঙ্কজনক ঘটনা। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্র্রষ্টা, বাঙালি জাতির মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, অবিসংবাদিত নেতা, গণতন্ত্র, শান্তির, পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির মানসপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও নরপিশাচরা। সেদিন ঘাতকের বুলেটে নিহত হন তার স্ত্রী বঙ্গমাতা বেগম মুজিব। তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর অনুজ পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসের, ভগ্নিপতি পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু, ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, সেরনিয়াবাতের কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত, আবদুর নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনসহ সেদিন নিহত হন ২৬ জন। সেদিন আল্লাহর অসীম কৃপায় দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা।

সত্যিই আজ যে কাঁদারই দিন। সেই ভয়াল-বীভৎস ১৫ আগস্ট, সেদিন বাতাস কেঁদেছিল। শ্রাবণের বৃষ্টি নয়, আকাশের চোখে ছিলো জল। গাছের পাতারা শোকে সেদিন ঝরেছে অবিরল। সেদিন ঘাতচক্র মুছে দিতে চেয়েছিল রক্তের চিহ্নসহ জনকের লাশ। ভয়ার্ত বাংলায় ছিলো ঘরে ঘরে চাপা দীর্ঘশ্বাস, সেই শোক জেগে আছে রক্তরাঙ্গা ওই পতাকায়, সেই শোক অনির্বাণ এখনো বহমান এই বাংলায়। নদীর স্রোতের মতো চিরো বহমান কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে নিরন্তর এই শোকের আগুন। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ সমার্থক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা বাংলাদেশকে, দেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল, মুছে দিতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত এই দেশকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। কিন্তু চাইলেই সহজেই কি মুছে ফেলা যায় জনকের নাম আর জনকের স্বপ্নজাত দেশটিকে? দক্ষিণ এশিয়ায় পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে আমরাই একমাত্র জাতি যারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি একজন মানুষের ডাকে, একটিমাত্র রণমন্ত্র কণ্ঠে ধারণ করে। সেই মানুষটি হলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর সেই রণমন্ত্র  ছিলো ‘জয় বাংলা’। বিভিন্ন কবির অসংখ্য কবিতার পঙক্তিতে উঠে আসা সেই ধন্য পুরুষ স্বাধীন বাংলার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী। বাংলাদেশ ও বাঙালির জন্য গভীর মর্মস্পর্শী শোকের দিন, জাতীয় শোক দিবস। বাঙালি জাতি গভীর শোক আর শ্রদ্ধায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করছে।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম সেই পুরুষ তিনি, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে (১৯২০-১৯৭৫) স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন, যে বন্ধন কোনোদিন ছিন্ন হওয়ার নয়। আজীবন ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দরিদ্র-নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এমন এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, যার তুলনা বিরল। একজন প্রকৃত নেতার যেসব গুণাবলি থাকা প্রয়োজন, সব গুণ নিয়েই জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ। যার রাজনৈতিক জীবন ছিলো বহুবর্ণিল, যার কণ্ঠে ছিলো জাদু। যিনি রচনা করেছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাস। ঘাতকচক্র চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত করা, স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর নাম মানুষের হূদয় থেকে মুছে ফেলতে। কিন্তু এমন একজন রাষ্ট্রনায়ককে একটি জাতির হূদয় থেকে চিরতরে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু প্রতিটি উৎসবে, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, কর্মে ফিরে আসেন বারবার, সব সময়ে। কারণ তিনি যে মৃত্যুঞ্জয়ী। কবিতার ভাষায়— ‘এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান? যখন আমার পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ তাই শোকের দিবসে সারা দেশের পথে-প্রান্তরে লাখো-কোটি কৃতজ্ঞ বাঙালির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে কবি অন্নদা শঙ্কর রায়ের সেই বিখ্যাত পঙক্তিমালা— ‘যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরী মেঘনা বহমান / ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

বাংলাদেশের স্থপতির নির্মম-নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিচার পেতে বাঙালি জাতিকে ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কারণ জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে প্রতি পদে পদে খুনিদের দোসর ও মদতদানকারীদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজালে আটকে থেকেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাযজ্ঞের বিচার। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে জাতির জনকের হত্যার বিচার শুরু করেন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে মানবতার শত্রু নরপিশাচ বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। সর্বশেষ ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি আবদুল মাজেদকে এ বছর দেশে গ্রেপ্তারের পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে এ বছরের ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এখনো কয়েকজন খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে। ছয় খুনির ফাঁসি হলেও আজও নেপথ্যের কুশীলবরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বঙ্গবন্ধু হত্যাযজ্ঞের ‘মাস্টার মাইন্ড’ জিয়াউর রহমান, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন মহল দীর্ঘদিন ধরে এ অভিযোগ করে আসছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী, আসামিদের বক্তব্যেও জিয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়টি ওঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪৬ বছরের পথপরিক্রমায় জিয়াউর রহমানসহ অনেকের নাম এলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তা ছাড়া সপরিবারে জাতির জনককে হত্যায় ঘটনায় দেশি-বিদেশি চক্রও জড়িত ছিলো। তাই এ ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় আনাও সময়ের দাবি। তাই এবারের শোক দিবসের সর্বত্র একই আওয়াজ ওঠেছে— বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত শুধু খুনি নয়, নেপথ্যের কুশীলবদেরও দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। এ জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও নেতাদের মুখ থেকেও এ দাবি উঠেছে বেশ জোরালোভাবে। তাই জাতিকে সম্পূর্ণরূপে কলঙ্কমুক্ত করতে হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের  মুখোশ ও মরণোত্তর বিচার হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

আমারসংবাদ/জেআই