Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

জিয়ার কবর নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি

রফিকুল ইসলাম

আগস্ট ২৮, ২০২১, ০৬:৩০ পিএম


জিয়ার কবর নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি
  • মানুষ প্রেসিডেন্টের জানাজা পড়েছে কিন্তু কফিনে লাশ ছিলো কি-না তা তো দেখাতে পারেননি —ওবায়দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
  • সংসদ ভবনের আশপাশ থেকে নকশাবহির্ভূত সব কাঠামোই সরিয়ে নেয়া হবে —আ ক ম মোজাম্মেল হক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী
  • চন্দ্রিমায় জিয়াউর রহমানের লাশ বহন করেছিলেন এরশাদ —মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

সংসদ ভবনের পাশে চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর বা সমাধি নিয়ে উত্তপ্ত দেশের রাজনীতি। কবরে লাশ থাকা না থাকা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা। বিএনপি বলছে, জনদৃষ্টি ভিন্ন খাতে সরাতেই সরকার চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমান কবর নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। উনার (জিয়ার) দাফন হয়েছে, লাখ লাখ লোক জানাজায় শরিক হয়েছে। এর চেয়ে বড় সত্য কিছু আর হতে পারে না। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কতটা দেউলিয়া হয়ে গেছে— এটা তারই প্রমাণ।

অন্যদিকে, সেদিনের কফিনে যে জিয়ার লাশ ছিলো, সেটা প্রমাণের জন্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। একই সঙ্গে ফের আলোচনায় উঠে এসেছে সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরানোর বিষয়টি। জিয়ার সমাধি সরিয়ে মার্কিন স্থপতি লুই ইসাডোর কানের মূল নকশা বাস্তবায়নের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরাও এ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন।

চন্দ্রিমা উদ্যানের কবরে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই বলে গত ২৬ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে রাখা বক্তব্যে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী বলেন, চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই, তা খালেদা জিয়াসহ বিএনপির নেতারাও ভালো করে জানেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে গিয়েও বিএনপি মারামারি করলো। তারা কি জানে না- সেখানে জিয়ার কবর নাই? জিয়া নাই ওখানে? জিয়ার লাশ নাই? তারা তো ভালোই জানে। তাহলে এত নাটক করে কেন?

এর আগে গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে যান দলটির ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের নবগঠিত কমিটির নেতারা। এসময় তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীসহ পুলিশের ১০ জন সদস্য আহত হন। ওই দিন পুলিশ-বিএনপির সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপি অভিযোগ করে, পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করেছে। কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে। রাবার বুলেটও ছোড়ে বলে অভিযোগ বিএনপির।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য দেয়ার পর সরগরম দেশের রাজনীতি। কবরে লাশ থাকা না থাকা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। আ.লীগের দাবি— চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কোনো লাশ নেই। কফিনে তার লাশ ছিলো না। গুলি খাওয়া লাশ তো দেখাই যায়। মৃত জিয়ার লাশ বিএনপি কি দেখেছে কখনো? কোনো একটা ছবিও কি কেউ দেখেছেন? বিএনপির কোনো নেতা দেখেনি। কারণ ওখানে কোনো লাশ ছিলোই না। তা বিএনপির নেতারাও ভালো করে জানেন, খালেদা জিয়াও ভালোভাবে জানেন। খালেদা ও তারেক জিয়া কি বলতে পারবে যে তারা তার (জিয়াউর রহমান) লাশ দেখেছে? মূলত- সেখানে জিয়াউর রহমানের কবর নাই? কোনো লাশও নাই। মানুষ তো নিহত প্রেসিডেন্টের জন্য জানাজা পড়তে এসেছিল। সেই কফিনে যে প্রেসিডেন্ট নেই, এটা তো আর মানুষ জানত না- যে এই কফিনে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই। সে সময় কফিনে থাকা জিয়াউর রহমানের লাশের ছবি দেখিয়ে প্রমাণ করার জন্য বিএনপির নেতাদের চ্যালেঞ্জ করেছেন আওয়ামী লীগে নেতারা।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের এমন বক্তব্যে জবাবে বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমান কবর নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ (এইচ এম এরশাদ) নিজে তার (জিয়াউর রহমান) বডি ক্যারি করেছেন। এর চেয়ে বড় সত্য কিছু আর হতে পারে না। এটা হচ্ছে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। তারা (বিএনপি) বলছে, আওয়ামী লীগ মূল জায়গায়টায় আসে না কেন! নির্বাচনটা কিভাবে করবেন! গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে শক্তিশালী করবেন! কীভাবে মানুষের ভোটের অধিকারগুলো ফিরিয়ে দেবেন! সেই কথাগুলোর আওয়ামী লীগ উত্তর দেয় না। তারা (আওয়ামী লীগ) ছবি দেখাতে চায়। এই ধরনের ইস্যুগুলো নিয়ে আসা মানে, তারা যে কতটা রাজনীতি শূন্য হয়ে গেছে; দেউলিয়া হয়ে গেছে রাজনীতিতে— এটা তারই প্রমাণ। জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে প্রশ্ন তোলা দেশের সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। জিয়াউর রহমান তো এদেশের মানুষের হূদয়ের মধ্যে আছেন। অযথা উনাকে (জিয়াউর রহমান) নিয়ে টানা, শেখ মুজিবুর রহমানকে টানা, এগুলো আমরা করতে চাই না। উনারা আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় নেতা। তাদের সেই জায়গাতেই রাখা উচিত।

জনদৃষ্টি ভিন্ন খাতে সরাতেই সরকার চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে প্রশ্ন তুলছে অভিযোগ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘উনার দাফন হয়েছে, লাখ লাখ লোক জানাজায় শরিক হয়েছে। তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ (এইচ এম এরশাদ) সাহেব নিজে তার (প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান) বডি ক্যারি করেছেন। ইট ইজ এ ওপেন ক্লিয়ার, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার- এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, সেখানে এই ধরনের ইস্যুগুলো নিয়ে আসা মানে, তারা যে কতটা রাজনীতি শূন্য হয়ে গেছে; দেউলিয়া হয়ে গেছে রাজনীতিতে— এটা তারই প্রমাণ।’ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) মূল জায়গায় আসে না কেন? নির্বাচনটা কীভাবে করবেন! গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে শক্তিশালী করবেন! কীভাবে মানুষের অধিকারগুলো, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেবেন, সেই কথাগুলোর তারা (সরকার) উত্তর দেয় না।’ ফখরুল বলেন, গতকাল আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল ওবায়দুর কাদের সাহেব বলেছেন, আমি নাকি তার কথার উত্তর দিই না। উনি কি পত্রিকা পড়েন? তার প্রত্যেকটা কথার উত্তর শুধু না, আমরা সঠিক সত্যকে তুলে ধরি সবসময়। উনি গতকাল বলেছেন, ছবি দেখাতে। কী বলব বলেন এখন? এসব কথার জবাব দিতে গেলে মানহানি মামলা করবেন। চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কবর প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ধর্মপ্রাণ মানুষের মনের ভেতরে আঘাত এসেছে যে, জিয়াউর রহমান সাহেবের মাজার সম্পর্কে যেসব কথা তারা বলেছে, এটা সাধারণ মানুষ কখনো ভালোভাবে নেয়নি। জিয়াউর রহমান তো এদেশের মানুষের হূদয়ের মধ্যে আছেন, মনের মধ্যে আছেন। আপনারা যদি কখনো শবেবরাতের রাতে ওদিকে মাজারে (চন্দ্রিমা উদ্যান) যান দেখবেন যে সাধারণ মানুষ এসে তার মাজার জিয়ারত করছে।’ তিনি বলেন, ‘অযথা উনাকে (জিয়াউর রহমান) নিয়ে টানা, শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে টানা এগুলো আমরা করতে চাই না। উনারা আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় নেতা। তাদের সেই জায়গাতেই রাখা উচিত। এটা জাতির জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুবই দুঃখজনক যে, এদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যাদের অবদান আছে, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতা- তাদের সম্পর্কে এই সমস্ত নোংরা কথা যখন বলা হয় তখন বুঝা যায় তারা কতটা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে, তাদের কোনো রাজনীতি নেই।’

‘জিয়াউর রহমানের জানাজায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে কফিনে জিয়ার লাশ ছিলো’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এতে কি প্রমাণিত হয়? মানুষ একজন প্রেসিডেন্টের জানাজা পড়েছে, কিন্তু কফিনে যে লাশ ছিলো তা তো দেখাতে পারেননি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের জানাজায়ও হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল কিন্তু কফিনে তো তার লাশ ছিলো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে এখনো দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্রের ছক আঁকা হচ্ছে উল্লেখ করে সেতুমন্ত্রী  বলেন, যারা সরকারের উন্নয়ন-অগ্রগতি সহ্য করতে পারে না, তারাই ষড়যন্ত্রের চোরাগলির মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে। বিএনপি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে লবিস্ট নিয়োগ ও অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।  দেশের অগ্রযাত্রা ও উন্নয়নকে বাঁচিয়ে রাখতে শেখ হাসিনা সরকারের পাশে থাকতে দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, জনগণের সমর্থন না পেয়ে ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটছে বিএনপি। তিনি বলেন, খুনি ঘাতকদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হচ্ছে বিএনপি। ইতিহাসে কার কি ভূমিকা তা সবই জানা আছে। বঙ্গবন্ধু তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবে উত্থান, তা অনেকেরই পছন্দ হয়নি উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, জেলের জাল পরিয়ে বাসন্তীকে দিয়ে নাটক সাজানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু সরকারের সুনাম নষ্ট করার জন্য তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার করা হয়।

অন্যদিকে, সংসদ ভবনের মূল নকশা অনুযায়ী এর চারপাশ থেকে নকশাবহির্ভূত সব অবকাঠামো সরিয়ে নেয়ার দাবি উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। সে ক্ষেত্রে চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে সরিয়ে নিতে হবে জিয়াউর রহমানের কবরও। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী শুধু জিয়ার কবর নয়, সংসদ ভবনের আশপাশ থেকে নকশাবহির্ভূত সব কাঠামোই সরিয়ে নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, জিয়াউর রহমানের খুনিরা যারা জিয়াকে হত্যা করেছে তারা সেই সময় দাবি করেছিলেন লাশ  পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমি আরেকবার বলি তার হত্যার সঙ্গে আমি একমত নই। তাহলে কী এনে দিলেন, বিএনপির উদ্দেশে মন্ত্রী এমন প্রশ্ন রাখেন। বলেন, দেখান তাহলে শরীর। আমি সংসদে বলেছি, ডিএনএ টেস্ট করার জন্য।  কী দিয়েছেন আর না দিয়েছেন আল্লাহ জানেন, আর যারা দিয়েছেন তারা জানেন। আমরা চ্যালেঞ্জ করি, সেখানে জিয়ার লাশ নেই।

আমারসংবাদ/জেআই