Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

বঙ্গবন্ধু: পানি আর নদীর সাথে ছিলো যার মিতালি

মো. কামরুল আহসান তালুকদার

আগস্ট ২৯, ২০২১, ০৭:১০ পিএম


বঙ্গবন্ধু: পানি আর নদীর সাথে ছিলো যার মিতালি

একজন আপাদমস্তক রাজনীতিক ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, প্রজ্ঞা  ও বুদ্ধিমত্তায় উপমহাদেশের সবচেয়ে অগ্রসরমান বাঙালি জাতিকে তিনি তাই প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র রাষ্ট্র উপহার দিতে পেরেছিলেন। বর্তমান বিশ্ব তাই তাকে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ বলে অভিহিত করে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লিতে জন্মগ্রহণ করেও তিনি কালে কালে হয়ে উঠেছিলেন আপামর বাঙালির ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা। ইতিহাস, রাষ্ট্র ও রাজনীতির বাইরেও পদ্মা-যমুনা-মেঘনা বিধৌত এই ভূখণ্ডের প্রকৃতি আর প্রতিবেশ সম্পর্কেও তার প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা বিস্ময়কর। বাংলাদেশ তথা এতদঞ্চলের নদ-নদী, খাল-বিলের সঙ্গে তার যে আত্মার সম্পর্ক, সমসাময়িক অন্যান্য রাজনীতিবিদের মধ্যে তা আমরা দেখতে পাই না। ভূপ্রকৃতির জ্ঞানও ছিলো তার অগাধ, তুলনাহীন। গেল শতাব্দীর ৫০ বা ৬০-এর দশকে কেবল আজকের বাংলাদেশ নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব প্রধান রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেখা যায়, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন নাগরিক আবহে বেড়ে ওঠা। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু ব্যতিক্রম। কারণ, তিনি পূর্ববাংলার জলহাওয়ায় কেবল বেড়েই ওঠেননি, একটি রাষ্ট্রের স্থপতি হয়েও নিভৃত পল্লি ও প্রান্তিক শিকড়কে ভুলে যাননি, স্মৃতিভ্রমও হননি কখনো। 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রায়ই নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন ‘পানির দেশের মানুষ’ হিসেবে। ৪০-এর দশকে রাজস্থানের মরু অঞ্চলে হ্রদ দেখে তার নিজের দেশের কথা মনে হয়েছে। তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখছেন : ‘পানির দেশের মানুষ আমরা। পানিকে বড় ভালবাসি। আর মরুভূমির ভিতর এই পানির জায়গাটুকু ছাড়তে কত যে কষ্ট হয় তা কি করে বোঝাব!’ 

বঙ্গবন্ধুর শৈশবে নদীর ভূমিকার কথা লিখেছেন তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে লেখেন— ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে।’ এখানে বঙ্গবন্ধুর আত্মকথনের ভূমিকা আমরা খুঁজে পাই। বঙ্গবন্ধু তো খাল, বিল আর নদী কিংবা মেঠোপথে চলতে চলতে বেড়েছেন টুঙ্গিপাড়ার ঘাস-পাতার সবুজ মায়ায়। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন বিষয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। নদ-নদীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যে আত্মিক যোগাযোগ— সেটা কেবল ব্যক্তিগত ভাবনায় নয়; তার রাজনৈতিক জীবনের উষালগ্ন থেকেই ফুটে উঠেছে। সংগঠন গোছাতে গিয়ে তাকে যেহেতু ঘন ঘন ভ্রমণ করতে হতো, সেখানে ৪০-৫০ দশকের নৌপথেরও জীবন্ত বর্ণনা আমরা দেখতে পাই তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। এক স্থানে তিনি লিখেছেন— ‘পরের দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চললো। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটি দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল নদীর ঢেউগুলিও যেন তার গান শুনছে।’ বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’ থেকে আরও দেখতে পাই নদীর এমন মনোমুগ্ধকর বর্ণনা । যেমন, চীন সফরে হংকং থেকে ক্যান্টন বা গুয়াংজু যেতে যেতে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি— ‘মনে হলো এ তো আমার পূর্ববাংলার মতো সকল কিছু। সবুজ ধানের ক্ষেত, চারদিকে বড় বড় গাছ। মাঝে মাঝে মাটির ঘরের গ্রাম, ছোট ছোট নদী, ট্রেনটা পার হয়ে যাচ্ছে।’ বঙ্গবন্ধু এমন বৃত্তান্ত লিখে গেছেন তার সদ্য প্রকাশিত বইগুলোতে।

বঙ্গবন্ধু তার পিতার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে বাড়ি রওনা করেছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন— ‘আমি স্টিমারে চড়ে বসলাম, সমস্ত রাত বসে রইলাম। নানা চিন্তা আমার মনে উঠতে লাগল। আমি তো আমার আব্বার বড় ছেলে। আমি তো কিছুই বুঝি না, কিছুই জানি না সংসারের। কত কথা মনে পড়লো, কত আঘাত আব্বাকে দিয়েছি; তবুও কোনো দিন কিছুই বলেন নাই। সকলের পিতাই সকল ছেলেকে ভালোবাসেন এবং ছেলেরাও পিতাকে ভালোবাসে ও ভক্তি করে। কিন্তু আমার পিতার যে স্নেহ আমি পেয়েছি, আর আমি তাকে কত যে ভালোবাসি— সে কথা প্রকাশ করতে পারবো না।’

‘ভোরবেলা পাটগাতি স্টেশনে স্টিমার এসে পৌঁছালো। আমার বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই মাইল হবে। স্টেশন মাস্টার ও অন্যান্য লোকদের জিজ্ঞাসা করলাম তারা কিছু জানে কিনা আমার আব্বার কথা। সকলেই এক কথা বলে— আপনার আব্বার খুব অসুখ শুনেছি। নৌকায় গেলে অনেক সময় লাগে। মালপত্র স্টেশন মাস্টারের কাছে রেখে হেঁটে রওনা করলাম। মধুমতি নদী পার হতে হলো। সোজা মাঠ দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করলাম। পথঘাটের বালাই নেই। সোজা চষা জমির মধ্য দিয়ে হাঁটলাম। বাড়ি পৌঁছে দেখি আব্বার কলেরা হয়েছে। অবস্থা ভালো না, ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। আমি পৌঁছেই ‘আব্বা’ বলে ডাক দিতেই চেয়ে ফেললেন। চক্ষু দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা। আমি আব্বার বুকের উপর মাথা রেখে কেঁদে ফেললাম। আব্বার হঠাৎ যেন পরিবর্তন হলো কিছুটা। ডাক্তার বললো, নাড়ির অবস্থা ভালো মনে হয়। কয়েক মুহূর্ত পরই আব্বা ভালোর দিকে। ডাক্তার বললেন, ভয় নাই। আব্বার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। একটু পরেই প্রস্রাব হলো। বিপদ কেটে যাচ্ছে। আমি আব্বার কাছে বসেই রইলাম। এক ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তার বললেন, আর ভয় নাই। প্রস্রাব হয়ে গেছে। চেহারাও পরিবর্তন হচ্ছে। দুই-তিন ঘণ্টা পর ডাক্তার বাবু বললেন, আমি এখন যাই, সমস্ত রাত ছিলাম। কোন ভয় নাই, বিকালে আবার দেখতে আসবো।’ গোপালগঞ্জ মহাকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের কনভেনর করা হয়েছিল কাজী আলতাফ হোসেনকে। লালবাগ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা শামসুল হক সাহেবের বাড়িও বঙ্গবন্ধুর একই ইউনিয়নে। মাওলানা সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য গোপালগঞ্জ মহাকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের কনভেনরকে সাথে নিয়ে নৌকায় রওনা দিয়েছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন— ‘আমরা দুইজন রাত দশটায় একটা এক মাঝির নৌকায় রওনা করলাম। নৌকা ছোট্ট, একজন মাঝি। মধুমতি দিয়ে রওনা করলাম। কারণ, তার বাড়ি মধুমতীর পাড়ে। মধুমতির একদিকে ফরিদপুর, অন্যদিকে যশোর ও খুলনা জেলা। নদীটা এক জায়গায় খুব চওড়া। মাঝে মাঝে সেই জায়গায় ডাকাতি হয়, আমাদের জানা ছিলো। ঠিক যখন আমাদের নৌকা সেই জায়গায় এসে হাজির হয়েছিল, আমি তখন ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পানির দেশের মানুষ নৌকায় ঘুমাতে কোনো কষ্ট হয় না। কাজী সাহেব তখনো ঘুমান নাই। এ সময় একটা ছিপ নৌকা আমাদের নৌকার কাছে এসে হাজির হলো। চারজন লোক নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করলো, আগুন আছে কি-না। আগুন চেয়েই ওই ডাকাতরা নৌকার কাছে আসে, এই তাদের পন্থা। আমাদের নৌকার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, নৌকা যাবে কোথায়। মাঝি বললো, টুঙ্গিপাড়া, আমাদের গ্রামের নাম। নৌকায় কে? মাঝি আমার নাম বললো। ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে ভীষণভাবে একটা আঘাত করে বললো, শালা আগে বলতে পারো নাই শেখ সাহেব নৌকায়! এ কথা বলে নৌকা ছেড়ে দিয়ে তারা চলে গেলো। মাঝি মার খেয়ে চিৎকার করে নৌকার হাল ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। মাঝির চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। কাজী সাহেব জেগে ছিলেন, তার ঘড়ি টাকা আংটি সবকিছুই লুকিয়ে ফেলেছিলেন ভয়ে। কাজী সাহেব শৌখিন লোক ছিলেন, ব্যবসায়ী মানুষ, টাকা-পয়সাও ছিলো অনেক। আমি জেগে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি? কাজী সাহেব ও মাঝি আমাকে এ গল্প বললেন। কাজী সাহেব বললেন, ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে, আপনার নাম করেই বেঁচে গেলাম, না হলে উপায় ছিলো না। আমি বললাম, বোধ হয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন ধরে নিয়েছে।’ ১৯৫০ সালে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন— ‘পাটগাতি স্টেশন থেকে আমরা উঠানামা করি। আমাকে সকলেই জানে। স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের বাড়ির খবর কিছু জানেন কিনা? যা ভয় করেছিলাম, তা-ই হলো, পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওনা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি, আরেক জাহাজে ওরা ঢাকায় গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হলো না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল।’ পূর্ববাংলার লোকদের সাথে নদীর কি সম্পর্ক— বঙ্গবন্ধু ‘আমার দেখা নয়াচীনে’ তা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি লিখেছেন— ‘নানকিং শহর নদীর পাড়ে। এখানে জাহাজে করে প্যাসেঞ্জার ট্রেন পার করা হয়। নামতে হয় না প্যাসেঞ্জারদের। ট্রেনটা এপার থেকে জাহাজে করে ওপারে চলে যায়, আমরা দেখতে পেলাম। পীর সাহেবও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইয়েরা নদীর পাড়, বিরাট নদী, নদীর পাড়ে কারখানা, নদীর ঢেউ দেখতে ভালোবাসে। কারণ পাঞ্জাব ও সীমান্তের ভাইদের কপালে এসমস্ত কম জোটে। আমরা পূর্ববাংলার লোক নদীর পাড়ে যাদের ঘর, নদীর সাথে যাদের বন্ধুত্ব, ঢেউয়ের সাথে যাদের কোলাকুলি, তারা কি দেখতে ভালোবাসে এগুলি? তাই পীর সাহেবকে বললাম, চলুন, বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যাই। খাবার সময় প্রায় হয়ে এলো। আমরা হোটেলে ফিরে এসে খেলাম, তারপর আবার বেরিয়ে পড়লাম নানকিং বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে।’ বঙ্গবন্ধু নৌকা খুব ভালো চালাতে পারতেন। আমার দেখা নয়াচীনে এ বিষয়ে ভালো ধারণা পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন— ‘আমাদের জন্য চারখানা নৌকা ঠিক হলো। নৌকার ভিতরে চারজন করে বসতে পারে। মোটর গাড়ির মতো গদি দেওয়া বসবার জায়গা। আমাদের সাথে চা, ফল-ফলাদি কিছু নেওয়া হয়েছিল। নৌকা ছাড়া হলো। আমাদের মধ্যে অনেকে নৌকা বাইবার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। অনেকে চেষ্টা করল দাঁড় টানতে, হাল ধরতে, কেউই ঠিকমত নৌকা বাইতে পারে না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, তোমরা বালুর দেশের লোক, নৌকা বাইবা কী করে? ঘোড়া দাবড়াতে পারো।’ ‘আমার নৌকায় সামনের যে দাঁড় ছিলো, প্রথমে আমি দাঁড়টা টানতে শুরু করলাম। কার নৌকা আগে যায় দেখা যাবে! কেউই পারে না; কারণ আমি পাকা মাঝি, বড় বড় নৌকার হাল আমি ধরতে পারি। দাঁড় টানতে, লগি মারতে সবই পারি। পরে আবার হাল ধরলাম। পাকা হালিয়া— যারা আমাদের নৌকার মাঝি, তারা তো দেখে অবাক! এ আবার কোন দেশের লোক! এক মাঝি জিজ্ঞাসা করলো, আপনাদের বাড়ি কোন দেশে? দোভাষী সাথে ছিলো, বললাম, পূর্ব পাকিস্তানে। মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মনে হলো কেনোদিন নামও বোধ হয় শোনে নাই, তাকে বুঝাইয়া বললাম, তারপর সে বুঝলো। তাকে বললাম, আমাদের পানির দেশ, বৎসরে ৬ মাস আমরা পানির মধ্যে বাস করি।’

লেখক : পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর একান্ত সচিব (উপসচিব) পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়

আমারসংবাদ/জেআই