মাহমুদুল হাসান
আগস্ট ৩০, ২০২১, ০৮:০৫ পিএম
কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল (সিপিএইচ)। মুছে গেছে পিছিয়ে পড়া হাসপাতালের তকমা। সেবায় এসেছে বড় পরিবর্তন। ক্যান্সার ছাড়া সব রোগের আধুনিক চিকিৎসা এখন এক ছাদের নিচে। আগামী বছর থেকে ক্যান্সার ও হূদরোগের আধুনিক চিকিৎসাও মিলবে এই সর্বাধুনিক বিশেষায়িত হাসপাতালে। ৭০ শয্যার মাধ্যমে ১৯৫৪ সালে যাত্রা শুরু করলেও এখন যোগ হয়েছে সাড়ে সাতশ শয্যা। সংযোজন করা হয়েছে আইসিইউও-এইচডিইউ শয্যা। শুধু পুলিশ বাহিনীর সদস্য ও পরিবার নয়; দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসে কর্মরত ও জনপ্রতিনিধিরা হাসপাতালটিতে সেবা পাচ্ছেন। সাধারণ মানুষসহ রাজনীতিক, আমলা, রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা করোনা চিকিৎসা নিচ্ছেন এখানে। কোভিডকালে সবচেয়ে বেশি রোগী কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে সুস্থ হয়েছে। সুস্থ হয়ে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন এর চিকিৎসা, আন্তরিক সেবাসহ সামগ্রিক পরিবেশের। মাত্র ছয় সপ্তাহে পূর্ণাঙ্গ কোভিড হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়। করোনার পাশাপাশি জরুরি বিভাগে অন্যান্য সেবাও মিলছে এখানে। বছরে দুই লাখ পুলিশ সদস্য, তাদের পরিবার ও আনসার বাহিনীর সহসদ্যসহ প্রায় ১০ লাখ মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে। পিছিয়ে থাকা একটি হাসপাতালের এগিয়ে আসার নেপথ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তত্ত্বাবধায়নে পুলিশপ্রধান ড. বেনজীর আহমেদের নেতৃত্ব। হাসপাতালটি পরিচালনায় রয়েছে ডিআইজি হাসানুল হায়দার। যার প্রচেষ্টায় একদল দক্ষ বাহিনী নিরলসভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের তথ্যমতে, ১৯৫৪ সালে রাজধানীর রাজারবাগে সাড়ে ১১ একর জমির ওপর ৭০ শয্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল। দীর্ঘদিন জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদির স্বল্পতার মধ্য দিয়ে দুর্বল চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চলছিল। এহেন অবস্থার প্রেক্ষিতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আধুনিক চিকিৎসাসেবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বাংলাদেশ পুলিশ হাসপাতালসমূহ আধুনিকায়ন (প্রথম পর্যায়ে সাতটি)’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেন। তার ঘোষিত প্রকল্পের আওতায় কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, রাজারবাগ, ঢাকায় ১০ তলা ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তার এই উদ্যোগের ফলে পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের চিকিৎসাসেবায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। প্রকল্পটি ১ জুলাই ১৯৯৭ইং তারিখে শুরু হয়ে ৩০ জুন ২০০৫ এ সফলভাবে সমাপ্ত হয়। চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধির সাথে সাথে চিকিৎসা প্রার্থীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বর্তমানে প্রায় দুই লাখ ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ প্রায় ১০ লাখ সদস্যের চিকিৎসাসেবা পুলিশ হাসপাতাল থেকে প্রদান করা হয়। এছাড়া আনসার বাহিনীর সদস্য ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মাচারীদেরও চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হয়। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের প্রতিদিন বহির্বিভাগে দুই থেকে তিন হাজার রোগী, ইমার্জেন্সি বিভাগে ২৫০ থেকে ৩০০ জন রোগী ও অন্তঃবিভাগে ৩৫০ থেকে ৫০০ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকে। গত বছর পর্যন্ত কোনো নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউ ছিলো না। বর্তমান পুলিশপ্রধানের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হয়েছে ১৫ বেডের আইসিইউ এবং ১৪ বেডের এসডিইউ। এখন এই হাসপাতালে ১৫০ জনের মতো চিকিৎসক রয়েছেন। কোভিডকালে ২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে আরও ৫০০ শয্যা সংযোজন করা হয়। হাসপাতালটিতে এখন রয়েছে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার। কিডনি রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস ইউনিট। সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৬০ স্লাইচ সিটিস্ক্যান মেশিন, এমআরআই মেশিন, ৪-ডি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন, ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন, ইকো-কার্ডিওগ্রাম ও ইটিটি সুবিধা। জরুরি রোগী সেবার জন্য চালু রয়েছে সার্বক্ষণিক ইমার্জেন্সি সার্ভিস। রয়েছে ডিজিটাল ম্যামোগ্রাফি। রোগীর জন্য রয়েছে ব্লাড ব্যাংক। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুরো হাসপাতালকে সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের কার্যক্রম ও রোগীর তথ্য ডিজিটাল ফরমেটে সংরক্ষণ ও মনিটরিং করার জন্য হসপিটাল ইনফরমেশন সিস্টেম, ল্যাবরেটরি ইনফরমেশন সিস্টেম সফটওয়্যার চালু করা হয়েছে। গেলো ফেব্রুয়ারিতে জরুরি বিভাগ ভবন নামে নতুন ভবনটিতে অত্যাধুনিক জরুরি ব্যবস্থাপনা, লাশ সংরক্ষণ, অর্থোপেডিক সার্জারি, মেডিসিন, আধুনিক ডেন্টাল চিকিৎসা, চোখ, নাক-কান-গলার সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি, কার্ডিওলজি-সিসিইউ, আইসিইউ, এইসডিইউ ছাড়াও রয়েছে ক্যান্টিন ও লাইব্রেরি। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পুলিশপ্রধান বলেন, রাজারবাগ হাসপাতালে সাধারণ মানুষও চিকিৎসা নিতে পারবেন। হাসপাতালে ক্যান্সার ছাড়া সব ধরনের রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকছে। আমরা অন্যান্য উন্নত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের সাথে এমওইউ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। সুযোগ সাপেক্ষে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে। এখানে হার্টের রিং পরানোর ব্যবস্থা করা হবে। আগামী বছর এ হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। সেই সাথে ক্যান্সার ইউনিট, ক্যাথল্যাব স্থাপনসহ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালকে বিশ্বমানের বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন আইজিপি।
করোনা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পুলিশের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে বাংলাদেশ পুলিশের জন্য উপযোগী গাইড লাইন তৈরি করা হয়। এরপর কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালকে ২৫০ শয্যার থেকে ৫০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা হয়, যা করোনা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ৭৫০ শয্যার ব্যবস্থা গড়ে রেখেছে। মাত্র তিন সপ্তাহে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের পাশাপাশি হাসপাতালে প্লাজমা ব্যাংক স্থাপন ও প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়। হাসপাতালটিতে করোনা চিকিৎসায় পর্যাপ্ত পরিমাণ উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সংযোজন করা হয়েছে। উন্নত ও মানসম্মত চিকিৎসা ও সেবায় হাসপাতালটিতে সুস্থতার হার দ্রুততার সঙ্গে বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়েছেন সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী। চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের (সিপিএইচ) ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা প্রটোকলের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এদিকে পুলিশ হাসপাতাল ও সশস্ত্র বাহিনীর চিকিৎসালয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল বা সিএমএইচকে একই রকম বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। চলতি বছর কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে কোভিড-১৯ টিকাদান কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও পুলিশ সদস্যদের তদারকির মাধ্যমে এই রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল আজ অত্যাধুনিক একটি হাসপাতালে পরিণত হয়েছে এবং এই সেবা যারা নিয়েছে, তারা সবাই মনে রাখবে। করোনা ভাইরাসের টিকা দেয়ার কার্যক্রমেও পুলিশ হাসপাতাল পিছিয়ে নেই।
আমারসংবাদ/জেআই