Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

শিশু ঝুঁকি নিয়ে বিতর্ক

সেপ্টেম্বর ৩, ২০২১, ০৭:৪৫ পিএম


শিশু ঝুঁকি নিয়ে বিতর্ক
  • টিকা নিচ্ছি আমরা আর ক্যাম্পাস খুলবে শিশুদের, আমরা শিশুদের ঝুঁকির পক্ষে নই —স্নাতক ও স্নাতকোত্তরদের দাবি
  • আমরা আশা করছি ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারবো —শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি
  • শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী যারা রয়েছেন তাদের আগে শতভাগ টিকা নিশ্চিত করতে হবে —মত বিশেষজ্ঞদের
  • সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রাখতে হবে
  • লক্ষণযুক্তদের ক্যাম্পাসের হোস্টেলে কোয়ারেন্টাইন করতে হবে
  • নিকটস্থ হাসপাতালের সাথে সরকারের তত্ত্বাবধানে চুক্তি রাখতে হবে
  • মহানগরী ও কিছু বড় শহরে বাচ্চাদের সংক্রমণে ঝুঁকি থাকবেই —ডা. বেনজির আহমেদ, সাবেক পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
  • প্রস্তুতি ছাড়া খুলে দিলে সব বন্ধ করে দিতে হবে এটিও মাথায় রাখতে হবে —ডা. মুশতাক হোসেন, উপদেষ্টা আইইডিসিআর

শিক্ষালয়ে আলো নেই ৫৩৮ দিন। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ। সরকার বারবার ঘোষণা দিয়েও খুলতে পারেনি শ্রেণিকক্ষের দরজা। গতকাল  শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আবারো জানালেন আশ্বাসের বাণী। আপাতত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে ক্লাস বন্ধ রেখে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেবেন। চাঁদপুর সদর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন আশা করছি ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে  পারবো। এরপর জনস্বাস্থ্যবিদ, অভিভাবক, শিক্ষক ও সচেতন মহল থেকে শুভেচ্ছার সঙ্গে নেতিবাচক দিকও সামনে আনা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে সরকারের প্রস্তুতি কতটুকু তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। আবার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ তাদের টিকা দিয়ে আগে শিশুদের কেন ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে। তারা বলছেন, যেখানে ভার্সিটি সবার আগে খোলার কথা, যেখানে ৬০ শতাংশ প্লাস স্টুডেন্ট ভ্যাকসিনেটেড করা হয়েছে, আর সেটা বাদ দিয়ে, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত খুলবে? এটা আশ্চর্য ও রহস্যজনক বিষয়। এই মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া মোটেও উচিত হয়নি। এখন যদি কোনো বাচ্চা আক্রান্ত হয় তাহলে এর দায়ভার কে নেবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, টিকা নিচ্ছি আমরা, আর ক্যাম্পাস খুলবে বাচ্চাদের। আগে আমাদের দিয়েই পরীক্ষামূলক ক্যাম্পাস খোলা হোক। শিশুদের ঝুঁকির পক্ষে আমরা নই।

অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, গবেষণা ও প্রস্তুতি ছাড়া ক্যাম্পাস খুলে অনেক দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে আবার বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তারা বলছেন, শিশুদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী যারা রয়েছেন তাদের আগে শতভাগ টিকা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা মহানগরসহ আরো কিছু বড় শহর রয়েছে যেখানে এখনো সংক্রমণ হচ্ছে সেখানে ঝুঁকি থাকবেই। তাই বাচ্চাদেরও ঝুঁকি থাকবে। যেখানে সংক্রমণ কম থাকবে সেখানে বাচ্চাদের ঝুঁকিও কম থাকবে। তাই বিপজ্জনক শহরগুলোতে সরকারের বিশেষ প্রস্তুতি থাকতে হবে। জনস্বাস্থ্যবিদরা আরো বলছেন, প্রস্তুতি ছাড়া ক্যাম্পাস খুলে দিলে সব বন্ধও করে দিতে হবে— এটিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তার আগে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এই প্রস্তুতিটা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে তা নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংক্রমিত হলে সাথে সাথে আইসোলেশনে রাখতে হবে। যারা লক্ষণ যুক্ত হবে তাদের সবাইকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন নেই। ক্যাম্পাসের হোস্টেলের ভেতরে রেখেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।  কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করতে হবে। গুরুতর অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নিকটস্থ হাসপাতালের সাথে আগে থেকেই একটা চুক্তি রাখা আবশ্যক। আর তা হওয়া উচিত সরকারের তত্ত্বাবধানে। যাতে আগে থেকেই আলাদা ব্যবস্থা রাখে তারা। যাতে অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি হতে পারে এবং কত ভাগ শিক্ষার্থী সংক্রমিত হলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে জনস্বাস্থ্যবিদদের সঙ্গে বসে তার একটা মানদণ্ড ঠিক করতে হবে।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ইউছুফ আলী বলেন, ‘শিল্পকারখানা, গণপরিবহন, শপিংমলসহ সবকিছু চলতে পারলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও চলতে পারবে। সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া নিয়ে এত টালবাহানা করার বা অযথা এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’ অন্যদিকে হোম ইকোনমিক্স কলেজের শিক্ষার্থী ফারজানা ফারিজা বলেন, ‘এই মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া মোটেও উচিত হবে না, এখন যদি কোনো বাচ্চা আক্রান্ত হয় তাহলে এর দায়ভার কে নেবে, তার জবাব আগে নিশ্চিত করা হোক।’ ফেনী কলেজের শিক্ষার্থী মারওয়া মুহাম্মদ বলেন, ‘বি-পজেটিভ প্লিজ, সবসময় নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে ঠিক কি কি ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে সেটা আসলে অনুমান করাও যায় না। সেখানে এটা খোলার যখন একটা ঘোষণা এসেছে তখন আমাদের সবার উচিত সেটাকে সাধুবাদ জানানো! কারণ নেতিবাচক চিন্তাভাবনায় অনেক সময় ইতিবাচক পদক্ষেপও বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে।’

অন্যদিক ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান বলেন, ‘টিকা নিচ্ছি আমরা, আর ক্যাম্পাস খুলবে বাচ্চাদের। আগে আমাদের দিয়েই পরীক্ষামূলক ক্যাম্পস খোলা হোক। শিশুদের ঝুঁকির পক্ষে আমরা নই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অপু চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘করোনা শনাক্তের হার ৫ শতাংশে নামার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে ভয়ানক এক সিদ্ধান্ত। আমাদের দেশের একেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাছের বাজারের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ভিড় হয়। ভারত-পাকিস্তানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মাসখানেক পর আবারো বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে, এবার হয়তো এটা আমাদের দেশেও হতে যাচ্ছে। আফসোস থাকবে— গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া ক্যাম্পাস খুললে শিশুদের বিপদে ফেললে।’ সাফি রহমান ইয়ামিন বলেন, ‘যেখানে ভার্সিটি সবার আগে খোলার কথা, যেখানে ৬০ শতাংশ প্লাস স্টুডেন্টকে ভ্যাকসিনেটেড করা হয়েছে, আর সেটা বাদ দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত খুলবে? এটা আশ্চর্য ও রহস্যজনক বিষয়।’ ইমতিয়াজ কবির বলেন, ‘আমেরিকায় পরীক্ষামূলক করেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ১৫ দিন পর দেখা গেলো সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা কোভিড-১৯-এ তো আক্রান্ত হয়েছেই, সাথে সাথে তাদের পরিবারের সদস্যরা এবং আশেপাশের লোকজনও আক্রান্ত হয়েছে। পরবর্তীতে সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বর্ণনায় বলা হয়েছে, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের শরীরে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি যার কারণে তারা বুঝতেই পারেনি যে, তারা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত।’

সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে একান্ত আলাপে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন আমার সংবাদকে বলেছেন, ‘একটা বিশেষ ঝুঁকি মোকাবিলা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এখন ৫ শতাংশের সাথে কোনো বিশেষত্ব নেই। প্রথম ঢেউয়ের সাথে তখন স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। আমাদের দেশে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সব কিছুই খুলে গেছে। আমাদের সরকার যদি মনে করে এখন সব কিছুর সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেয়া যায়, খুলে দেয়া নিরাপদ তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নিরাপদ। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে টিকা দিলেই হবে  না, আমরা দেখছি টিকা দেয়ার পরও সংক্রমিত হচ্ছে। আর আমাদের এখানে তো ১৮ বছরের নিচে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। তাই বলতে পারি যে টিকা নেয়ার বিষয়টি এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা মনে করেছিলাম টিকা নিলেই শতভাগ সুরক্ষিত, কিন্তু এখন সেটি আর আমাদের ধারণায় থাকছে না। টিকা নেয়ার পর আক্রান্তের বহু ঘটনা আমাদের সামনে এসেছে।’ ডা. মুশতাক হোসেন আরো বলেন, ‘এখন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে প্রস্তুতি নিতে হবে এটি ঠিক। আবার প্রস্তুতি ছাড়া খুলে দিলে সব বন্ধও করে দিতে হবে, এটিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এই প্রস্তুতিটা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে তা নয়। তারা এখানে সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংক্রমিত হলে সাথে সাথে আইসোলেশনে রাখতে হবে। যারা লক্ষণযুক্ত হবে তাদের সবাইকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন নেই। ক্যাম্পাসের হোস্টেলের ভেতরে রেখেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করতে হবে। গুরুতর অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নিকটস্থ হাসপাতালের সাথে আগে থেকেই একটা চুক্তি রাখা। যাতে আগ থেকেই আলাদা ব্যবস্থা রাখে। যাতে অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি হতে পারে এবং কত ভাগ শিক্ষার্থী সংক্রমিত হলে কোয়ারেন্টাইন করতে হবে জনস্বাস্থ্যবিদদের সঙ্গে বসে তার একটা মানদণ্ড ঠিক করতে হবে। সংক্রমণ যে কিছুটা হবে এটা অস্বীকার করা যাবে না। তাই কত ভাগ আক্রান্ত হলে পুরো ক্লাস বন্ধ করতে হবে তা আগ থেকেই ঠিক করতে হবে।’

রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘যেগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় সেগুলোর বাচ্চারা টিকা ছাড়াই যাবে। সেখানে হয়তো শিক্ষক-কর্মচারী যারা রয়েছেন তাদের আগে শতভাগ টিকা নিশ্চিত করতে হবে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানবেদে ঝুঁকি নির্ভর করবে। সেখানে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে সেখানে আক্রান্তও হতে পারে। যেখানে কম সেখানে ঝুঁকিও কম হবে। কিন্তু যেখানে ঝুঁকি সংক্রমণ সেটি নিয়ে অবশ্যই চিন্তা থাকে। যেমন ঢাকা মহানগরী আরো কিছু বড় শহর রয়েছে সেখানে এখনো সংক্রমণ হচ্ছে সেখানে ঝুঁকি থাকবেই। তাই বাচ্চাদেরও ঝুঁকি থাকবে। যেখানে সংক্রমণ কম থাকবে বাচ্চাদের ঝুঁকিও কম থাকবে।’

আমারসংবাদ/জেআই