Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

এজেন্টে অনাগ্রহ দালালদের

সেপ্টেম্বর ৬, ২০২১, ০৭:১৫ পিএম


 এজেন্টে অনাগ্রহ দালালদের

সেবাপ্রার্থীদের হয়রানির মূলহোতা দালালদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে নিয়োগের মধ্য দিয়ে আইনি বৈধতা দিতে চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এ নিয়ে ইতোমধ্যে নীতিমালা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। অথচ যে দালালদের নিয়ে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, সে দালালরাও দেখাচ্ছেন অনাগ্রহ। আবার কেউ কেউ বলছেন, এ উদ্যোগের মাধ্যমে অবৈধকে যেমন দেয়া হচ্ছে বৈধতা, তেমনি অনিয়মকেও নিয়মে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস এ উদ্যোগ। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের অনুমতি চেয়ে চিঠি দেয় পাসপোর্ট অধিদপ্তর।

জানা যায়, রাজধানীর আগারগাঁওসহ সারা দেশের পাসপোর্ট অফিসগুলোতে দালালদের দৌরাত্ম্য ও সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমাতেই ‘এজেন্ট’ হিসেবে নিয়োগ দিতে চায় সংস্থাটি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাসপোর্ট এজেন্ট লাইসেন্সিং নামে বিধিমালা তৈরির কাজও শুরু করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। তবে নতুন ব্যবস্থা চালু হলে সরকার নির্ধারিত যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেতে পারে। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের দাবি— পাসপোর্ট আবেদনের অতিরিক্ত চাপ কমাতেই এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তারা। যদিও এ পরিকল্পনা নিয়ে ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।  

গতকাল রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে সরেজমিন ঘুরে এবং বেশ ক’জন দালালের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস ঘিরেই প্রায় তিন শতাধিক দালাল সক্রিয়। যাদের সাথে আনসার সদস্য থেকে শুরু করে পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ রয়েছে। শুধু আগারগাঁওয়েই নয়, একই অবস্থা দেশের প্রায় সব পাসপোর্ট অফিসেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দালালের সাথে কথা হলে তারা জানান, এজেন্ট নিয়োগের কথা তারাও শুনেছেন। তবে আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কায় ‘এজেন্ট’ নিয়োগের এই উদ্যোগে আগ্রহ নেই তাদের। কারণ, সরকার নির্ধারিত ফিতে কাজ করলে তাদের পোষাবে না— এমন আশঙ্কাও করছেন তারা। এখন যেখানে প্রতি পাসপোর্টে তারা পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছেন, এজেন্ট নিয়োগের ওই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে তা আর পারবেন না বলেও জানান তারা।

তারা বলছেন, দেশের বহু মানুষ পাসপোর্ট ফরম পূরণ, ফরম জমা দিয়ে ছবি তোলা ও বায়োমেট্রিকের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া এবং ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার মতো সাধারণ এবং অত্যাবশ্যকীয় কাজে দালালদের সহায়তা নিয়ে থাকেন। আবার এই পাসপোর্ট করতে গিয়ে তাদের অনেকেই হন দালালদের হয়রানির শিকার— এমন অভিযোগও শোনা যায়। আর এক্ষেত্রে অভিবাসী শ্রমিকরাই বেশি ভুক্তভোগী।

এ ধরনের ঘটনা আগারগাঁওয়ে বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব জেলাতেই থাকা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসেও ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে। পাসপোর্ট করতে আসা মানুষকে জিম্মি করে দালালচক্র হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা। বিভিন্ন সময় দালালচক্রের হয়রানি ঠেকাতে অভিযান পরিচালনা করা হলেও কার্যত নির্মূল করা সম্ভব হয়নি আদৌ।

যদিও সম্প্রতি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাবের দালালবিরোধী বিশেষ অভিযান ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পাসপোর্ট অফিসসহ বিআরটিএ কার্যালয়, হাসপাতালসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে র্যাব। দেশব্যাপী এ অভিযানে ইতোমধ্যে দালালদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল-জরিমানাও করা হয়েছে।  

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়া চিঠিতে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর জানিয়েছে, অনেকে পাসপোর্টের আবেদনের নিয়ম জানে না। ঠিকমতো নাম-ঠিকানা লিখতে পারে না। ত্রুটিপূর্ণ আবেদনপত্র নিয়ে এসে হয়রানির শিকার হন। আবার দালালরাও এ সুযোগে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। তাই এ হয়রানি থেকে মুক্তির জন্য দালালদের মধ্য থেকে যোগ্যদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করতে চায় পাসপোর্ট অধিদপ্তর। প্রাথমিকভাবে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে এজেন্টদের যোগ্যতা নির্ধারণসহ একটি বিধিমালা করা হবে।

চিঠিতে আরও জানানো হয়, এজেন্টের মাধ্যমে পাসপোর্টের ফরম পূরণ ও আবেদন করতে সরকারি ফির বাইরেও গ্রাহকের অতিরিক্ত টাকা খরচ হতে পারে। খরচের মাত্রা চূড়ান্ত না হলেও তা অবশ্যই সরকারি ফির ১০ শতাংশের কম হবে।  

এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আদৌ দালাল কর্তৃক সেবাপ্রার্থীদের হয়রানির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব কি-না এবং সত্যিকার অর্থে দালাল নির্মূল হবে কি-না; এমন প্রশ্ন নিয়ে গত ৩১ আগস্ট থেকেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. মোকাব্বির হোসেনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সরাসরি সাক্ষাৎ চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলেও সচিবের একান্ত সচিব (সহকারী সচিব) এম ডি শামসুল আরিফীন বলেন, ‘এ বিষয়ে যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনি মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দেশের বাইরে সফরে আছেন।’ সচিব স্যার অফিসে থাকলেও অসুস্থ জানিয়ে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগ) আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী দেশের ফেরার পর কথা বলতে বলায় মন্ত্রণালয়ের কারো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।   

এ ছাড়া ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরীর মুঠোফোনেও একাধিকবার ফোন করে বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য নেয়া যায়নি। একই অবস্থা অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পাসপোর্ট, ভিসা ও ইমিগ্রেশন) সেলিনা বানুর ফোনেও। সুরক্ষা সচিব মো. মোকাব্বির হোসেনসহ পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক সবার মুঠোফোনই বন্ধ পাওয়া যায়।
 
তবে পাসপোর্ট অফিসে দালালদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগের এ প্রক্রিয়ার বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, ‘অবৈধকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। এটি অনিয়মকে নিয়মে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস, যা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যে উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে সে উদ্দেশ্য সফল হবে না।’

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়, তার অন্যতম মূল শক্তিই হলো দালাল। কিন্তু এরা এককভাবে কোনো কাজ করে না। এরা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশের মাধ্যমেই করে। কাজেই এদেরকে বৈধতা দেয়া মানে হচ্ছে— ত্রিমুখী চক্রের মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয় তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া।’ এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলেও মনে করেন তিনি।  

তিনি বলেন, ‘দালালরা যে কাজ করে, যেমন— ফরম পূরণ করা, ফরম জমা দিয়ে ছবি তোলা, বায়োমেট্রিকের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া, ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া, সেবাপ্রার্থীদের যারা এসব কাজ করতে সক্ষম নন তাদের সহায়তা দেয়া। যদি তাই হয়, তাহলে সারা দেশে যে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলো রয়েছে সেগুলোকে এ দায়িত্বটা দেয়া যেতে পারে। অন্যদিকে দালালসহ যারা অনিয়মে জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত।’