Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ঠুনকো মামলায় ভুগছে বিচারবিভাগ

সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


 ঠুনকো মামলায় ভুগছে বিচারবিভাগ
  • পান থেকে চুন খসলেই মামলা, আসামিও করা হচ্ছে ইচ্ছেমতো
  • মামলা নেয়ার আগে যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শ আইনজীবীদের
  • ছোটখাটো অপরাধ সালিশি পর্যায়েই শেষ করার তাগিদ আইনজ্ঞদের

প্রথমে কথা কাটাকাটি। তারপর হাতাহাতি ও মারমারি। মামলা সাজাতে হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসা সনদ নিয়ে মামলা দায়ের। দেশে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা করার প্রবণতা দিনদিন বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা। আপসযোগ্যে ধারার মামলাও বিচার প্রক্রিয়ায় এসে জটলা সৃষ্টি করছে। ফলে বাড়ছে মামলাজট।

আর অপ্রয়োজনীয় মামলার বিচার করতে হিমশিম খাচ্ছে আদালত। মামলাভারে ভারাক্রান্ত হচ্ছে বিচারবিভাগ। ফলে নানা বাস্তবতায় বিচারপ্রার্থীর অধিকারও যেন ভূলুণ্ঠিত, ব্যাঘাতগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়তই। আদালতগুলোতে তৈরি হচ্ছে বিচারপ্রার্থী মানুষের দীর্ঘ লাইন। বৈরী পরিস্থিতিতেও যেন এ লাইন কমছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিনা প্রয়োজনে বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিনই শত শত মামলা হচ্ছে। পান থেকে চুন খসলেই চলছে মামলা দায়ের।

মামলাই যেন সকল সংকট বা বিরোধের সমাধান। যখন ইচ্ছা তখনই যার তার বিরুদ্ধে নানা অজুহাতে ঠুকে দেয়া হচ্ছে মামলা। আসামিও করা যাচ্ছে ইচ্ছেমতো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই মামলার তদন্তে নেমে নাস্তানাবুদ। মামলাগুলো বিচারে গিয়ে আদালতকে করছে ভারাক্রান্ত। বাড়াচ্ছে হয়রানি ও জট। সরকারও মাত্রাতিরিক্ত মামলার বিচার-ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাচ্ছে। আদালতের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। বছর বছর নিয়োগ দিচ্ছে বিচারক এবং সহায়ক জনবল।

তবুও থামছে না মামলার স্রোত। উদ্বিগ্ন বিশ্লেষকদের তাই প্রশ্ন— সৃষ্ট জটের নিরসন কোথায়? মামলাজটের জন্য বিচারক স্বল্পতাকে দায়ী করা হয়। সমাধানও খোঁজা হয় আদালত সংখ্যা বৃদ্ধি, বিচারক এবং জনবল নিয়োগের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আদালতের সংখ্যা যতই বাড়ছে সমানভাবে বাড়ছে মামলার সংখ্যাও।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রুজু করা মামলাগুলো আগে আটকাতে হবে। গ্রাম্য আদালতকে আরও তৎপর করতে হবে। ছোটখাটো অপরাধ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সালিশি পর্যায়েই শেষ করে দিতে হবে এবং মামলা নেয়ার সময় থানা বা আদালতের উচিত প্রাথমিক একটা তদন্ত করা ও সত্যতা যাচাই করা। যাচাই-বাছাই এবং তদন্ত ছাড়া মামলা হলে এটা নকল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

কেউ থানায় গেলেন আর থানা মামলা নিয়ে নিলো এমন হওয়া যাবে না, এক্ষেত্রে থানা কর্তৃপক্ষকে আরও সচেতন হতে হবে এবং অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে মামলা গ্রহণ করতে হবে। তাতে বেহুদা মামলা যেমন কমবে তেমনি বিচারবিভাগও বাড়তি মামলার বোঝা থেকে রেহাই পাবে। অনেক সময় সামান্য পারিবারিক দ্বন্দ্বের বিষয় মামলা পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু এসব বিরোধ পারিবারিক সালিশের মাধ্যমেই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। এসব সমস্যা সমাধান করতে পারলেই অপ্রয়োজনীয় মামলা কমবে।

আইনজীবীদের মতে, যেহেতু মানুষের আক্রোশমূলক মিথ্যা মামলা দেয়ার প্রবণতা বেশি, তাই এটাকে আটকাতে হলে নতুন কোনো পন্থা অবলম্বন করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রশাসনকে আগে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে হবে, পরে মামলা গ্রহণ করতে হবে। আর দীর্ঘসূত্রতা এবং মামলাজটের কারণ শুধু বিচারক কিংবা সহায়ক কর্মচারী স্বল্পতাই নয়, বহুলাংশে দায়ী গোষ্ঠীগত স্বার্থ চিন্তা, নানামাত্রিক স্বার্থ সংরক্ষণ, দুর্নীতি এবং দুর্বল বিচারব্যবস্থাপনা। দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত এ সংকট থেকে সহসাই বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। সরকারের সদিচ্ছা, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের আন্তরিকতা এবং বিচারব্যবস্থার উন্নয়নের মধ্য দিয়েই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।

কমতে পারে মামলাজট : ‘জাস্টিস অডিট রিপোর্ট-২০১৯’র তথ্যমতে, ৬৮ শতাংশ মানুষ আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থায় ন্যায়বিচার পাবেন বলে বিশ্বাস করেন। বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে ৮৭ ভাগ বিচারপ্রার্থী স্থানীয়পর্যায়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে আগ্রহী নন। মাত্র ১৩ ভাগ মানুষ প্রাথমিকভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে রাজি। বাকি ৮৭ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার দ্বারস্থ হয়। তাতেই মামলাজট।

অডিট রিপোর্ট মতে, এভাবে জট বাড়তে থাকলে ২০২২ সালে মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত, দায়রা আদালত এবং হাইকোর্ট বিভাগে মামলার হার দাঁড়াবে যথাক্রমে ৭২, ৮০ এবং ৯০ শতাংশে। বিচারক নিয়োগ, আদালত বৃদ্ধি পাশাপাশি ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি-(এডিআর)’র প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। তাতেও লাগাম পড়ছে না মামলার সংখ্যায়। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, মামলাজট, কারণ ও প্রতিকারের সম্ভাব্য উপায় নিয়েই তৈরি হয়েছে এ ধারাবাহিক প্রতিবেদন।

জুডিশিয়াল রিফর্ম কমিটি ও জার্মান উন্নয়ন সংস্থার (জিআইজেড) তথ্য অনুযায়ী, মামলাজটে বিপর্যস্ত বিচারাঙ্গন। আপিল এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলা পাঁচ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪টি। নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলা ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৬টি। গেলো বছর নতুন মামলা দায়ের হয় চার লাখ ৪৭ হাজার ৮৫৪টি। বিপরীতে মামলা নিষ্পত্তি হয় দুই লাখ ৮৪ হাজার ১৩১টি। প্রতিদিন এ সংখ্যা বাড়ছেই।

সংস্থাটির তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ লোকের বিপরীতে বিচারক রয়েছেন মাত্র ১০ জন। যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ১০৭ জন। কানাডায় ৭৫ জন। ব্রিটেনে ৫১, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১, ভারতে ১৮ জন বিচারক। মামলা এবং বিচারকের এ অনুপাত দিন দিন বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বাড়িয়েই চলেছে। বাড়ছে হয়রানি, অপরিমেয় অর্থ ব্যয়। শিকার হচ্ছেন প্রতারণা, জাল-জালিয়াতিসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনার।

আদালতসংশ্লিষ্ট বকশিশ ও অনৈতিক লেনদেনের সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত আদালতের পেশকার, উমেদার ও পিয়ন। মামলার নথি দেখা, হাজিরা দেয়া, ওকালতনামায় সই করা, জামিননামা দেয়া, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলাসংক্রান্ত যেকোনো কাজে ‘বকশিশ’ বা ‘খরচাপাতি’র নামে বিচারপ্রার্থীর কাছ থেকে আদায় করা হয় বাড়তি পয়সা।

এ ক্ষেত্রে কম এগিয়ে নন একশ্রেণির আইনজীবী এবং তাদের সহায়কগণ। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ আইনজীবীই সাধারণ একটি ‘যুক্তি’ দাঁড় করিয়ে নিয়েছেন। সেটি হচ্ছে, আইনজীবীরা চাকরি করেন না। মক্কেলরা টাকা না দিলে তারা চলবেন কি করে?

আদালতপাড়ায় রয়েছে টাউট, প্রতারকদের উৎপাতও। আইনজীবী, কখনোবা মানবাধিকারকর্মী, কখনোবা ‘জজ সাহেবের ঘনিষ্ঠ লোক’ পরিচয়ে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নেয় অর্থকড়ি। অথচ এ বিষয়ে বিচারিক ব্যবস্থাপনায় স্থায়ী কোনো সার্ভিলেন্স সিস্টেম নেই।

এভাবে জট নিরসন সম্ভব নয় বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মো. মাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, মামলার উৎসমূলে হাত দিতে হবে। মানুষ কেন মামলা করে তা আগে দেখতে হবে। মামলাজটের গুরুত্বপূর্ণ কারণ মানুষের অসহিষ্ণুতা। মামলা দায়েরের সহজলভ্যতা।

প্রয়োজন সদিচ্ছা ও আইন সংশোধন : ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’র প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মামলা রুজুর সময় প্রাথমিক বাছাই হওয়া প্রয়োজন। সত্যতা যাচাই করতে পারে পুলিশই।

এ বিষয়ে হাইকোর্টের অবজারভেশন রয়েছে। আমলযোগ্য ধারায় মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন তথা প্রাথমিক অনুসন্ধান করতে হবে। যেটি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ক্ষেত্রে রয়েছে। কিন্তু পুলিশ এটি প্রতিপালন করে না।

যেমন- একটি অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২০০ জনকে আসামি করা হলো। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুসারে মামলা গ্রহণকারী বাদিকে এ প্রশ্ন করবেন যে, ঘটনাস্থলে ওই ২০০ ব্যক্তিই উপস্থিত ছিলেন কি-না। এ প্রশ্নের উত্তর পেতে পুলিশকে ঘটনাস্থলে যেতে হবে। এতে কথায় কথায় গায়েবি মামলা দায়েরের সুযোগ থাকবে না। তিনি বলেন, প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দরকার আইনের সংশোধন।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি একান্ত প্রয়োজন। এতে তাড়াতাড়ি মামলা নিষ্পত্তি হবে। সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। মামলা ফাইল হলে এটা মীমাংসা করা যায়। পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ক্রিমিনাল মামলাও এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। এ ব্যবস্থা না হলে বিচারব্যবস্থায় ধস নামবে। জনগণ দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচার পাচ্ছে না। এডিআরের ফলে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মামলা করার প্রবণতা দূর হবে।