Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

অন্ধকারের ভেলকিতে গ্রাহক

নিজস্ব প্রতিবেদক

সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১, ০৬:১০ পিএম


অন্ধকারের ভেলকিতে গ্রাহক

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার মোহাম্মদপুরে রাসেলের বাসায় ঘণ্টাখানেক অভিযান চালানোর পর তাদের দুজনকে র‍্যাবের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তার করে তাদের র‍্যাব সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে স্যার সৈয়দ রোডের একটি ৯তলা ভবনের চতুর্থ তলায় রাসেলের ফ্ল্যাটে তাদের অভিযান শুরু হয়।

পরে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে রাসেল ও তার স্ত্রীকে বাসা থেকে বের করে র‍্যাব সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতারণার অভিযোগে এক গ্রাহকের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান খায়রুল ইসলাম।

অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়িক বিভিন্ন ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে, সেগুলো জব্দ করে নিয়ে এসেছি। এখনো পর্যন্ত তার বাসায় ব্যবসায়িক ডকুমেন্টস ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি বলেও জানান তিনি।

এর আগে আরিফ বাকের নামে এক ব্যক্তি বৃহস্পতিবার ভোরে রাসেল ও শামীমার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় প্রতারণার মামলা করেন। পণ্যের জন্য আগাম অর্থ দিয়ে পণ্য না পাওয়ার পাশাপাশি ‘প্রাণনাশের হুমকি’ দেয়ার অভিযোগ করা হয় সেখানে।  

মামলার বাদি আরিফ বাকের তার অভিযোগে বলেন, ‘ইভ্যালির বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হয়ে তিনি তিন লাখ ১০ হাজার টাকার পণ্যের অর্ডার দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় তাকে কোনো পণ্য সরবরাহ করা হয়নি।

পণ্যের ব্যাপারের ইভ্যালির অফিসে এবং পরে সিইও মো. রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘প্রাণনাশের হুমকি’ দেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। প্রতারণা ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগে ইভ্যালির এমডি রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে এর আগেও কয়েকটি মামলা হয়েছে বিভিন্ন জেলায়।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে মাত্র আড়াই বছরের মাথায় সরবরাহকারী কোম্পানি ও গ্রাহকদের কাছে ৫৪৩ কোটি টাকার দায়ে পড়েছে ইভ্যালি। এত অল্প সময়ে এই বিপুল টাকা কোথায় গেলো, তার হদিস এখনো মেলেনি।

আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত জুলাই মাসে দুদকের আবেদনে ইভ্যালির শীর্ষ কর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। একই বছরের ২৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেলের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে, দুই কর্ণধার গ্রেপ্তারে অন্ধকারে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির ‘ইভ্যালি ভেলকি, পুরা দুনিয়া টাশকি’ শিরোনামের লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়া গ্রাহকরা। রাসেলও নাসরিনকে গ্রেপ্তারে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।

গতকাল র‍্যাবের অভিযানের খবর পাওয়ার পরপরই রাসেলের মোহাম্মদপুরের বাসা এবং ধানমন্ডিতে ইভ্যালির কার্যালয়ে শত শত গ্রাহক ভিড় জমান। তাদের মধ্যে অনেকেই ইভ্যালির কাছে টাকা দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, হারিয়েছেন সর্বস্ব। অনেকেই লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন। গ্রেপ্তার খবরের পরপরই রাস্তার পাশে জড়ো হতে থাকেন শত শত গ্রাহক। গ্রেপ্তার করার বিপক্ষে তারা ক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

তারা বলেন, ইভ্যালিতে বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত দিয়ে রাসেলকে গ্রেপ্তার করতে হবে।

এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আমরা কোনো গ্রেপ্তার চাই না। আমরা চাই রাসেল ভাই সময় চেয়েছে আমরা সময় দিতে রাজি আছি।’

আরেকজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমরা তার গ্রেপ্তারের খবর শুনে এসেছি। আমরা উনার (রাসেলের) গ্রেপ্তার চাই না। আমরা উনাকে সময় দিতে চাই। রাসেলকে সময় দেয়া হলে গ্রাহকরা উপকৃত হতো।’

আরেক গ্রাহক বলেন, ‘এতদিন পর কেন উনাকে অ্যারেস্ট করতে হবে। গত বছর যখন উনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো ওপেন করে দেয়া হলো তখন তো সবাই আবার কনফিডেন্টলি বিনিয়োগ করলো। এতগুলো মানুষের টাকা অনিশ্চিত হয়ে গেলো। সরকার শুধু গ্রেপ্তার করেই দায় সারতে পারবে না। আমরা আশা করি, আমরা যারা টাকা পাই তাদের টাকা পরিশোধ করার ব্যবস্থা করবে সরকার।’

তানভীর আহমেদ নামে একজন গ্রাহক বলেন, ‘আমার ৮০ হাজার টাকার গ্রোসারিজ আইটেম এবং একটি বাইকের অর্ডার ছিলো। একটু আগে দেখলাম ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাসেল গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাই এখানে দেখতে এলাম, জানি না এখন কী হবে!’

হাসান নামে আরও একজন বলেন, ‘আমি ধার করে টাকা নিয়ে একটি বাইকের অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু এখনো বাইক পাইনি। এখন পর্যন্ত ঝুলে রয়েছে। এখন আমার বেতনের টাকা দিয়ে ধার পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা সবাই খুবই চিন্তিত। আজকে আবার রাসেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জানি না এরপর কী হবে। আমরা আমাদের পণ্য অথবা টাকাগুলো ফেরত পাবো কি-না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইভ্যালি এমডি রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের গ্রেপ্তারে গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যুবক, ডেসটিনির মতো হতাশ হয়ে ফিরতে হতে পারে ইভ্যালির গ্রাহকদের। এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাত ১২টার দিকে আরিফ বাকের নামে এক ভুক্তভোগী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর লিখিত আবেদন জমা দেন। বৃহস্পতিবার অভিযোগটি নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গুলশান থানার ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) আনিন্দ্য।

আবেদনের অভিযোগে জানা যায়, ইভ্যালির চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আরিফ বাকের ও তার কয়েকজন বন্ধু চলতি বছরের মে ও জুন মাসে কিছু পণ্য অর্ডার করেন। সব পণ্যের জন্য নির্ধারিত টাকাও পরিশোধ করেন তারা। তবে ৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি করার কথা থাকলেও দিনের পর দিন পার হয়ে গেলেও পণ্য বুঝিয়ে দেয়নি ইভ্যালি।

পরবর্তীতে গত ৯ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির ধানমন্ডির অফিসে পণ্য চাইতে গেলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল ভুক্তভোগীকে পণ্য বুঝিয়ে না দিয়ে বরং ভয়ভীতি দেখান। মামলার এজাহারে রাসেল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় অপরাধের কথা বলা হয়েছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ধারাগুলো হচ্ছে— ৪২০, ৫০৬ ও ৪০৬।

দণ্ডবিধির ৪২০ নম্বর ধারাটিতে প্রতারণা করে সম্পত্তি বা অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ অপরাধে একজন ব্যক্তির সাত বছরের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড ও উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ৪০৬ নম্বর ধারায় বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে সর্বোচ্চ তিন বছর জেল, অর্থ জরিমানা ও উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।  ৫০৬ নম্বর ধারায় ভিক্টিমকে ‘হত্যা বা আঘাত করার ভয়ভীতি’ দেখানোর অপরাধের কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর নির্ধারণ করা আছে।

দুদক সূত্রমতে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৪ জুলাই দুদককে এ ব্যাপারে অনুসন্ধানের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে ইভ্যালির অগ্রিম নেয়া ৩৩৯ কোটি টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ওই চিঠি দেয়।

এরপর গত ২ সেপ্টেম্বর ‘আত্মসাত ও পাচারের’ অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালি সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত চেয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) নাসরিন ও রাসেলের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেয়। এছাড়া গত ১৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ১০ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত কমিটি।

এর আগে ১৩ আগস্ট ইভ্যালিকে চিঠি দিয়ে ১৫ জুলাই পর্যন্ত কোম্পানির সম্পদ ও দায়ের বিবরণ, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির দেনার বিবরণ জানতে চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে সময় চেয়ে আবেদন করে ইভ্যালি। সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এছাড়া ২৬ আগস্ট দেয়া হিসাবে ইভ্যালি জানিয়েছিল, গ্রাহকরা তাদের কাছে ৩১১ কোটি টাকা পাবে। গ্রাহকের পাওনার সমপরিমাণ টাকা পণ্য কেনার জন্য অগ্রিম মূল্য বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে।

এর আগে ১৯ আগস্ট ইভ্যালি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের এই দায় ও সম্পদের তথ্য দেয়। ওই সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

এসময় তিনি বলেছিলেন,  ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৫৪২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। হাফিজুর রহমান আরও বলেন, ইভ্যালি তাদের সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছে ১০৫ কোটি। কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু দেখিয়েছে ৪২২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সেভাবেই তারা তাদের ব্যালেন্সশিট মিলিয়েছে।

জানা গেছে, ইভ্যালির ৫৪২ কোটি ৯৯ লাখ টাকার দেনার বিপরীতে ব্র্যান্ড ভ্যালু দেখানো হয়েছে ৪২২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অদৃশ্য সম্পদ দেখানো হয় ১৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং দৃশ্যমান সম্পদের হিসাব দেখানো হয়েছে ১০৫ কোটি ৫৪ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪০ টাকা।