Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

পুলিশের ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময়ে নতুন পথের দিশা

আব্দুল্লাহ আল জাবেদ

সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১, ০৬:৫০ পিএম


পুলিশের ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময়ে নতুন পথের দিশা

রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে গড়ে উঠেছে পুলিশের অত্যাধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’। পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে ১ অক্টোবর এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে।

ওয়েসিস-এর বাংলা অর্থ মরুদ্যান। রুক্ষ বৃক্ষহীন মরুভূমিতে এক টুকরো সবুজ। দেশে যখন মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে খাঁ খাঁ অবস্থা, তখন ঊষার মরুভূমির মধ্যে সবুজ আর বালিবিন্দু নিয়ে আসছে পুলিশের অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি।

কর্তৃপক্ষ বলছে, অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ও নান্দনিক পরিবেশে উন্নত ব্যবস্থাপনায় দেশের সবচেয়ে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র হবে এটি। ইতোমধ্যে গত ২০ সেপ্টেম্বর থেকে এখানে রোগী ভর্তি শুরু হয়েছে। পোস্তগোলা ব্রিজ পার হয়ে এক কিলোমিটার গেলেই চোখে পড়বে ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন  কেন্দ্র।

সম্পূর্ণ অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) ড. বেনজীর আহমেদের প্রচেষ্টায় প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাজ তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান ও একদল দক্ষ কর্মী।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘মাদকাসক্তদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।      

এখানে সুন্দর ও নান্দনিক পরিবেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে।’ স্বনামধন্য টেকনিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ কেন্দ্র। তুলনামূলক কম খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসা দেয়া হবে এখানে।

আইজিপি মনে করেন, মাদকাসক্তদের উন্নত চিকিৎসার জন্য আর বিদেশে  যেতে হবে না। দেশের অনেক মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসার নামে নির্যাতন করার অভিযোগ আছে। কোনো  কোনো নিরাময় কেন্দ্রে মানসম্মত চিকিৎসা তো দূরের কথা, অপচিকিৎসা-নির্যাতনে রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। এ প্রেক্ষাপটে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়।

জানা গেছে, ওয়েসিস মাদক নিরাময় কেন্দ্রে থাকবে অত্যাধুনিক ডোপ টেস্ট মেশিন ‘গ্যাস প্রমোটো গ্রাফি’। বর্তমানে শুধু প্রস্রাব পরীক্ষা করে ডোপ টেস্ট করা হয়। কিন্তু ‘গ্যাস প্রমোটো গ্রাফি’তে চুল ও নাক থেকেও পরীক্ষা করা যাবে। বর্তমানে মাদক গ্রহণের তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু আধুনিক এই মেশিনে মাদক গ্রহণ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করলে প্রমাণ ধরা পড়বে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাত তলাবিশিষ্ট আধুনিক এই মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি খোলা থাকবে ২৪ ঘণ্টা। ৬০ শয্যার এই কেন্দ্রে আছে ২২টি কক্ষ। পুরুষদের জন্য ১৬টি কক্ষে থাকছে ৪৬টি শয্যা। মহিলাদের ছয়টি কক্ষে শয্যা ১৪টি। ডাবল কেবিনে ২৮টি, ট্রিপল কেবিনে ১৫টি এবং জেনারেল ওয়ার্ডে আছে ১১টি শয্যা। এছাড়া জেনারেল ট্রিপল বেড আছে ছয়টি। জেনারেল ওয়ার্ড ছাড়া সব ওয়ার্ড বা কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।

আধুনিক সব প্রযুক্তি : প্রায়ই দেশের মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই কেন্দ্রের রুমগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে কেউ আত্মহত্যা করার সুযোগ পাবেন না। সিলিংফ্যানের বদলে বিশেষ ফ্যান স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে ঝুলে আত্মহত্যা করা সম্ভব নয়। ২০ কেজি ওজনের বেশি কিছু ঝুললেই ভেঙে পড়বে ফ্যান। প্রতি রুমে রয়েছে অ্যাটাস্ট বাথরুম। কেউ যাতে বাথরুমে গিয়ে আত্মহত্যা করতে না পারে সেজন্য তাতে লক সিস্টেম রাখা হয়নি। বাথরুমগুলোর দরজায় লাগানো হয়েছে ম্যাগনেট।
এছাড়া প্রতি ফ্লোরের সিঁড়িতে আছে বিশেষ লকের ব্যবস্থা। কোনো রোগী ইচ্ছা করলেই এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে অবাধে চলাচল করতে পারবে না।  

যেসব সুবিধা থাকছে : কেন্দ্রটির ভবনের ছাদে রয়েছে বাগান। ছাদবাগানে প্রাকৃতিক পরিবেশে খোলা আকাশের নিচে রোগীরা বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইয়োগা ও মেডিটেশন করবে। ছাদবাগানের পাশে রয়েছে ব্যায়ামাগার। ষষ্ঠ তলায় আছে নার্সিং স্টেশন। পঞ্চম তলায় বিশেষ কেবিন ও ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা। আছে লাইব্রেরি। আছে সাইকোলজি কাউন্সিলিং ও ফ্যামিলি কাউন্সিলিং এবং স্যাম্পল কালেকশন রুম। ওয়েসিসের স্যাম্পল কালেকশন রুমে কোনো ধরনের বেসিন, বাথরুম বা পানির ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এর ফলে কোনো টেকনিশিয়ান চাইলেও স্যাম্পলের সঙ্গে পানি জাতীয় কিছু মেশাতে পারবে না।

দক্ষ জনবল : ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে জনবল ৮৫ জন। এর মধ্যে একজন পরিচালক (এসপি পদমর্যাদার), তিনজন সহকারী পরিচালক, চারজন কো-অর্ডিনেটর এবং ২৭ জন নার্সিং অফিসার বা মেট্রন। এছাড়া হিসাব শাখায় দুইজন, নিরাপত্তা ও রিসিপশন শাখায় ১১ জন, কন্ট্রোল রুমে ছয়জন এবং প্রশাসন শাখায় জনবল আছে আরও ১৪ জন।

সমপ্রতি আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সুন্দর ও নান্দনিক পরিবেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসাসেবা দেবে ৬০ বেডের এই হাসপাতাল।

প্রকল্প বাস্তবায়নে যারা, তারা কী বলছেন : প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাজ তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কয়েক বছরের মধ্যে মানিকগঞ্জে আরও একটি অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। সেখানে ইতোমধ্যে ১০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। আরও জমি কেনা হবে। ওই কেন্দ্রটিতে সুইমিংপুল এবং গার্ডেনসহ নানা ধরনের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। প্রস্তাবিত কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে কিছুটা সময় লাগবে। এ জন্য আপাতত কেরানীগঞ্জে প্রকল্পটি শুরু করছি। সম্পূর্ণ অলাভজনক এই সেবা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ।

‘ওয়েসিসে আন্তর্জাতিক মানের সেবা পাবেন সেবাগ্রহীতারা’— এমন মন্তব্য করে ডিআইজি হাবিব বলেন, ‘আমাদের অনেক সফলতার মাঝে এ প্রকল্পটিও সফলতার মুখ দেখবে বলে আশা করছি।’ ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক পুলিশ সুপার ডা. এস এম শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাময় কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পটি শুরুর আগে আমরা বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। ওইসব কেন্দ্রে যেসব ত্রুটি চোখে পড়েছে, এই কেন্দ্রে সে ধরনের কোনো ত্রুটি রাখা হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন : পুলিশের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য পুলিশ যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে তা সত্যিই ভালো উদ্যোগ। আমরা এই উদ্যোগকে স্যালুট জানাই। ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে যে ডোপ টেস্ট মেশিন আনা হয়েছে সেটি অত্যাধুনিক।