Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

রেলে জনবল সংকট চরমে

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


রেলে জনবল সংকট চরমে

দীর্ঘদিন ধরেই জনবল সংকটে ভুগছে দেশের মুখ্য পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ে। সংস্থাটির এমন সংকটে দেখা দিয়েছে নানামুখী সমস্যা। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ১৩১টি স্টেশন। এক সময়ে ৭৮ হাজার জনবলের রেলওয়েতে বর্তমানে আছে মাত্র ২৫ হাজার। যে কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেককেই বাড়তি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অন্য দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে।

এ সমস্যা যখন চরমে, ঠিক তখনই আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে দীর্ঘদিন ধরেই রেল খাত নিয়ে আলোচিত হয়ে আসা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও। ঘটছে যথাসময়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনকে ‘বিলম্ব’ দেখিয়ে টিকিট ফেরত দিয়ে অর্থ আত্মসাতের মতো ঘটনাও। ছোটোখাটো অনিয়ম-দুর্নীতির এসব ঘটনায়ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। যার অন্যতম কারণ লোকবল সংকট।

রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, লোকবল সংকটের কারণে ছোটখাটো দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বিকল্প লোক দেয়ার মতো লোকও আমাদের নেই। যে কারণে অনেক কিছুই হজম করতে হচ্ছে আর এটাই হলো বাস্তবতা। অনেক অনিয়ম হচ্ছে, যার কারণে ইমিডিয়েটলি সাসপেন্ড করা উচিত। কিন্তু সাসপেন্ড করতে গেলেই স্টেশন চালানোর মতো লোক নেই; এতে ট্রেন চালানো বন্ধ হয়ে যাবে।

সম্প্রতি কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে ঘটেছে এমনই ঘটনা। রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় সংস্থাপন কর্মকর্তা আব্বাস উদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি দপ্তরাদেশের মাধ্যমে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারী ইদ্রিস আলীকে একই পদে বদলি করা হয় তেজগাঁও আর বিমানবন্দর স্টেশনের বুকিং সহকারী সোলায়মান হোসেনকে একই পদে বদলি করা হয় শায়েস্তাগঞ্জে। সোলায়মান এর আগেও শায়েস্তাগঞ্জে কর্মরত ছিলেন; প্রেষণে ঢাকায় আসেন।

কিন্তু এমন দপ্তরাদেশের পরও এখনো কেন তাদের বদলির আদেশ কার্যকর হচ্ছে না— জানতে গিয়ে জানা যায়, বদলির এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন তারা। এছাড়াও লোকবল সংকটের কারণও বদলির সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

বদলির আদেশই কেন জারি হলো— এমন প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, রেলের আয়ের অন্যতম উৎস টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রেও দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় রয়েছে কালোবাজারি ও অসাধুচক্র। যে চক্রে অধিকাংশ সময়ই খোদ রেলওয়েরই কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার প্রমাণ একাধিকবার উঠে এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। টিকিট বুকিং সহকারী থেকে শুরু করে রেলওয়ের কম্পিউটারাইজড সিট রিজার্ভেশন অ্যান্ড টিকেটিং সিস্টেমের অপারেটরও এ চক্রের সঙ্গে জড়িত। পরিমাণে কম হলেও তারাও আত্মসাৎ করছেন রেলের টাকা।

এও জানা গেছে, যথাসময়ে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনকেও ‘বিলম্ব’ দেখিয়ে টিকিট রিফান্ড করে সেই টাকা পকেটস্থ করছেন তারা। আর এমন ঘটনায় জড়িত ছিলেন কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশনের বুকিং সহকারী ইদ্রিস আলী ও সোলায়মান হোসেন। রেলওয়েকে ফাঁকি দিয়ে ইদ্রিস ও সোলায়মান টিকিট রিফান্ড করে পকেটস্থ করেছেন রেলের হাজার হাজার টাকা— যা ইতোমধ্যে তাদের কাছ থেকে আদায়ও করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, গত ২৮ মার্চ ৭৬৪ নং রেল চিত্রা যথাসময়ে খুলনার উদ্দেশে ঢাকা স্টেশন ছেড়ে যায়। ট্রেনটি যথাসময়ে ছেড়ে গেলেও ডিলে দেখিয়ে দুটি এসি কেবিনের টিকিট রিফান্ড করেন কমলাপুর রেলস্টেশনের বুকিং সহকারী ইদ্রিস আলী। রিফান্ডের মাধ্যমে ১০ হাজার ৬৮৬ টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি।

এ কাজে ইদ্রিস আলীকে সহায়তা করেন কম্পিউটারাইজড সিট রিজার্ভেশন অ্যান্ড টিকেটিং সিস্টেমের কম্পিউটার অপারেটর নিউটন। ঠিক একই সময়ে বিমানবন্দর স্টেশনের বুকিং সহকারী সোলায়মান হোসেনও দুটি টিকিট রিফান্ডের মাধ্যমে ১৪ হাজার ২৪৮ টাকা আত্মসাৎ করেন। তাকেও সহায়তা করেন কম্পিউটারাইজড সিট রিজার্ভেশন অ্যান্ড টিকেটিং সিস্টেমের কম্পিউটার অপারেটর রেজাউল করিম।

সূত্র আরও জানায়, করোনাকালীন সময়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের বিশেষ অডিটে ইদ্রিস আলী ও সোলায়মানের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর ইদ্রিস ও সোলায়মানের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা এবং অর্থ আদায়ের সুপারিশ করেন সরকারী পরিদর্শক (টিআইএ) মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন।

পাশাপাশি কম্পিউটারাইজড সিট রিজার্ভেশন অ্যান্ড টিকেটিং সিস্টেমের কম্পিউটার অপারেটর প্রতিনিধিদের সর্বোচ্চ সতর্ক করার সুপারিশ করেন তিনি। টাকা আত্মসাতের বিষয়টি ধরা পড়ার পর দুজনকে সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়। আড়াই মাস সাসপেন্ড থাকার পর দুজনই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে পুনরায় যোগদান করেন।

এছাড়া ইদ্রিস আলী ৯ বছর ধরে একই স্থানে বুকিং সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানা গেছে। যদিও তিন বছরের বেশি কেউ একই স্থানে চাকরি করতে পারবেন না বলে আইনে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এ নিয়ম মানা হয়নি ইদ্রিস আলীর ক্ষেত্রেও। আর সোলায়মান হোসেনও দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দর স্টেশনে বুকিং সহকারী হিসেবে কাজ করছেন।

অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বদলির আদেশ হওয়ার পরও ইদ্রিস আলী কীভাবে এখনো দায়িত্ব পালন করছেন— এমন প্রশ্নে কমলাপুর স্টেশনের মাস্টার আফছার উদ্দিন বলেন, বদলির আদেশ হওয়ার পর তিনি আপিল করেছেন। আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেটা আবার স্থগিত রেখেছেন।

জনবল সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি একাই ডিউটি করছি। আমার সহকারী মাস্টার নেই। লোকবল সংকট অবশ্যই আছে। যে কারণে শিপটে ডিউটি করারও সুযোগ নেই এবং তিনি একাই ডিউটি করছেন, তাই কাজের চাপও বেশি।

জানতে চাইলে বিমানবন্দর স্টেশনের মাস্টার হালিমুজ্জামান বলেন, সোলায়মানের বদলির আদেশটি বাতিল হয়েছে। যে কারণে তিনি এখনো দায়িত্ব পালন করছেন।

কিন্তু পরিমাণে কম হলেও তো তার বিরুদ্ধে টিকিট রিফান্ড করে রেলের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল— এমনটি জানালে তিনি বলেন, কেন আদেশ বাতিল হয়েছে, তা জানা নেই। আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। মাসখানেক হয়েছে।

অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পরও বদলির আদেশ কার্যকর হচ্ছে না কেন এবং আদেশ কেন স্থগিত করা হয়েছে— এমন প্রশ্নে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক সাদেকুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে বিভাগীয় প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) ভালো বলতে পারবেন। বিষয়টি তিনি সেভাবে মনে করতে পারছেন না। ঢাকা বিভাগীয় প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) শওকত জামিলের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।

তবে সার্বিক বিষয়েই রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, আমাদের অনেক ব্যত্যয় রয়েছে। লোকবল সংকটের কারণে ছোটখাটো দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বিকল্প লোক সেখানে দেব— সেই লোকবলও আমাদের নেই। এ কারণে অনেক কিছু আমাদের হজম করতে হচ্ছে, এটাই বাস্তবতা। অনেক অপরাধ হচ্ছে, যার কারণে ইমিডিয়েটলি সাসপেন্ড করা উচিত। সাসপেন্ড করতে গেলেও স্টেশন চালানোর লোক নেই, ট্রেন বন্ধ হয়ে যাবে।

জনবল সংকট নিরসনের বিষয়ে তিনি বলেন, লোকবলের অভাবে আমাদের ১৩১টি স্টেশনে বন্ধ হয়ে আছে। এক সময় রেলের লোকবল ছিলো ৭৮ হাজার। এখন আছে মাত্র ২৫ হাজার। দীর্ঘদিন রেলের কোনো নিয়োগবিধিও ছিল না। লোকোমটিভ মাস্টার, কারখানা, সিগন্যাল বেল্ট, ওয়েব্যান বলেন— সব ক্ষেত্রেই বিরাট এক ঘাটতি চলছে। এগুলো পূরণের জন্য আমরা নতুন নিয়োগবিধি করেছি। প্রথমে আমরা ২৩৫ সহকারী স্টেশন মাস্টার নেয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। বিভিন্ন পদে ৪৭ হাজার লোক আমরা নিয়োগ দেব। ২০ হাজারের মতো লোক আমরা এক-দুবছরের মধ্যে নিয়ে ফেলবো। একজন লোক নেয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই কাজে লাগানো যায় না, তার প্রশিক্ষণেরও দরকার রয়েছে।