Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

আস্থার সংকটে ই-কমার্স

নুর মোহাম্মদ মিঠু

অক্টোবর ৪, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


আস্থার সংকটে ই-কমার্স

গেলো কয়েক বছরে দুর্বল আর জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া ব্যবসার কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে অনলাইন প্লাটফর্মে ই-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা, তৈরি হয়েছে আস্থার সংকট। পাশাপাশি ঝুঁকিতে পড়েছেন কয়েক লাখ নতুন উদ্যোক্তা। এ অবস্থায় আস্থা পুনরুদ্ধারে বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন ও নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ যেমন বিশেষজ্ঞদের তেমনি গ্রাহকদেরও লোভ নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

যদিও হালের সংকটে সমগ্র খাতটির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়েই শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। গত কয়েক বছরে বিশেষ করে করোনাকালে দেশে খুব দ্রুতই ই-কমার্স খাতের প্রসার ঘটলেও সাম্প্রতিককালে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে বিকাশমান এই খাত, শুরু হয় নতুন অনিশ্চয়তার। বর্তমানে দেশে আনুমানিক দুই হাজার ৫০০ ই-কমার্স সাইট থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বা এফ-কমার্সের মাধ্যমে ব্যবসা করছেন প্রায় দুই লাখ উদ্যোক্তা।

অল্প দিনেই দেশের অর্থনীতিতে বড় সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা এ খাতে যেমন সৃষ্টি হয়েছে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের তেমনি সৃষ্টি হয়েছে নতুন উদ্যোক্তারও। অথচ এরই মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এমএলএম কোম্পানি, মাল্টিপারপাস বা সমবায় সমিতির নাম দিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে ঘটে যাওয়া প্রতারণার বহু নজিরের সাথে নতুন করে যুক্ত হলো ই-প্রতারণা।

চলতি বছর অন্তত ১১টি প্রতিষ্ঠানের নাম সামনে আসে, যারা গ্রাহকের সাথে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি। গ্রাহকের সঙ্গে ঠিকমতো পরিচিত হওয়ার আগেই অবিশ্বাস্য মূল্যছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয় নতুন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো।

গতকালও নতুন করে কিউকম নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত হয় প্রতারণার তালিকায়। যারা পণ্য দেয়ার নামে হাতিয়ে নিয়েছে গ্রাহকের ২৫০ কোটি টাকা। প্রতারিত হওয়া গ্রাহকদের করা মামলায় গ্রেপ্তারও হয় প্রতিষ্ঠানটির সিইও রিপন মিয়া।

এছাড়াও চুয়াডাঙ্গার ই-কমার্স সাইট জিওফির চটকদার বিজ্ঞাপনে হাজার হাজার গ্রাহক প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। অনিবন্ধিত এই প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ‘সিনেমা হলপাড়া, চুয়াডাঙ্গা’ দেয়া থাকলেও তাদের কোনো অফিসের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের প্রায় এক কোটিরও বেশি টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ই-কমার্সের বাজার দ্রুত বিস্তার লাভ করতে শুরু করে প্রায় পাঁচ বছর আগে থেকে। তিন বছর ধরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় শতভাগ। অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে খাতটি। করোনা পরিস্থিতিতে গত বছরের মার্চে সাধারণ ছুটি শুরু হলে ই-বাণিজ্যের বেশ প্রসার ঘটে। বর্তমানে এ খাতের আকার প্রায় আট হাজার কোটি টাকা।

২০২৩ সালের মধ্যে এটি ২৫ হাজার কোটির মাইলফলকে পৌঁছাবে বলেও ধারণা বিশ্লেষকদের। অথচ সম্ভাবনাময় এই খাত গত কয়েক মাসে বেশ টালমাটাল হয়ে পড়েছে জালিয়াতিতে জড়িয়ে। বিশেষ করে বেশ কয়েকটি নামি-বেনামি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার মধ্য দিয়ে বাড়তে থাকে অস্থিরতা। গ্রাহক ও মার্চেন্টের অর্থ লোপাটের কারণে ইতোমধ্যে আইনের আওতায় নেয়া হয়েছে বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির কর্ণধার রাসেলকে। প্রতিষ্ঠানটি অবিশ্বাস্য মূল্যছাড়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে পণ্য বিক্রি করতো।

যে কারণে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি ছিলো লোকসানি। এ ছাড়াও ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, দালাল ডটকম ছাড়াও আরও অসংখ্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা গ্রাহকদের সঙ্গে পণ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেয়।

তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৩০ হাজার অনলাইন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১০ থেকে ১২টির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।

তবে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের কারণে পুরো ই-কমার্স খাতকে দোষারোপ করতে চান না সংশ্লিষ্টরা। এর আগে নামি একটি এমএলএম প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে কোনো কাজে লাগানো হয়নি। সেগুলো দুষ্টচক্রের ভোগদখলে রয়েছে কিন্তু গ্রাহকরা তাদের পাওনা বুঝে পাননি আদৌ।

ই-কমার্স জালিয়াতির ক্ষেত্রেও যেনো এমনটা না হয় বরং গ্রাহকদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি সরকারকে বিবেচনার জন্য বলছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থ লোপাটকারীদের জেলে পাঠানোই সমাধান নয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যেনো শাস্তি পান এবং গ্রাহকরাও যেনো তাদের টাকা ফেরত পান, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত সরকারের।

এদিকে দেশের ই-কমার্স খাতে আস্থা ধরে রাখতে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় কিছুদিন আগে নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নির্দেশিকায় প্রধানত পণ্য সরবরাহ ও টাকা ফেরত দেয়ার সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে।

বলা হয়েছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। ভিন্ন শহরে অবস্থান করলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য স্টকে না থাকলে তার জন্য কোনো পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। আগাম পরিশোধ করা টাকা পণ্য সরবরাহের পরই বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে জমা হতে হবে। ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারি ম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো।

পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি ম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবেন। সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা সেবা ডেলিভারি ম্যানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় না থাকলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পণ্যমূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ অগ্রিম নিতে পারবে না। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসব নির্দেশনা শুধুই কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কতিপয় বিতর্কিত ই-প্রতিষ্ঠানের কাণ্ডে এই খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অর্ডার যেমন কমছে, তেমনি অগ্রিম পেমেন্টের সংখ্যাও কমেছে। বেড়েছে ক্যাশ অন ডেলিভারি-সিওডি।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আস্থার সংকটের কারণেই এমনটা হয়েছে। এই সংকট কাটতে সময় লাগবে। ছয় মাস থেকে এক বছর লাগবে। বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, যাদের গ্রাহক বেশি, তাদের খুব বেশি সমস্যা না হলেও ছোটদের ওপরে এর বেশ প্রভাব পড়েছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। নতুন গ্রাহক না আসার পাশাপাশি পুরোনো গ্রাহকরাও সরে যাচ্ছেন।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যতদিন না ম্যানুয়াল পদ্ধতি ছেড়ে পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর হবে, ততদিন এই খাতে সমস্যা থেকেই যাবে। ক্রমবর্ধমান ই-কমার্স খাতে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা ও প্রতারণা ঠেকাতে সরকার বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বলা হয়েছে, একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে; পাশাপাশি ডিজিটাল প্রতারণা হলে যেনো বিচার করা যায়, সে জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং মানি লন্ডারিং অ্যাক্টে কিছু সংশোধনী আনা হবে। প্রতিটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে বাধ্যতামূলক নিবন্ধন।