Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বিতর্কিতরা নৌকার মাঝি!

রফিকুল ইসলাম

অক্টোবর ১১, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


বিতর্কিতরা নৌকার মাঝি!

বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা সুবিধাবাদি, শান্তি কমিটি পরিবারের সন্তান, দুর্নীতির দায়ে দল থেকে বহিষ্কৃত, প্রধানমন্ত্রীর ঘর প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎসহ নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে যুক্তদের দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ তৃণমূলের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও দুর্দিনের নেতাকর্মীরা।

তারা বলছেন, যোগ্য ও সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যর্থতার দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে। আর বিতর্কিতরা মনোনয়ন পাওয়ায় দেখা দিয়েছে বিদ্রোহের শঙ্কা। বাড়তে পারে তৃণমূল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল।

খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার পাঙ্গাসী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পেয়েছেন রফিকুল ইসলাম খান নান্নু। তিনি আওয়ামী লীগের সুসময়ের বসন্তের কোকিল, বিএনপি পরিবারের সন্তান।

গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুকৌশলে স্থানীয় আওয়ামী লীগে প্রবেশ করেন রফিকুল ইসলাম খান নান্নু। দলের প্রভাবশালী নেতা ও সিন্ডিকেট তৈরি করে অল্পসময়ে বাগিয়ে নিয়েছেন নৌকার মনোনয়ন। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

তারা বলছেন, সুসময়ের বসন্তের কোকিলকে নৌকার মনোনয়ন দেয়ায় বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন হবে। পাঙ্গাসী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মোজাম্মেক হক বলেন, আওয়ামী লীগের সম্মান চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এমন প্রার্থী নির্বাচিত হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন মোটেও সম্ভব নয়।

প্রধানমন্ত্রীর ঘর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অসহায় ও দুস্থদের থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ছিলো সোনাখাড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. মোস্তফা কামালের (রিপন) বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মাঝে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। সেই বিতর্ক পেছনে ফেলে দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন রিপন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার বিশেষ তদবিরে ফের নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। জামায়াতের দাপুটে নেতার ছেলে মিজানুর রহমান এখন বড় আওয়ামী লীগার। অল্প সময়ে আদর্শ পরিবর্তন করে হয়েছেন নৌকার মাঝি। আসন্ন ধুবিল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনিই এখন আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি। অথচ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তার বাবার নেতৃত্বধীন জামায়াতের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

সর্বশেষ একাদশ নির্বাচনের আগেও মিজানুর রহমান ছিলেন ঘোর আওয়ামী লীগ বিরোধী। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে তা এখন শুধুই ইতিহাস। অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগে অভিযুক্ত যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত জাহিদ ভূইয়াকে নৌকার মাঝি করেছে আওয়ামী লীগ।

মানিকগঞ্জ সিংগাইর উপজেলার ধল্লা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তাকে নৌকার মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। বিতর্কিত জাহিদ ভূইয়া পুনরায় নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পাওয়ায় ধল্লা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, জাহিদ চেয়ারম্যানের গত পাঁচ বছরে অনিয়মের সাথে জড়িয়ে আমাদের ধল্লা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগকে ব্যাপক সমলোচনায় ফেলেছে। নষ্ট হয়েছে সরকারের ভাবমূর্তি। বগুড়ার সোনাতলা পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন শান্তি কমিটির সভাপতির ছেলে শহিদুল বারী খান রব্বানী। স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়ায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নসহ পুরো জেলায় জনগণের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার আঙ্গারিয়া ইউনিয়নে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন আসমা আক্তার। তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যই বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। গত একাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুুশ বিজয় অর্জন হলে তিনি ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। একই উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন মিজান মোহাম্মদ খান।

তিনি স্থানীয় বিএনপির বর্তমান কমিটিতেও বহাল রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া মাহমুদপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নৌকা পেয়েছেন শাহ আলম। তিনি একজন প্রবাসী এবং গত তিন বছরে একবারও এলাকায় আসেননি। যা নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন মনিরুল ইসলাম সেন্টু। কিছুদিন আগেও তিনি যুবদলের রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়।

এছাড়া আরও বেশকিছু স্থানে বিতর্কিত, বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সন্তান ও অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে যুক্তদের নৌকার মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অথচ বিতর্কিত নাম বাদ রেখে তৃণমূলের রেজ্যুলেশন পাঠানোর জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

আ.লীগ সূত্রে জানা যায়, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিতর্কিত, অনুপ্রবেশকারী, দলের সুনাম নষ্টকারী ও নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতিবাজ নেতাদের কেন্দ্রে না পাঠাতে কঠোর বার্তা দেয় আওয়ামী লীগ। দলের পরীক্ষিত, নিবেদিত, মেধাবী ও জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতাদের পক্ষপাতিত্ব করতে মানা করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় হুঁশিয়ারি দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্র কঠোর থাকলেও তৃণমূল থেকে অর্ধশতাধিক বিতর্কিত নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয় এবং তারা মনোনয়ন পেয়েছেন।

স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতাদের সরাসরি ইন্ধনে বাদ পড়েছে ত্যাগী, দুর্দিনের পরীক্ষিত নেতাদের নাম। তৃণমূল সূত্রে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অসন্তোষ তৃণমূল আওয়ামী লীগে। বিতর্কিতরা মনোনয়ন পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন তারা । ফলে দেখা দিয়েছে বিদ্রোহীর শঙ্কা। বাড়তে পারে তৃণমূল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দ্বন্দ্ব।  ফলে ভোটের মাঠে বিএনপি না থাকলেও প্রধান প্রতিপক্ষ হতে পারে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনের জন্য গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নামের তালিকা চেয়েছে আওয়ামী লীগ। অনিয়ম করে যারা প্রার্থীদের নাম কেন্দ্রে পাঠাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।

এদিকে দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন প্রাপ্তদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধেও পুনর্বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেবে আওয়ামী লীগ।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয় আওয়ামী লীগের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভা। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এই সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।