Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি বিস্ফোরণের আভাস

অক্টোবর ১২, ২০২১, ০৫:৩০ পিএম


ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি বিস্ফোরণের আভাস

বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কক্সবাজারের বড় অংশে ফিলিস্তিনি বিস্ফোরণের আভাস দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রত্যাবাসন ঠেকাতে ষড়যন্ত্রে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের পাশাপাশি মিয়ানমার সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর হাত রয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। কৌশলে ব্যবহার করা হচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের।

নারী, মাদক, অস্ত্রের ব্যবহার এখন প্রধান হাতিয়ার। স্থানীয়রা এখন সংখ্যালঘু, নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকেন। রোহিঙ্গাদের ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পর ওই রাজ্যে তাদের বসতি ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ৭২৮ গ্রাম ছিলো বর্তমানে তার কোনো অস্তিত্ব নেই।

গত চার বছরে মিয়ানমার এমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি, যা বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আদি নিবাসে ফিরতে উৎসাহিত করে। ইসরায়েলি বাহিনীর অধিকৃত এলাকার ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলো যেমন বিস্ফোরণোন্মুখ, সেই পরিস্থিতি যেনো কক্সবাজারে না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। রোহিঙ্গারা ৬০-৭০ বছরে রাখাইনে থেকে নাগরিকত্ব পায়নি। আর বাংলাদেশে বসে তারা নাগরিকত্ব পাওয়ার অতি প্রত্যাশাটা ঠিক নয়।

রোহিঙ্গাদের উচিত স্বাধীনতার দাবি নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাওয়া, তাদের ভূখণ্ড নিজদের অধীনে নেয়া। আর তা না হলে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রতি বছরই প্রায় ২৯ হাজার শিশু নতুনভাবে বাংলাদেশের মাটিতে জন্মগ্রহণ করছে। তাদের পরিচয় কী হবে তা এখনো অজানা।

অন্যদিকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের উগ্রবাদিতা, সাংঘর্ষিক সংস্কৃতি দেশের নাগরিকের ওপরও প্রভাব ফেলছে। সমপ্রতি স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উদ্যেক্তা মাস্টার মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর উগ্রবাদিতার আরও বড় লক্ষণ দেখছেন সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।

ক্যাম্পে ক্যাম্পে অবৈধ আর্থিক আধিপত্য : ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা প্রভৃতি নির্ভর করছে অবৈধ আর্থিক আধিপত্যকে কেন্দ্র করে। অনুসন্ধানে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দেশি-বিদেশি শতাধিক এনজিও, ডজনেরও বেশি বেআইনি রোহিঙ্গাদের সংগঠন আর্থিক অনিয়মে মেতে উঠেছে। এতে ক্যাম্পগুলোতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে প্রত্যাবাসনবিরোধী চক্র। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মাদক ও মানবপাচার, অপহরণ, খুন, গুম, চাঁদাবাজি, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, ত্রাণের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মতো গুরুতর অপরাধ সিন্ডিকেটগুলো।

সেনা বিরোধিতায় ৭২৮ রোহিঙ্গা গ্রামে কমিটি গঠনই মুহিবুল্লাহর কাল হলো : ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টায় তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে উদ্বাস্তু জীবনের পরিবর্তে নিজ দেশে ফিরতে উদ্যোগ নেয়ায় প্রত্যাবাসন বিরোধী চক্র রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় শীর্ষ নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহকে গুলি করে খুন করা হয়। এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সংগঠন এআরএসপিএইচের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই সভায় মিয়ানমার জান্তা বিরোধী গঠিত ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’কে সংহতি জানিয়ে তাদের সাথে অংশগ্রহণ, নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের উদ্বুদ্ধ করতে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্প ও মিয়ানমারের রাখাইনে ৭২৮টি রোহিঙ্গা গ্রামের প্রত্যেকটিতে সাত সদস্যের কমিটি গঠনসহ বেশকিছু গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

দুইবার চেষ্টা করেও প্রত্যাবাসন ব্যর্থ, পরোক্ষ ইন্ধনে জাতিসংঘ ও এনজিও : বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক উদ্বাস্তু প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী ২০১৭ সালের শেষার্ধে ও ২০১৮ সালের মাঝামাঝি রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানোর দুইবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সময় অভিযোগ উঠে, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিওগুলোর পরোক্ষ ইন্ধনে রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র গ্রুপের বাধায় তা ভেস্তে যায়।

১২ অপরাধ শনাক্ত, ১২৯৮ মামলা, রয়েছে ২০ সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী : গত চার বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে এক হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে দুই হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ১৫ থেকে ২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীবাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে মাদক ব্যবসাসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড। অভিযোগ রয়েছে, এখানে প্রতিদিন প্রায় শতকোটি টাকার ইয়াবার লেনদেন হয়।

বিশ্বের আশ্বাসের বুলি, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, উদ্যোগ এখন তলানিতে : রোহিঙ্গা আশ্রয়ের কারণে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান। এসেছেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ভিভিআইপি ও বৈশ্বিক নামিদামি সেলিব্রেটিরা। এসব বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে মিলেছে আশ্বাসের বুলি, উচ্ছ্বসিত প্রশংসিত। কিন্তু বাস্তবে এসময় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের অগ্রগতি তলানিতে। এ নিয়ে আশ্রয়দাতা স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জীবনে বাড়ছে দীর্ঘশ্বাস ও নিরাপত্তাহীনতা।

আরসা আমিরের নির্দেশেই মাস্টার মুহিবুল্লাহ খুন : আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) সংগঠনটির প্রধান আতা উল্লাহ জনুনিই রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে গোয়েন্দা সংস্থা মনে করছে। ঘটনার আগেই আতা উল্লাহর পরিবারসহ অর্ধশত আরসা নেতার পরিবার গোপনে মিয়ানমার পাড়ি দিয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৪ দিন পার হলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কেউ এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। তবে সন্দেহভাজন পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের মধ্যে ইলিয়াস নামে এক রোহিঙ্গা হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। ইলিয়াস আরসার সক্রিয় সদস্য।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য যা দরকার, সেটা কিন্তু এখন পর্যন্ত হয়নি। প্রত্যাবাসনের দুই দফা চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গারা নিজ ভূমে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু রাখাইনের যেখানে তাদের বসবাস, তার কোনো চিহ্ন নেই। এই অবস্থায় তারা রাখাইনে গিয়ে আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন শিবিরে থাকার বিষয়টি মেনে নেয়নি। মুহিবুল্লাহ হত্যার মধ্য দিয়ে কক্সবাজারে ভয়ভীতি ও অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হতে পারে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ ফেলো এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মিয়ানমারের গোয়েন্দারা এই অঞ্চলে বিভিন্ন নামে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে। কাজেই মহিবুল্লাহ হত্যার মধ্য দিয়ে এটি নিশ্চিত যে মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের কক্সবাজারে তৎপরতা রয়েছে। সেটি রোহিঙ্গাদের হতে পারে। আবার বাইরেও হতে পারে। আবার কক্সবাজারে এত অস্ত্র আসছে, সেটা নিশ্চয়ই বাইরে থেকে। এটি মাদকের বিনিময়ে ঢুকছে। এত বিপুলসংখ্যক বাহিনী মোতায়েনের পরও সেটি হচ্ছে। আর মাদকের যে ব্যবসা, তাতে লগ্নি আছে বাংলাদেশের লোকজনের। কাজেই কক্সবাজার যাতে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

কারণ, এটি ঘটলে প্রথম লক্ষ্যবস্তু হবে বাংলাদেশ। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের কারণে সাময়িকভাবে ভয়ভীতি থাকতে পারে। তবে এর সঙ্গে প্রত্যাবাসনের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, চার বছরে প্রত্যাবাসনে সামান্যতম অগ্রগতি হয়নি। আমরা চাই, তারা (রোহিঙ্গা) নিরাপত্তা ও কিছু অধিকার নিয়ে ফিরে যাক। বাংলাদেশে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গা যুবক যে বসে রয়েছেন, তারা শান্ত হয়ে বসে থাকবেন, এমনটা ভাবার কারণ নেই। বাধ্য না হলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। চূড়ান্তভাবে এদের অপরাধ ও জঙ্গিবাদে জড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।

তাই রোহিঙ্গা যুবকরা যাতে এখানে কোনো সমস্যা তৈরি না করেন, সে জন্য তাদের কোনো না কোনোভাবে কর্মদক্ষতা বাড়ানোর মতো কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে। আর আরসার সঙ্গে মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের যোগসাজশের সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই মুহিবুল্লাহ খুনে যদি আরসা কিংবা আল ইয়াকিন জড়িত থাকে, তবে তারা সেটা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের স্বার্থেই করেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এখানে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি হতে দেবে না। তাই মুহিবুল্লাহ হত্যার আগে দুই রোহিঙ্গা নেতা ২০১৮-১৯ সালে খুন হয়েছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বড় পরিসরে চারদিক থেকে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে। যারা মহিবুল্লাহকে নেতা বানিয়েছে, তারা তো তাকে সুরক্ষার দায়িত্ব নেয়নি। অথচ উচিত ছিলো একজন ব্যক্তির পরিবর্তে সামষ্টিক নেতৃত্ব তৈরি করা। তাহলে হয়তো মিয়ানমার তাকে লক্ষ্যবস্তু করতো না।