Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

মৌসুমি ঘটনায় রহস্য

আবদুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম

অক্টোবর ১৫, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


মৌসুমি ঘটনায় রহস্য

কুমিল্লায় পবিত্র কুরআন অবমাননার প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল ও ক্ষোভ প্রকাশ এখনো অব্যাহত। গত দুদিনে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে চার যুবক ও এক কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

গতকাল রাজধানীর বায়তুল মোকাররমেও জুমার নামাজের পর পুলিশ-মুসল্লি সংঘর্ষে ৮-১০ জন আহত হয়েছেন। আটকও হয়েছে বেশ কয়েকজন। এছাড়া  ‘ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম থাকবে না’ তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের এমন বক্তব্য উত্তেজনা ছড়িয়েছে আরো মারাত্মকভাবে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে ক্ষোভের বিস্ফোরণ।

সমপ্রতি কুমিল্লায় কুরআন অবমাননা ও মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কর্ণফুলী, কক্সবাজারের পেকুয়া, গাজীপুরের কাশিমপুর, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, কুড়িগ্রামের উলিপুর, ফেনী,  নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী,  সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও  লক্ষ্মীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। সচেতন মানুষ বলছে, কুরআন অবমাননা নিয়ে যে ঘটনা ঘটছে তা কোনো প্রকৃত মুসলমান বা হিন্দু ঘটাতে পারে না।

বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো শ্রেণি এটি ঘটাচ্ছে। যার ফলে আমাদের দেশে একদিকে ধর্মের প্রতি আঘাত আসছে অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রতিও। কোনো বিশেষ সময়কে সামনে রেখে প্রতি বছর যে একই নিয়মে ঘটনা ঘটছে তার পেছনে বড় এজেন্ডা রয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। তাই প্রকৃত উস্কানিদাদাতের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়ে নজর রাখা সচেতন মহল মনে করছে, প্রতিটি ধর্মীয় উস্কানিতে তৃতীয় পক্ষের কেউ না কেউ লাভবান হয়।

অতীতে এমন কিছু ঘটনায় এটি বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ সচেতন হওয়া অনেক সময় উদ্দেশ্যের হামলায় কোনো কাজে আসে না। আবার এসব হামলা রাজনৈতিক ফায়দার হয়ে থাকে। কুমিল্লার ঘটনার পর সেই দাবি উঠেছে। রাজনৈতিক কারণে এটি করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ একে অপরকে বিপদে ফেলতেই এটি করেছে। আবার কেউ বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলতে এমনটি করা হয়েছে।

একটি কলেজের শিক্ষক সোহেলী হায়দার। তিনি বলেন, কুমিল্লাতে যে ঘটনা ঘটেছে এটি কোনো দায়িত্বশীল মুসলিম বা হিন্দুর কাজ নয়। ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য একটি অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্র এসব। তাই সবাইকেই শান্তিপূর্ণ সমাধানের রাস্তা দেখতে হবে। রাষ্ট্রের কাছে দাবি— এরকম ভয়ানক কাণ্ড যে বা যারা করেছে তাদের আটক করে সাজা নিশ্চিত যেনো করা হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কেউ যেনো উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে ফায়দা হাসিল করতে না পারে।

আল আমিন সবুজ নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, মিছিল করা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। মিছিলে বাধা না দিলে কোনো সমস্যা হয় না। মানুষ মিছিল করে আপনাআপনি থেমে যায়। কিন্তু বাধা দিলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, এটি বারবার দেখেছি। বায়তুল মোকাররমেও যেটা ঘটেছে।

মো. মাসুদ। ঢাকার একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, দুঃখের বিষয় হলেও বাংলাদেশের মুসলিম মার খায় মুসলিমের হাতে, এর চাইতে দুঃখজনক বিষয় আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে আমরা মুসলিমরা এখন লজ্জিত লাঞ্ছিত।

আল হেলাল ইসলাম। বাটা সিগন্যাল মোডে একটি আইটি কোম্পানিতে জব করেন। তিনি বলেন, কোনো প্রকৃত মুসলমান কুরআন শরিফকে এভাবে মূর্তির সামনে দিতে পারে না। আর কোনো প্রকৃত হিন্দু জেনেশুনে এত বড় কাণ্ড ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটাতে পারে না। কে বা কারা এক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ ভোগ করতে এই কুপ্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের খুঁজে বের করে আনা? উচিত নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ সৃষ্টি না? করে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইসফাক এলাহী চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘কুমিল্লার ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ঘটনাগুলো ঘটছে— এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তেই আমরা চাচ্ছিলাম। কুমিল্লার ঘটনায় সেখানে অনেক বড় আঘাত এসেছে। এই ধরনের ঘটনা প্রতি বছরই ঘটছে। দেশের অভ্যন্তরে এই ধরনের ঘটনায় যারা উস্কানি দিচ্ছে তাদের দমন করা সরকারের দায়িত্ব কর্তব্য বলে আমি মনে করি।’

এ নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান নিয়াজী আমার সংবাদকে বলেন, ‘কুমিল্লায় কুরআন অবমাননার ঘটনা ঘটলো। এটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান মানুষের ওপর আঘাত করা হয়েছে। এটি অবশ্যই অমার্জনীয় অপরাধ। এটি অন্য ধর্মের  সাথে ঘটলেও একই অপরাধ হতো।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আমরা সবাই স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। নিজ নিজ ধর্ম পালন করা আমাদের নাগরিক অধিকার। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। ধর্ম নিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য ও আচরণ থেকে দূরে থাকাই ভালো। যারাই উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন তাদের এগুলো বন্ধ করতে হবে। একই সাথে কুমিল্লায় ঘটনার বিশৃৃঙ্খলার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

বায়তুল মোকাররমে সংঘর্ষে পাঁচ পুলিশ আহত, পাঁচজন আটক : কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকার বায়তুল মোকাররম গতকাল থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বায়তুল মোকাররম থেকে কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড়ে গেলে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। পরে সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে কমপক্ষে পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পুলিশও মিছিলকারীদের মধ্য থেকে অন্তত পাঁচ জনকে আটক করেছে। গতকাল জুমার নামাজ শেষে  মুসলিম যুবসমাজের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়। সেটি পল্টন হয়ে বিজয়নগর দিয়ে নাইটিঙ্গেল মোড়ে গেলে পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। এতে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা উত্তেজিত হয়ে স্লোগান দিতে থাকে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, একপর্যায়ে ব্যারিকেড ভেঙে মিছিলটি সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ প্রথমে বাধা দেয়। এরপর মিছিলকারীরা ধস্তাধস্তির পর ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও লাঠিচার্জ শুরু করে। এরপর মিছিলকারীরা আরও বেশি চড়াও হলে পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আব্দুল আহাদ বলেন, বায়তুল মোকাররম থেকে কেউ মিছিল করতে চাইলে বরাবরের মতো এবারো নাইটিঙ্গেল মোড় হয়ে ঘুরে ফের বায়তুল মোকাররমে গিয়ে শেষ করার অনুমতি ছিলো। কিন্তু একদল মুসল্লি নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে কাকরাইলের দিকে যেতে চায়।

সেখানে থাকা ব্যারিকেড ভাঙতে চায়। তখন পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গতকাল বেলা ৩টার দিকে বায়তুল মোকাররম-পল্টন-বিজয়নগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পল্টন মোড়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট ও পশ্চিম পাশে অবস্থান করছেন র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা। বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটের ভেতরেও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া পুরানা পল্টনে প্রস্তুত রাখা হয়েছে জলকামান ও এপিসি রায়টকারসহ কারাভ্যান।