Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

থমকে গেছে স্বাভাবিক জীবন

রেদওয়ানুল হক

অক্টোবর ১৫, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


থমকে গেছে স্বাভাবিক জীবন
  • খাবারের দাম, যাতায়াত ভাড়া ও বাসাভাড়াসহ সব কিছুর ওপর প্রভাব ফেলছে বাজার দর
  • দাম নিয়ন্ত্রণে পেঁয়াজ ও চিনি আমদানীতে শুল্ক কমিয়েছে এনবিআর 
  • কয়েকটি পণ্যের দাম আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ব্যবসায়ীরা
  • আন্তর্জাতিক বাজারের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশিয় সিন্ডিকেটকে দুষছেন বিশ্লেষকরা 
  • ১৪% মানুষের বাড়িতে খাবার নেই: ব্রাকের জরিপ

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় থমকে দাঁড়িয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ব্যয় বৃদ্ধির চাপ সইতে না পেরে প্রতিদিনই পাল্টাচ্ছে জীবনধারা। খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন থেকে শুরু করে থাকার জায়গা (ভাড়া বাসা) সব কিছুতেই পরিবর্তন আনছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। টিকে থাকার এ লড়াইয়ে নানা কৌশল নিচ্ছেন তারা। 

যাত্রাবাড়ী মোড়ে শহীদ ফারুক সড়কে একটি ভ্রাম্যমাণ ফাস্ট-ফুডের দোকানের সামনে ছোটখাটো জটলা-হইচই। এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল দোকানীর সাথে ক্রেতাদের বাকবিতণ্ডা চলছে। ক্রেতাদের অভিযোগ খাবারের দাম ঠিক থাকলেও পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। 

জুয়েল নামক একজন ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, গত কয়েকদিন আগেও নুডুলস যে পরিমাণ দেয়া হয়েছে এখন সে পরিমাণে দেয়া হচ্ছেনা, ফ্রাইড রাইসের পরিমাণও কমানো হয়েছে। 

জানতে চাইলে দোকানী রিয়াজ হোসেন বলেন, ‘কি করব বলেন? মুরগির দাম কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেড়েছে, তেলের দামও বেড়েছে এমনকি আলুর দামও ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। শসার দাম দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ৪০ টাকা থেকে ৮০ টাকা হয়েছে। 

খাবারের দাম বাড়ালে সমস্যা তাই পরিমাণে কম দিয়ে পুষিয়ে নিচ্ছি কি করবো বলেন? আমাদেরও তো ব্যবসা করতে হবে; মানুষ তা বুঝেনা।’যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে মীরহাজিরবাগের নির্ধারিত ভাড়া ২০ টাকা কিন্তু এখন ৩০ টাকার কমে কেউ যেতে চাচ্ছেনা, মাঝেমধ্যে কেউ কেউ ২৫ টাকায় যাচ্ছেন। 

রিকশাচালক টিপু মিয়া বলেন, ‘সব কিছুর দাম বাড়তি আমরা কি করব। সংসার চলে না তাই ভাড়া বেশি না নিয়ে উপায় নেই কিন্তু যাত্রীরা মানতে চায় না। এ নিয়ে প্রায়ই যাত্রিদের সাথে ঝগড়াঝাটি হয়, অনেকে গালি দেয় মাঝেমধ্যে হাতাহাতিও হয়।

টিকাটুলি আনসার ক্যাম্পের পাশে টু-লেট থেকে নাম্বার নিয়ে কল দিচ্ছেন বিপণন কর্মী সোহেল; ভাড়া বাসা ছেড়ে মেসে ছিট খুঁজছেন তিনি। সোহেল আমার সংবাদকে জানান, গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় স্ত্রী ও সন্তানকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি থাকবেন একটি মেসে তাই ছিট খুঁজছেন। 

কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এতটা বেড়েছে যে মাস শেষে বাসা ভাড়ার টাকা থাকেনা। তাই বাধ্য হয়ে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি।’ এতে ছোট্ট মেয়েটির লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটবে বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রতিদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। ব্রয়লার মুরগির দাম কেজি প্রতি ১২০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা, সয়াবিন তেল ১১০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা, মোটা ডাল ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা এবং সব ধরনের সবজির দাম ১০-১৫ টাকা বেড়েছে।

তিনি বলেন, "১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি পেয়ে আমি এখন বাড়ি ভাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে খাবার কেনা পর্যন্ত সবকিছু বজায় রাখতে পারছি না। আমি কি করবো।”

পোল্ট্রি ব্যবসায়ী রুহুল আমিন জানান, বাজারে মুরগির দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে, "তাই আমাদেরও বাজার দরে বিক্রি করতে হবে। আমাদের ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৭৫ টাকায় কিনতে হবে। একই সময়ে, ২৫ কেজি বস্তা মুরগির খাবারের দাম ৬৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫০ টাকা হয়েছে।

দেশের ৬৪ টি জেলায় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপ অনুযায়ী, চরম দারিদ্র্যের হার ৭০০%বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ১৪% মানুষের বাড়িতে খাবার নেই। তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক এবং রিকশাচালক রয়েছে। জরিপটি চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে পরিচালিত হয়েছিল।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ঢাকা শহরে এখন আনুমানিক ১.১ মিলিয়ন রিকশা রয়েছে। এই রিকশাচালকরা নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে রয়েছেন যারা দাম বাড়ার কারণে মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছেন।

এদিকে বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য ও ব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়ার একটা কারণ বিশ্ববাজার। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল, গম, চিনি, ডাল, গুঁড়া দুধ ও শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বাড়তি। সঙ্গে বেড়েছে জাহাজভাড়া। এই বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছিল এ বছরের শুরু থেকেই।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) খাদ্য মূল্যসূচক প্রতিবেদন বলছে, গত মে মাসে বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম বেড়েছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ২০১০ সালের পর মাসিক বৃদ্ধির হারে সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যসূচক এখন ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকেরা এবারের দাম বাড়ার পেছনে করোনাকালে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া, উৎপাদন কমে যাওয়া, জ্বালানি তেলের দাম ও জাহাজভাড়া বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন দেশের মজুতপ্রবণতাকে দায়ী করছেন। 

অবশ্য বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মূল্যবৃদ্ধির জন্য শুধু বিশ্ববাজারকে দায়ী করা যাবে না। ব্যবসায়ীদের কারসাজিও এ ক্ষেত্রে দায়ী। যেমন বলা যায়, পেঁয়াজের দাম ভারতে সামান্য বাড়তেই মাত্র দুই সপ্তাহে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেল কেন?

জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী বড় কোম্পানিগুলো। 

তিনি বলেন, ‘বড় কোম্পানিগুলোতে যে পরিমাণ পণ্য মজুদ থাকে তাতে চাইলেই তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ জন্য মজুদের নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।’

অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রী বলছেন, ‘দেশে এই মুহূর্তে পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত আছে, যা দিয়ে আগামী আড়াই থেকে তিন মাস চলতে পারে।’ তবুও কেন দাম বাড়ছে তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। 

সাধারণত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে সরকার বাজারে তদারকি বাড়ায়। অনেক সময় কর ছাড় এবং সরকারিভাবে কম দামে বিক্রি বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়। কিন্তু দাম বাড়ার এমন পরিস্থিতিতে টিসিবি দৈনিক পণ্য বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করেনি। 

টিসিবি এখন দেশজুড়ে দিনে প্রায় সাড়ে চার’শ ট্রাকে করে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি করছে। কয়েক মাস আগেও পরিমাণ মোটামুটি একই ছিল। গত এপ্রিলে সংস্থাটি চিনি ও সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছে। এখন একেকজন গ্রাহককে দুই লিটারের বেশি সয়াবিন তেল দিচ্ছে না, যা আগে পাঁচ লিটার ছিল।

এদিকে ব্যবসায়ীদের দাবি, প্রতি কেজি চিনিতে এখন ২৮ টাকা ও ভোজ্যতেলে ২০ টাকার মতো কর পড়ছে। যেহেতু পণ্যের দামে কর শতাংশ হারে আদায় হয়, সেহেতু বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে করের পরিমাণও বেড়ে যায়। তাই সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১১ টাকা বাড়িয়ে ১৬৪ টাকা এবং চিনির দাম কেজিতে ৯ টাকা বাড়িয়ে ৮৪ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব সরকারের কাছে দেওয়া আছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা তেল ও চিনির কর কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে। মন্ত্রণালয় ১১ অক্টোবর (সোমবার) দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি বৈঠক ডাকে। বৈঠকে কর কমানোর বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও বৈঠকে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। বৈঠক শেষে মন্ত্রণালয় উল্টো জানিয়েছে, পেঁয়াজের বাজার এক মাস ‘একটু নাজুক’ থাকবে।

দাম যাতে সহনীয় থাকে, সে জন্য আমদানি সহজ করা ও বাজারে তদারকি বাড়ানোর উদ্যোগের কথা জানান বাণিজ্যসচিব। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ-ও বলছে, দেশে পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত আছে। আমদানিও হচ্ছে। মানুষ যাতে আতঙ্কিত না হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পর দাম নিয়ন্ত্রণে পেঁয়াজের ৫ শতাংশ ও চিনির ১০ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের স্বাক্ষর করা এ সংক্রান্ত দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে চিনির নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে।

এদিকে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন, তা নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে (বিটিটিসি) শিগগিরই বৈঠক হবে বলে জানিয়েছে কমিশনের একটি সূত্র। সেখানে দাম বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।

ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যদি দাম আরও বাড়ানো হয় তাহলে শুল্ক কমানোর ঘোষণা খুব একটা কাজে আসবেনা বলে মত দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি, এতে বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘পরিস্থিতি মনেহয় খারাপের দিকেই যাচ্ছে। জনজীবনে এর কিধরনের প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে একটি পর্যালোচনা করে সরকারকে আগাতে হবে।’

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) খাবার না পেয়ে এক বৃদ্ধের আত্মহত্যার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাই এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা যাতে আর না ঘটে তাই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের এখনি সময়।