Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

ছাত্রলীগে বিভক্ত সিলেট আ.লীগ

মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, সিলেট

অক্টোবর ১৬, ২০২১, ০৬:১৫ পিএম


ছাত্রলীগে বিভক্ত সিলেট আ.লীগ

প্রায় চার বছর পর সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্র। কমিটিতে নিজেদের পছন্দের লোক এবং বলয় ‘মাইনাস’ হওয়ায় সিলেট ছাত্রলীগে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে ঘোষিত কমিটি নিয়ে কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন পদবঞ্চিত নেতা ও তাদের অনুসারীরা। ছাত্রলীগের এমন অস্থিরতায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে সিলেট আওয়ামী লীগ। একপক্ষ অবস্থান নিয়েছেন কমিটির পক্ষে অপর পক্ষ কমিটি ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। 

কমিটির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা ও জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রণজিৎ সরকার।

বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন মহানগরের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমেদ, জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান ও মহানগরের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ। তাদের অভিযোগ কমিটি গঠনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেননি। নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তারা এই কমিটির কোনো দায়-দায়িত্ব নেবে না। 

জানা গেছে, কমিটি ঘোষণার পরই মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির বাসায় জরুরি বৈঠকে বসেন জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, মহানগরের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমেদ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ। বৈঠক থেকে কমিটির বিষয়ে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ বিষয়ে বার্তা পাঠানো হয়। প্রয়োজনে এ বিষয়ে তারা দলীয় প্রধানের সাথে দেখা করতে পারেন বলে জানা গেছে।

তবে কমিটি নিয়ে অনড় অবস্থানে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তাদের দাবি স্বচ্ছ ও ত্যাগীদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিজের বলয়ের লোক পদবঞ্চিত হওয়ায় অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ তুলা হচ্ছে। যা মিথ্যা ও বানোয়াট উল্লেখ করে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। 

তিনি আমার সংবাদকে বলেন, কমিটিতে স্বচ্ছ, যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। লেনদেনের প্রশ্নই আসে না, এটা কেউ প্রমাণও করতে পারবে না। সবার সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে লেখক বলেন, সবাই তো আর সভাপতি-সম্পাদক হতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে যারাই বাদ পড়ছেন তারা নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন।

তবে নিজ বলয়ে কোণঠাসা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন দুই কমিটির শীর্ষ নেতা ও তাদের বলয়ের নিয়ন্ত্রক নেতারা। তারা গোপনে রাহেল সিরাজের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। তবে এই মুহূর্তে তারা সরাসরি রাহেল সিরাজের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করছেন। 

সূত্রের খবর, শেষ পর্যন্ত জেলার কোনো নেতা রাহেল সিরাজের দায়িত্ব না নিলে তাকে শেল্টার দেবেন গোলাপগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা। তিনি সাবেক কয়েকজন ছাত্রনেতাকে সামনে রেখে রাহেল সিরাজকে দিয়ে জেলার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের চেষ্টা চালাবেন। সূত্র আরো জানায়, রাহেল সিরাজ বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন।

তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে এ বিষয়ে একাধিক বৈঠকও করেছেন। কেন্দ্রীয় নেতারা তাকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আজকালের মধ্যে রাহেল সিরাজ বিমানযোগে সিলেট আসবেন। এরপর বিশাল শোডাউন করে সিলেটে নিজের তিনি অবস্থান জানান দেবেন। 

জানা গেছে, একসময় সিলেট ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণক ছিলেন চার নেতা। চারজনই ছিলেন এককালের তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা। তারা হলেন, ‘তেলিহাওর গ্রুপ’-এর নিয়ন্ত্রক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খাঁন ‘দর্শন দেউড়ি গ্রুপ’-এর নিয়ন্ত্রক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, ‘কাশ্মীর গ্রুপ’-এর নিয়ন্ত্রক মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা ও ‘টিলাগড় গ্রুপ’-এর নিয়ন্ত্রক জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রণজিৎ সরকার। 

সিলেট ছাত্রলীগের রাজনীতিতে এ চার গ্রুপ বেশি আলোচিত। জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি এলেই শীর্ষ চার পদ পেতেন এ চার গ্রুপের অনুসারীরা। প্রায় দুই যুগ ধরেই ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলো এই চার নেতার অনুসারীদের আধিপত্য। তবে ২০১৫ সালে দীর্ঘদিনের আধিপত্যে ভাগ বসান সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমেদ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আাাজাদুর রহমান আজাদ। 

সে কমিটিতে ‘কাশ্মীর গ্রুপ’কে ‘মাইনাস’ করে মহানগরের সাধারণ সম্পাদক হন ‘শাহজালাল ব্লক’-এর নিয়ন্ত্রক আসাদ উদ্দিন আহমেদের অনুসারী আব্দুল আলিম তুষার। অপরদিকে, জেলায় ‘টিলাগড় গ্রুপ’কে ‘মাইনাস’ করে সাধারণ সম্পাদক হন আজাদুর রহমান আজাদ অনুসারী রায়হান চৌধুরী।

তবে ২০২১ সালে এসে পুরোনো তিন ছাত্রলীগ নেতা ঠিকই তাদের বলয়ের আধিপত্য ধরে রাখেলও বাদ পড়ে ‘তেলিহাওর গ্রুপ’। একই সাথে আধিপত্য ধরে রাখতে পারেনি আজাদুর রহমান আজাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘টিলাগড় গ্রুপ’ ও আসাদ উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘শাহজালাল ব্লক’। 

অন্যদিকে, এবারো নিজেদের বলয়ের আধিপত্য ধরে রেখেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা ও জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রণজিৎ সরকারের অনুসারীরা। নাদেলের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘দর্শন দেউড়ি’ গ্রুপ থেকে কিশোয়ার জাহান সৌরভ হয়েছেন মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন বিধান কুমার সাহার ‘কাশ্মীর গ্রুপে’-এর নাঈম আহমদ। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রণজিৎ সরকারের ‘টিলাগড় গ্রুপ’-এর অনুসারী নাজমুল ইসলাম জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছেন। 

এদিকে, জেলার সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজকে নিয়ে দেখা দিয়েছে রহস্য। রাহেল মূলত ‘তেলিহাওর গ্রুপ’-এর কর্মী। তবে কমিটি ঘোষণার পরই তাকে মানতে নারাজ এ বলয়ের নেতারা। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রক। ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পরই এ বলয়ের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা রাহেলের বাসায় হামলা ও গুলিবর্ষণ করায় দেখা দিয়েছে রহস্য। 

ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, নাসির উদ্দিন খানের ভাতিজা জাওয়াদকে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক না করায় এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। জাওয়াদ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে ঠাঁই পেয়েছেন। অবশ্য কমিটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে পদ থেকে সড়ে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। 

অবশ্য রাহেল সিরাজ নিজেকে তেলিহাওর গ্রুপের কর্মী দাবি করে আমার সংবাদকে বলেন, নাসির উদ্দিন খান আমার রাজনৈতিক অভিভাবক। আমি জানি না কেন আমার গ্রুপের অনুসারী ও সহকর্মীরা আমাকে মেনে নিতে পারছে না। তারা আমার বাসায় হামলা চালাচ্ছে; এটা আমার বোধগম্য নয়। 

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান আমার সংবাদকে বলেন, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সমন্বয় না করে কমিটি দেয়াটা কেন্দ্রের ঠিক হয়নি। মূলত এ কারণেই নেতাকর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রের পছন্দও সঠিক ছিলো না বলেও তিনি জানান। 

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উচিত ছিলো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে কমিটি অনুমোদন দেয়া। কিন্তু কেন্দ্রের দায়িত্বশীল নেতারা কাউকে না জানিয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়া কমিটি ঘোষণা করায় সিলেট ছাত্রলীগে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। 

এদিকে, কমিটি গঠনে কোটি টাকা বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতা ও তাদের অনুসারীরা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও পথসভা করেন পদবঞ্চিত ও তাদের অনুসারীরা। 

এর আগে গত বুধবার বিকেলে সিলেট জেলা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে করে জেলার সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উভয়ে এক কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে অছাত্র, এমসি কলেজের হোস্টেলে ধর্ষণ মামলার আসামিদের গডফাদার, বিভিন্ন চেক ডিজঅনার মামালার আসামি, বিশেষ করে ফ্রিডম পার্টির নেতার নাতিকে নিয়ে সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করায় আমরা সিলেট ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লজ্জিত, হতাশ ও বিব্রত। আমরা কমিটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। এ কমিটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন ও অবরোধসহ টানা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।