অক্টোবর ১৮, ২০২১, ০৬:০০ পিএম
বাড়ছে মামলাজট। বাড়ছে নানা সংকট। ভোগান্তিতে পড়ছেন বিচারপ্রার্থীরা। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নানা উদ্যোগের পরও জট কমানো সম্ভব হচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্টসহ অধঃস্তন আদালগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে। জট বাড়লেও বাড়েনি বিচারক।
প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যক বিচারক দিয়েই চলছে বিচার বিভাগ। অভাব রয়েছে বিচার সহায়ক জনবলেও। ফলে মামলাজট নিরসনে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে কিছু সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দিতে যাচ্ছে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, উচ্চ আদালতের দুই বিভাগে প্রায় ১৮ জন বিচারক নিয়োগ দেয়া হবে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও একজন সদস্য বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। নিয়োগের জন্য ইতোমধ্যে বিচারকদের একটি খসড়া তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। বিচারকের তালিকায় আইনজীবী ছাড়াও কয়েকজন জেলা জজের নাম রয়েছে।
তবে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের গাইডলাইন অনুসরণ করে সৎ, যোগ্য, মেধাবী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উচ্চ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন আইনজ্ঞরা। নিয়োগে হাইকোর্টের সাত দফা নির্দেশনাও অনুসরণের দাবি জানান তারা।
এদিকে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে আগে থেকেই কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। তবে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের (গ) ধারায় স্পষ্ট আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে। কিন্তু দীর্ঘ ৫০ বছরেও তা সম্ভব হয়নি। বরাবরই সেটা উপেক্ষিত রয়ে গেছে।
এছাড়া বিচারক নিয়োগে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও অদ্যাবধি সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এ পদে নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রশ্ন উঠছে, তারও সমাধান হয়নি। ২০১২ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও ১০ বছরেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতের হাইকোর্ট বিভাগে ১৩ থেকে ১৮ জন এবং আপিল বিভাগের জন্য হাইকোর্ট থেকে তিনজন বিচারপতি নিয়োগের তালিকা করা হয়েছে। পাশাপাশি গত ২৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি আমির হোসেনের মৃত্যুজনিত কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ কারণে ট্রাইব্যুনালের শূন্য পদ পূরণের জন্য একজন সদস্য বিচারক নিয়োগ দেবে সরকার। এ ছাড়া চলতি বছরের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে বেশ কয়েকজন বিচারক অবসরে যাবেন। যার ফলে বিচারক সংখ্যা কমে আসবে। এতে মামলার জট আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই সরকার নতুন বিচারক নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছে।
জানা গেছে, আপিল বিভাগে বর্তমানে পাঁচজন বিচারপতি বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। যেখানে আগে একই সাথে আপিলে দুটি বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালিত হতো, বিচারকসংখ্যা কমে যাওয়ায় সেখানে এখন একটি বেঞ্চে বিচারকাজ চলছে। এরমধ্যে আগামী ৩০ ডিসেম্বর অবসরে যাবেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ফলে আপিলে বিচারপতি সংখ্যা কমে হবে চারজন। বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার বেশ কয়েকজন বিচারককে আপিল বিভাগে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে বেশ কয়েকজন বিচারক অবসরে যাবেন। যার ফলে বিচারক সংখ্যা কমে আসবে। এতে মামলার জট আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই সরকার নতুন বিচারক নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছে।
আইনজীবীরা বলছেন, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষ, সৎ ও আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ এমন ব্যক্তিদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিত। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে একজন দক্ষ বিচারকের বিকল্প নেই। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এমন ব্যক্তিদের বিচারক নিয়োগ দিতে সরকার সচেষ্ট থাকবে বলে বিশ্বাস আইনজীবীদের। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন যোগ্য বিচারক নিয়োগ। এ লক্ষ্য নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বিচারক নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী বলেন, অবশ্যই সৎ যোগ্য ও মেধাবীরা উচ্চ আদালতের বিচারক হবেন এমনটাই প্রত্যাশা করি। আমি মনে করি, বিচারক নিয়োগে দলীয় আনুগত্য বিবেচনা করা হয় না। মেধাবী ও সৎদের নিয়োগ করা হয়। আর দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়নি।
তিনি আরো বলেন, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানা উচিত। একই সাথে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, যোগ্যতর ব্যক্তিকে বাছাই করার স্বার্থে বিচারপতি নিয়োগে আইন করা জরুরি। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারই তা উপেক্ষা করেছে। এদিকে বিচারক নিয়োগে আইন বা নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তারা বলেছেন, আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করার পর নিয়োগ দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে আইন বা নীতিমালা করাটা জরুরি। এটি করলে ক্ষতি নেই বরং লাভ।’ তিনি বলেন, ‘আমি আইনমন্ত্রী থাকার সময়ে বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা চূড়ান্ত খসড়া করেছিলাম। এরপর কী হলো জানা নেই। বর্তমানে সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ দেন। এখানে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিলে বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকে না।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘আমাদের দেশে বিচারক নিয়োগে নীতিমালার চেয়ে ১৯৬৭ সালের একটি কার্যকর ও শক্তিশালী আইন (বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ক্যাননস অব প্রফেশনাল কন্ডাক্ট অ্যান্ড এটিকুয়েট) বলবৎ রয়েছে। সে আইনে বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিকভাবে জড়িত নন এমন কোনো আইনজীবী, যার সক্ষমতা রয়েছে ও বিচার বিভাগের মান-মর্যাদার বিষয়ে যিনি সমুন্নত ভূমিকা রাখতে পারবেন— তাকে বিচারক নিযুক্তিতে যাচাই-বাছাই করার কথা বলা আছে। তবে কে বা কারা যাচাই-বাছাই করবেন, তা নিয়ে কিছু বলা নেই। তাই আমি মনে করি, বিদ্যমান ওই আইনের মাধ্যমে দক্ষ বিচারক নিয়োগ সম্ভব।
নিয়োগে হাইকোর্টের সাত দফা নির্দেশনা : সংবিধানের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, যেমন— জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশি নাগরিক হতে হবে। ওই মূলনীতি ও চেতনায় বিশ্বাসী ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপারিশ করা যাবে না। বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করার ক্ষেত্রে মেধাবী, প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চতর পেশাগত যোগ্যতাসম্পন্ন, সৎ ও আইনি জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। বিচারক হতে আগ্রহী প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দিতে হবে।
এটা দেখার পর ইচ্ছা করলে প্রধান বিচারপতি সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করতে পারেন। বিচারক নিয়োগের সুপারিশের ক্ষেত্রে পেশাগত জীবনে একজন ব্যক্তির অর্জিত দক্ষতা ও পারদর্শিতাকে প্রথম বিবেচনায় নেয়া উচিত। ভারতের আইন কমিশনের ৮০তম প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী একজন বিচারকের পেশাগত পরিপক্বতা ও অভিজ্ঞতাকে তার বয়সসীমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
সেটা বিবেচনায় নিয়ে অভিমত হলো— সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মনোনয়নের ক্ষেত্রে বয়সসীমা সর্বনিম্ন ৪৫ বছর হওয়া উচিত। বিচারক হিসেবে নিয়োগে সুপারিশ করার ক্ষেত্রে আপিল বিভাগে নিবন্ধিত আইনজীবীদের মধ্য থেকে উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্নদের অগ্রাধিকার দিতে পারবেন প্রধান বিচারপতি। তবে হাইকোর্ট বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে সততা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এমন নিবন্ধিত আইনজীবীকেও বিবেচনা করা যেতে পারে। জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তিন বছরের কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নিম্ন আদালতের কোনো বিচারককে উচ্চ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা উচিত হবে না।
অধঃস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান যোগ্যতা হওয়া উচিত সততা। তবে মনে রাখা উচিত, উচ্চ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তির যদি সততা না থাকে তবে তাকে কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হলে সেটা হবে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরীর করা রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়।