Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

৪৪ আদালতে বিচারক নেই

অক্টোবর ২৪, ২০২১, ০৬:৫৫ পিএম


 ৪৪ আদালতে বিচারক নেই

বিচারক সংকট যেনো কাটছেই না। ফলে মামলাজটও বাড়ছে। সংকটে পড়ে বিচার প্রক্রিয়ায় নেমে এসেছে ধীরগতি। ভুগছেন বিচারপ্রার্থীরা। মামলা রায় পেতে লেগে যাচ্ছে বছরের পর বছর। নানা পদক্ষেপের পরও প্রয়োজনীয় বিচারক নিয়োগ দেয়াও সম্ভব হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বিচারক নিয়েই চলছে বিচার বিভাগ। প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মামলা হলেও বিচারকাজ চালানোর জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারক না থাকায় বিচারও আর এগোয় না। 

এতে বিচারপ্রার্থীদের মামলার পেছনে ঘুরতে হয় বছরের পর বছর। এমনিতেই অবকাঠামোগত সুবিধা কম। নেই বিচারকদের পর্যাপ্ত বসার জায়গা। মামলা ভারে ফাইল রাখার জায়গারও সংকুলান হয় না। অনেক জেলায় বিচারকদের কর্মদিবস চলে এজলাস ভাগাভাগি করে। তারপরও নতুন আইন হয়। গঠন করা হয় নতুন নতুন ট্রাইব্যুনাল। নতুন আইনে নতুন আদালতও থাকে। কিন্তু, নতুন বিচারক নিয়োগ দেয়া হয় না। যা নিয়োগ হয় তাও যৎসামান্য। বাধ্য হয়েই পুরোনো সেই আদালত আর বিদ্যমান বিচারকদের ওপরই নতুন আইনের নতুন আদালতগুলোর  মামলা ভার চাপানো হয়। আর অতিরিক্ত মামলাচাপে ভারাক্রান্ত হন বিচারকরা। বিচারের গতি হয়ে যায় মন্থর। 

এতে বিচারপ্রার্থীদের মাঝে সৃষ্টি হয় হতাশা। অধিকাংশ আদালতই ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিয়ে চলছে যুগের পর যুগ। আর এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্নও  দেখা দিয়েছে। ভারপ্রাপ্ত বিচারক নিজের কাজ করবেন নাকি ভারে ভারাক্রান্ত আদালতের বিচারকাজ করবেন? কর্তৃপক্ষ চাইলেই এসব আদালতে বিচারক নিয়োগ দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া এসব আদালতে বিচারক নিয়োগ না দেয়ায় শূন্য পদেও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন যোগ্য বিচারকরা। 

শুধু অধঃস্তন আদালতই নয়, গত এক দশকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট থেকে অধঃস্তন সব আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি বিচারকের সংখ্যা। বরং আগে বিচারকের সংখ্যা যা ছিলো, তুলনামূলক সেটাও কমেছে। সবচেয়ে বেশি বিচারক সংকট রয়েছে চট্টগ্রামের আদালতে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়,  প্রতিটি জেলায়, থানাপ্রতি সহকারী জজ একজন থাকার কথা থাকলেও সেখানে পুরো জেলা মিলেই এ পদে বিচারক আছেন মাত্র দুইজন। একই সাথে সিনিয়র সহকারী জজও আছেন দুইজন। আবার কিছু কিছু জেলায় তা-ও নেই বলে জানা গেছে। এদিকে গত ৩ এপ্রিল  চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইল, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, ঝালকাঠি ও পঞ্চগড় জেলায় একটি করে নতুন মোট ছয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়। 

তবে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ছয় মাস পার হলেও এখনো এসব ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়নি। এতে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলেও এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। বর্তমানে এসব ট্রাইব্যুনালসহ সারা দেশে প্রায় ৪৪টি আদালতে বিচারক নেই। এতে একদিকে যেমন বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বেড়ে যাচ্ছে, অপরদিকে ভারপ্রাপ্ত বিচারকরা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করায় তাদের কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে তারা নিজেদের নিয়মিত আদালতের বিচারকার্যেও পর্যাপ্ত সময় দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এতে প্রতি এক লাখ মানুষের বিপরীতে বিচারক আছেন মাত্র একজন। এটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। 

যেখানে ভারতে ৫০ হাজার জনে একজন, ইংল্যান্ডে ২০ হাজার জনে একজন, আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইতালিতে ১০ হাজার জনে একজন বিচারক রয়েছেন। মামলাজট নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০১৫ সালের আগস্টে আইন কমিশনের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতি ৪০ হাজার জনসংখ্যার জন্য একজন করে বিচারক প্রয়োজন। সে হিসাবে চার হাজার বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন থাকলেও আইন কমিশন সে সময় আপাতত দুই হাজার ৪০০ বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করে। অবশ্য তখন দেশে জনসংখ্যা ছিলো প্রায় ১৬ কোটি এবং বিচারাধীন মামলা ছিলো প্রায় ৩০ লাখ। 

আর এখন জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ কোটি, কিন্তু বিচারক আছেন মাত্র দুই হাজার। পাঁচ বছরেও বিচারক নিয়োগে কমিশনের সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। বিচারক সংকট সমাধানে আইন বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে বলেন, বিচারপ্রক্রিয়া গতিশীল করতে হলে বিচারের প্রধান নিয়ামক বিচারক সংখ্যা বাড়াতে হবে। 

তারা বলেন, এই মুহূর্তে দরকার জেলা ও দায়রা জজের সিভিল ও ক্রিমিনাল জুরিসডিকশন আলাদা করে দিয়ে প্রত্যেক জেলায় পৃথক দুজন জেলা সেসনস জজ ও জেলা সিভিল জজের নেতৃত্বে দুটি আলাদা বিচারিক কাঠামো তৈরি করা। প্রতিবেশী দেশগুলো এটা করেছে, সুফলও পাচ্ছে। এটা করা অতি জরুরি। সাথে সাথে বিচারক সহায়ক জনবলও বৃদ্ধি করতে হবে।

বিচারকশূন্য যেসব আদালত : নতুন সৃষ্ট ছয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ছাড়াও সারা দেশে অন্তত ৩৭টি বিচারকের পদ শূন্য রয়েছে। সবচেয়ে বিচারক সংকটে ভুগছে চট্টগ্রামের আদালতগুলো। বিচারক সংকট রয়েছে এগুলো হলো— আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, গাজীপুর জেলা জজ আদালত, ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১, ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭, ঢাকার পারিবারিক আদালত-২, নওগাঁর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২, চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত, রংপুর ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, মানিকগঞ্জ দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালত-২, পরিবেশ আপিল ট্রাইব্যুনাল, খুলনা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩, ফেনী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, চাঁদপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১, ব্রাহ্মণবাড়িয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২, কুমিল্লা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, জামালপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, সিরাজগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, কুমিল্লা স্পেশাল জজ, চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩, ভোলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, লালমনিরহাট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, বিশেষ জজ আদালত-৫ ও ঢাকার প্রথম শ্রম আদালত। এ ছাড়া বিচারকশূন্য রয়েছে ময়মনসিংহ অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম দেউলিয়া আদালত, রাজশাহী অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, গাইবান্ধা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, ভোলা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, চুয়াডাঙ্গা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, পিরোজপুর অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, গাজীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও রংপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, সাতকানিয়া চৌকি সহকারী জজ আদালত ও সাতকানিয়া অতিরিক্ত সহকারী জজ আদালত, পটিয়া চৌকিতে তিনটি সহকারী জজ আদালত, রাউজান সিনিয়র সহকারী জজ আদালত, সহকারী জজ লোহাগাড়া আদালত সাতকানিয়া চৌকি, অতিরিক্ত জেলা জজ বাঁশখালী আদালত, বাঁশখালী চৌকি, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বন আদালত। 

ডেপুটেশন খালি রয়েছে— বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড অফিসার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের দুই উপসচিব ও যুগ্ম সচিব এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের উপসচিব পদ। 

সবচেয়ে বেশি বিচারক সংকটে পড়া চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এ এইচ এম জিয়াউদ্দীন বলেন, ‘নানা সংকটে চট্টগ্রামের আদালতগুলোতে বিচারপ্রার্থীদের হাহাকার চলছে। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা সংবলিত চিঠি প্রধান বিচারপতিকে দিয়েছি। এতে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়েছি। আশা করছি, বিচারপ্রার্থীদের কথা বিবেচনা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বিচার প্রক্রিয়া গতিশীল করতে হলে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। নতুন ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টির আগে অবকাঠামো ও বিচারক নিয়োগের বিষয়টি আগে বিবেচনা করতে হবে। তা না হলে অন্যান্য বিচারকদের ওপর চাপ বাড়ে।’ 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, ‘বিচারক সংকটের বিষয়টি পর্যালোচনা করে আমার প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আমরা সে সময় যেটি সঠিক মনে করেছিলাম সেটিই উল্লেখ করেছিলাম। আমরা আমাদের কাজ করে দিয়েছি। এটি কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বা হয়নি তা আমাদের জানা নেই। এখন আইন মন্ত্রণালয় কী করবে সেটি তাদের ব্যাপার।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক বিচারক একসাথে নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয়। আর নিয়োগ হলেও মান ও দক্ষতা নিয়ে কোনো আপস করা যাবে না। এ ছাড়া শুধু বিচারক নিয়োগ দিলেই হবে না, যথেষ্ট পরিমাণ আদালত ও লোকবল দরকার। তাদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হয়। এখন অবকাঠামোর যে সংকট তাতে একসাথে ৪৫ জনের বেশি বিচারককে প্রশিক্ষণই দেয়া যায় না। এ সমস্যাগুলো সমাধান সহজ নয়, বেশ কঠিন।’