Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

সাফল্য আসছে সবজি ও মশলা চাষে

আসাদুজ্জামান আজম

অক্টোবর ২৬, ২০২১, ০৭:০০ পিএম


সাফল্য আসছে সবজি ও মশলা চাষে

সাফল্য দেখাচ্ছে কৃষি গবেষণা। এমনই একটি গবেষণা সবজি ও মশলা চাষ পদ্ধতি। প্রকল্প এলাকায় ১০ শতাংশের বেশি চাহিদা মেটাচ্ছে ভাসমান সবজি ও মশলা। বর্তমানে ২৪টি জেলার ৪৭টি উপজেলায় ভাসমান বেডে সবজি ও মশলা চাষ হচ্ছে।

দক্ষিণাঞ্চল ও হাওর অঞ্চলের কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছে ভাসমান সবজি ও মশলা চাষে। আশানুরূপ সাফল্যের আশায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি ও সারা দেশে সবজি, মশলাসহ নতুন কৃষিপণ্য ভাসমান পদ্ধতি জনপ্রিয় করতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। 

তথ্য মতে, গবেষণার মাধ্যমে অনাবাদি জমি ব্যবহার ও কৃষিপণ্যের সহজলভ্য করার লক্ষ্যে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ভাসমান বেডে সবজি ও মশলা চাষ গবেষণা সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকরা লাভবান হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৃষক ভাসমান প্রকল্পে ঝুঁকছেন। 

সারাবছর পানি থাকে এমন জলাশয়, পুকুরগুলোতে ভাসমান বেড প্রকল্প জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সারা দেশে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠায় কৃষি জমির অপ্রতুলতা বাড়ছে। ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। এমন সময়ে অনাবাদি জমি মূল্যমান হয়ে উঠছে ভাসমান পদ্ধতির ফলে। একই বেডে অন্তত তিন দফা এবং একাধিক সবজি চাষের সুবিধা পাওয়ায় কৃষকরা অধিক আর্থিক লাভবান হওয়ার পাশাপাশি পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে পারছেন। জলাবদ্ধতা আর কচুরিপানা পরিণত হয়েছে আশীর্বাদে।

ভাসমান বেডে সবজি ও মশলা চাষ গবেষণা সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের উপ-পরিচালক ড. বিজয় কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ভাসমান বেডে সবজি ও মশলা চাষ দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রকল্প এলাকায় ১০ শতাংশের বেশি চাহিদা মেটাচ্ছে। আমরাও চেষ্টা করছি নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের মাধ্যমে কিভাবে আরও অধিক উৎপাদন করা যায়।আগামীতে সারা দেশে ভাসমান বেড পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। 

ড. বিজয় কৃষ্ণ বিশ্বাস আরও বলেন, ভাসমান বেড পদ্ধতির ফলে পরিত্যক্ত জলাশয়গুলো অর্থনৈতিক জোনে পরিণত হচ্ছে। সারা দেশে কৃষকদের ভাসমান পদ্ধতিতে উদ্ধুদ্ধ করতে আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালা অব্যাহত রেখেছি। বেড তৈরি, বীজ, সার সরবরাহের মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করছি। কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। 

ভাসমান বেড প্রকল্প অফিস সূত্র মতে, সারা দেশে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর নিচু জমি রয়েছে, যা মোট আয়তনের ২১ শতাংশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ০.২৫ মিলিয়ন হেক্টর প্লাবিত ভূমি রয়েছে। এছাড়া সারা দেশে প্রায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে, যার পরিমাণ ৮.৫৮ লাখ হেক্টর। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার কারণে এই অংশগুলো অনাবাদি থাকে। গবেষণার মাধ্যমে উপযুক্ত ভাসমান কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে প্লাবিত ভূমি ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করার জন্য নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 

ভাসমান বেডে চাষ যোগ্য ফসলের মধ্যে রয়েছে গ্রীষ্মকালীন সময়ে কলমিশাক, লাউশাক, ডাটাশাক, ডাটা, ঢেঁড়স, বরবটি, ঝিঙ্গা, শসা, করলা, বেগুন, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, পুঁইশাক, চাল কুমড়া, পানি কচু চাষ ও হলুদ। শীতকালীন সময়ে পালংশাক, লালশাক, ধনেপাতা, লেটুস, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, মূলা, টমেটো, লাউ, সিম, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, স্ট্রবেরি, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, সরিষা। বন্যার কারণে আগাম ভিত্তিতে লাউ, সিম, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, বেগুন, টমেটো চাষ করা যায়। রোপা আমন ধানের চারা উৎপাদন করা যায়।

জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে ভাসমান বেডে ঢেঁড়স, বরবটি, ঝিঙ্গা, পুঁইশাক, পানি কচু চাষ, লালশাক চাষ হয়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের তৈরি করা বেডে বেগুন, টমেটো চাষ করা যায়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের বেডে হলুদ লাগানো হয়। সারাবছরই ভাসমান বেডে লালশাক গিমাকলমি ইত্যাদি সবজি করা যায়। 

ভাসমান একক বা মিশ্র ফসল চাষ করা যায়। মিশ্রফসল চাষ বেশি লাভজনক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্রিজ সরাসরি ছিটিয়ে বা লাইনে বপন করা যায়।  আদা, হলুদ, আলু, কচু ফসলের কন্দ সরাসরি বেডে রোপণ করা যায়। ভাসমান বেডে চাষের জন্য সারের প্রয়োজন হয় না, কারণ তৈরিকৃত বেড একটি উন্নতমানের কম্পোস্ট পরিণত হয়।

ইতোমধ্যে ৪৭ উপজেলায় এ পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ সদর, টুঙ্গীপাড়া, কোটালীপাড়া, মুকসুদপুর, কাশিয়ানী, মাদারীপুর জেলার কালকিনি, রাজৈর, কিশোরগঞ্জ জেলার সদর, করিমগঞ্জ, নিকলী, ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার মদন, খালিয়াজুরী, বরিশালের বানারীপাড়া, উজিরপুর, আগৈলঝরা, পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর, নেছারাবাদ, ঝালকাঠি জেলার নলছিটি, যশোর জেলার কেশবপুর, মনিরামপুর, বাগেরহাটের ফকিরহাট, মোল্লারহাট, চিতলমারী, খুলনার ডুমুরিয়া, তেরোখাদা, সাতক্ষীরার কলারোয়া, নড়াইলের কালিয়া, কুমিল্লার নাঙ্গলকোট, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, বাঞ্ছারামপুর, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী, সিলেটের গোয়াইনঘাট, গোলাপগঞ্জ, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, নবীগঞ্জ আজমিরিগঞ্জ, নাটোরের সিংড়া, বড়াইগ্রাম, রংপুরের পীরগাছা, গাইবান্ধার সাঘাটা, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় ভাসমান পদ্ধতির সবজি ও মশলার চাষ হচ্ছে। এছাড়া প্রান্তিক পর্যায়ে সারা দেশে নিজ উদ্যোগে কৃষকরা ভাসমান বেডে আগ্রহী হয়ে উঠছে।

বরিশালের বানারীপাড়া বাশাইল গ্রামের চাষি তোফাজ্জেল হোসেন জানান, ভাসমান চাষ পদ্ধতি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। অনাবাদি জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে বিভিন্ন শাকসবজি উৎপাদনে অনেকে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। সরকারিভাবে আমাদের প্রশিক্ষণ ও সার-বীজ দেয়া হয়। বেড তৈরি করে দেয়া হয়। আমাদের গ্রামের নারী-পুরুষ সবাই এখন ভাসমান চাষে সম্পৃক্ত। 

হাওরাঞ্চল অধিকাংশ সময় পানিতে ডুবে থাকে। এসব এলাকার বাড়ির আশপাশ, বিল-ঝিলে পানি থাকে। অনেক বাড়ির মজা পুকুর, দীঘিও খালি পড়ে থাকে। এগুলো সাধারণত ফেলে রাখা হয়। পানিতে ডুবে থাকা এসব জায়গায় ভাসমান বেপ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মৌলভীবাজারের হাইল হাওর, বাইক্কা বিলসহ বিভিন্ন জলাবদ্ধ এলাকা এবং নিম্নাঞ্চলে ভাসমান বেডে সবজি চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে। 

স্থানীয় প্রতিনিধি ও কৃষি অফিসের তথ্য মতে, ভাসমান চাষ পদ্ধতিকে স্থানীয় ভাষায় বলে ধাপ পদ্ধতি বা বেড় পদ্ধতি। কচুরিপানা, টেপাপানা যেন সবুজের জৈব গালিচা। কচুরিপানাকে তারা ধাপে ধাপে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে। তারপর সেসব ধাপের ওপর টেপাপানা দিয়ে তৈরি করে ভাসমান বীজতলা। একেকটি ভাসমান ধাপ বেড কান্দি ৫০ থেকে ৬০ মিটার (১৫০ থেকে ১৮০ ফুট) লম্বা ও দেড় মিটার (৫ থেকে ৬ ফুট) প্রশস্ত এবং এক মিটারের কাছাকাছি (২ থেকে ৩ ফুট) পুরু বা উঁচু বীজতলা ধাপ তৈরি করে তার ওপর কচুরিপানা এবং পর্যায়ক্রমে শ্যাওলা, দুলালীলতা, টেপাপানা, কুটিপানা, কলমিলতা, জলজলতা স্তরে স্তরে সাজিয়ে নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া ও ক্ষুদ্রাকৃতির বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ পচিয়ে বীজতলার ওপর ছড়িয়ে দেয়। 

সেখানেই বীজ বপন করে উৎপাদন করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির শাক আর দৌলা বা মেদা সাজানো চারা, এমনকি অল্প জীবনকাল সম্পন্ন বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। ভাসমান বা ধাপ পদ্ধতিতে সরাসরি বীজ বপন সম্ভব না হওয়ায় কৃষকরা প্রতিটি বীজের জন্য এক ধরনের আধার তৈরি করেন। তারা এর নাম দিয়েছেন দৌলা বা মেদা। একমুঠো আধা পচা টেপাপানা বা ছোট কচুরিপানা, দুলালীলতা দিয়ে পেঁচিয়ে বলের মতো করে তার মধ্যে মধ্যে নারিকেল ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় দৌলা।