Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ই-কমার্সে আশার আলো

রেদওয়ানুল হক

অক্টোবর ২৭, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


ই-কমার্সে আশার আলো
  • তিন মাসে ক্রেতাদের টাকা ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত
  • ইভ্যালি পরিচালনায় কার্যক্রম শুরু করেছে হাইকোর্ট গঠিত বোর্ড
  • অনিবন্ধিত ই-কমার্স বন্ধের সিদ্ধান্ত
  • আইন প্রণয়নে কাজ করছে মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি
  • তিন মাসের মধ্যে গ্রাহকের আস্থা ফিরবে, আশা ই-ক্যাব সভাপতির
  • গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে

গত কয়েক বছরে ঘরে বসে অনলাইনে পণ্য কেনাকাটা বা ই-কমার্স ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর গোটা খাতটি এখন ভুগছে আস্থার সংকটে। সমপ্রতি খুব অল্প সময়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়া কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতসহ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সাথে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। 

ডিসকাউন্ট-সাইক্লোন ইত্যাদি লোভনীয় অফার চালু করে ২০-১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক দেয়া হবে বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করে প্রতারণার ফাঁদ পাতে এসব প্রতিষ্ঠান। হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতটি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ে। 

এরপর প্রতারিত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়া ও সম্ভাবনাময় এ খাতে গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে নানান ধরনের উদ্যোগ নেয় সরকার। সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু উদ্যোগে এখাতে আবারো আশা দেখতে শুরু করেছে গ্রাহক-মার্চেন্টরা। ই-কমার্স খাতে আস্থার জায়গা ধরে রাখতে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। 

নির্দেশিকায় প্রধানত পণ্য সরবরাহ ও রিফান্ড দেয়ার সময় বেঁধে দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে পাঁচদিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। ভিন্ন শহরে অবস্থান করলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য স্টকে না থাকলে সেটার কোনো পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। 

আগাম পরিশোধ করা টাকা পণ্য সরবরাহের পরই বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারি-ম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি-ম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবে। সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা সেবা ডেলিভারি-ম্যানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় না থাকলে ই-কমার্স কোম্পানি পণ্য মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ অগ্রিম নিতে পারবে না।

এরপর গত ২৭ সেপ্টেম্বর ই-কমার্সে শৃঙ্খলা আনতে অথরিটি (কর্তৃপক্ষ) গঠন ও ডিজিটাল কমার্স আইন প্রণয়নে কারিগরি বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের মহাপরিচালক এবং আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি। 

৩ অক্টোবর অনলাইনে কেনাকাটার বিজ্ঞাপনে বাধ্যতামূলকভাবে সতর্কবার্তা প্রচারের নির্দেশনা জারি করা হয়। এতে বলা হয়, ‘অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা হতে সাবধান থাকুন— বাণিজ্য মন্ত্রণালয়’ শীর্ষক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত অনলাইন কেনাকাটার বিজ্ঞাপনের শেষে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ২৫ অক্টোবর সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ই-কমার্স নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ই-কমার্স পেমেন্ট গেটওয়েতে ক্রেতাদের আটকে থাকা ২১৪ কোটি টাকা আগামী তিন মাসে ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করবে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।

মন্ত্রী জানান, বৈঠকে নিবন্ধনের জন্য ইউনিক আইডি, সেন্ট্রাল লগ ইন ট্রাকিং সিস্টেম, কমপ্লেন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু এবং ১ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত স্ক্রো সার্ভিসে আটকে পড়া টাকা ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন হবে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ক সফটওয়্যার বিষয়ে আইসিটি বিভাগ তথ্য জানাবে। যারা ই-কমার্সের নিবন্ধন করবে না তারা ব্যবসা করতে পারবে না। “যারা নিবন্ধন করবে না তারা ব্যবসা থেকে ‘আউট’ হয়ে যাবে।” 

অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির গ্রাহকদের অর্থ ফেরত ও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয় সরকার। গ্রাহকের মামলায় প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার হওয়ার পর গত ১৮ অক্টোবর ইভ্যালির ব্যবস্থাপনার জন্য আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের বোর্ড গঠন করে দেন হাইকোর্ট। 

বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বোর্ড গঠন করেন। বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন— স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ রেজাউল আহসান, ওএসডিতে থাকা আলোচিত অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফখরুদ্দিন আহম্মেদ, কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ। রাজধানীর ধানমন্ডিতে ইভ্যালির কার্যালয়ে ২৬ অক্টোবর প্রথম সভা করে এই পরিচালনা বোর্ড। 

এরমধ্য দিয়ে ইভ্যালির কার্যালয়ের দখল বুঝে নিয়েছেন তারা। বৈঠক শেষে বোর্ডের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জানান, গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি, তবে এ প্রক্রিয়ায় কিছু সময় লাগবে। 

তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি এই প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে বাঁচানো যায়। আমরা অনেক খোঁজখবর পেয়েছি। অনেক ইনফরমেশন পেয়েছি। অনেক কর্মকর্তার নাম পেয়েছি। সবাইকে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। গ্রাহকরা কত টাকা পাবে সেগুলোর হিসাব করতে হবে। ইভ্যালির কত সম্পদ আছে সেটাও হিসাব করতে হবে। এগুলো অডিট করার পর টাকা ফেরতের বিষয় আসবে এতে সময় লাগবে।’ বিদেশে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। একই সাথে রাসেলের শ্যালিকাসহ আর কারা আছে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং তারা যেনো দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন সেই ব্যবস্থা নিচ্ছে নতুন বোর্ড।

অন্যদিকে গ্রাহকদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বোর্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট থেকে মঙ্গলবার এক স্ট্যাটাসে তিনি এ পরামর্শ দেন। তিনি লিখেছেন, ‘যা কিছু দেখবেন শুনবেন জানবেন, আতঙ্কিত বা হতাশ হবেন না। 

আস্থা বা বিশ্বাস রাখুন, অপেক্ষা করুন। কষ্ট যা হবে, আমার হবে। হয়তো তিন গুণ কষ্ট বেড়ে যাবে, এই যা।’ আগামীতে যা হবে সেখানেও কোনো প্রকার অনিয়ম হবে না বলে আশ্বস্ত করে মাহবুব কবীর মিলন লিখেছেন, ‘যা হবে বিন্দু পরিমাণ বিচ্যুতি বা অনিয়ম বা ম্যানিপুলেশন থাকবে না। সময় দিন, অপেক্ষা করুন।’ সরকারের এমন উদ্যোগে নতুন করে ই-কমার্স নিয়ে আশান্বিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। এসব উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সম্ভাবনাময় এ খাতটি দ্রুত সময়ে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার বলেন, ‘ই-কমার্সে আস্থা ও শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।’ ই-ক্যাব ও সরকারে নেয়া পদক্ষেপ আগামী তিন মাসের মধ্যে গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে সক্ষম হবে বলে জানান তিনি। 

ইক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন জানিয়েছেন, গ্রাহকের আস্থা ও শৃঙ্খলা আনার জন্য ইক্যাব দুটি কাজ করছে। প্রথমত সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা এবং দ্বিতীয়ত প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের স্বার্থ রক্ষা হবে এবং আস্থা ফেরত আসবে। একই সাথে সচেতনতার মাধ্যমে মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। 

এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে কিছুটা সময় লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি শিগগিরই গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসবে এবং তারা আবার আগের মতো ই-কমার্সে কেনাকাটা করবে।’ 

তিনমাসের মধ্যে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (মুখপাত্র) মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অপেক্ষা করছি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পেলে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’