Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

বিট পুলিশিং সেবার অনন্য উদ্যোগ

অক্টোবর ২৭, ২০২১, ০৬:৪০ পিএম


বিট পুলিশিং সেবার অনন্য উদ্যোগ

বাংলাদেশের মোট থানার সংখ্যা ৬৫২টি। নতুন দুটি থানা যথাক্রমে ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি এবং ২০ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয়। ৬৫১তম নোয়াখালী জেলার ভাসানচর থানা এবং ৬৫২তম কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁও থানা। 

চুরি-ডাকাতি রোধ, ছিনতাই প্রতিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইত্যাদি সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধসহ বিভিন্ন জনসভা, নির্বাচনি দায়িত্বে বাংলাদেশ পুলিশ অংশগ্রহণ করে থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাংলাদেশের পুলিশের নাম প্রথমে ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ রাখা হয়। 

বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় হলো ১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন ডিপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, বেশ কয়েকজন এসপিসহ প্রায় সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্য বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে জীবনদান করেন। 

মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ পুলিশ নামে সংগঠিত হয়। বাংলাদেশ পুলিশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পুলিশ বাহিনীর মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে বাংলাদেশ পুলিশ। 

এমন ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট থেকে থানার পুলিশি সেবা জনগণের একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছানো এবং পুলিশের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও গণমুখী করার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করছে। উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে এবং টেকসই করতে হলে টেকসই সুষ্ঠুু আইনশৃঙ্খলার কোনো বিকল্প নেই। আর টেকসই আইনশৃঙ্খলার জন্য জনগণের সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক। সে জন্য পুলিশকে গণমুখী ও জনবান্ধব করার জন্য সময়ের পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে আমরা কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি, এমনটি মন্তব্য করেছেন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। 

যুগোপযোগী টেকসই সম্প্রসারিত বিট পুলিশিংয়ের ব্যাপারে পুলিশ প্রধান বলেন, ‘আইনগত পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতার মাঝে এ সব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে পুলিশের ভূমিকাকে আরও উজ্জ্বল করেছে এবং পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট কাটিয়ে পুলিশ-জনতা সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। 

এসময় বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি নাগরিকের পুলিশি সেবা প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে টেকসই সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং অন্যতম ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এ সময়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক আরো বলেন, সরকারের উদ্যোগে জনবল বৃদ্ধির পর যদিও পুলিশ-জনতা অনুপাত এখনো আন্তর্জাতিক মানের অনেক পেছনে, তবুও নিঃসন্দেহে বলা যায়— বর্তমানে পুলিশের সক্ষমতাও অনেক বেড়েছে। 

আর এই ক্ষেত্রে রেঞ্জ পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র্যাব), রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি), হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), স্পেশাল সিকিউরিটি অব প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন (এসপিবিএন), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (এপিবিএন), এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এএপি), নৌপুলিশসহ পুলিশের সকল ইউনিটের অনিবার্যতা স্বীকার করতেই হবে। 

ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ আরো বলেন, ‘পুলিশকে কিভাবে জনমুখী ও জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়, প্রতিটি থানার প্রত্যন্ত এলাকাতে কিভাবে পুলিশের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়, পুলিশের কার্যক্রমে কিভাবে আরো গতি আনা যায় এবং সর্বোপরি বিদ্যমান জনবলের সর্বোচ্চ ব্যবহারের নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে পুলিশকে কিভাবে একটি গতিশীল ও জনসেবা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যায় এসব বহুমুখী প্রশ্নের সমাধানের পথ হচ্ছে সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং কার্যক্রম। 

পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স উইংয়ের সহকারী মহা পরিদর্শক (এআইজি) মো. কামরুজ্জামান বলেন, বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে শহর এবং গ্রাম এলাকায় নিবিড় পুলিশিং সম্ভব হয়। বাংলাদেশের বিশাল বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে নিবিড় পুলিশিংয়ের কোনো পদ্ধতি এখনো প্রচলিত নেই। বর্তমানে থানাগুলোর জনবল কাঠামো ও থানাগুলোর ইউনিয়ন সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিট পুলিশিংয়ের কার্যক্রম ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত করা সম্ভব। যেহেতু বিট পুলিশিংয়ের মূল আইনি ভিত্তি— নির্যাস অক্ষুণ্ন রেখে শহর এলাকার বাইরে ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সেবার মান বিস্তার ঘটানো, সে জন্য এর নামকরণ করা হয়েছে ‘সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং। 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স কৃষ্ণপদ রায় বিপিএম (বার) পিপিএম (বার) বলেন, প্রয়োজনের নিরিখে বিট পুলিশিং। 

এসময়ে তিনি আরো জানান, পুলিশের অনিয়মিত উপস্থিতির সুযোগে অপরাধীরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। গ্রাম্য টাউট ও দালালদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। এলাকা থেকে অপরাধ, অগ্রিম গোয়েন্দা তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগও সীমিত হয়ে পড়ে। পুলিশের নজরদারি হ্রাস পায়। এমতাবস্থায়, সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বর্ণিত সবগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। বিট পুলিশিংয়ের কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, নারী শিশুদের কল্যাণ প্রভৃতি। আইনশৃঙ্খলা সভা, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সভা, পারিবারিক বিরোধ নিরসন এবং নারী ও শিশুকল্যাণ সভা, চোরাচালান নিরোধ সভা প্রভৃতি। বিষয়গুলো পুলিশি দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত বলে জানান।

আর এ ব্যাপারে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার) পিপিএম (বার) বলেন, ইউনিয়ন পরিষদকে সম্প্রসারিত বিট পুলিশিংয়ের মূল কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। 

উল্লেখ্য, বিট কর্মকর্তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিধি প্রণয়ন করা হয়েছে এবং তাদের রিপোর্টিং সিস্টেমও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে একজন বিট কর্মকর্তাকে ১৩টি সুনির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে এর পরিধি আরো বাড়ানো হয়েছে। 

দায়িত্বগুলোর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হচ্ছে— এলাকার মাদক বিষয়ক, ওয়ারেন্টধারী, অপরাধী, ভাড়াটিয়া ও প্রবাসীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা ও উঠান বৈঠক করা ইত্যাদি। সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং কার্যক্রমে থানায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বিট পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে মামলা তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তার, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক তথ্য সংগ্রহ করবে। 

তিনি আরো বলেন, এতে করে জনতা আর পুলিশের সম্পর্ক আরো মজবুত হবে। বিট পুলিশিংয়ের প্রত্যাশিত সুফল ও সুবিধা পাবে সাধারণ জনগণ। ফলে একদিকে যেমন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে অন্যদিকে পুলিশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। এ কার্যক্রমকে সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং থেকে সুবিধা হলো পুলিশের সাথে জনগণের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠবে, পুলিশ-জনগণের মধ্যে দূরত্ব হ্রাস পাবে, জনগণ তাদের সমস্যাবলি খুব সহজেই পুলিশকে জানাতে এবং প্রতিকার চাইতে পারবে। 

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম পিপিএম বলেন, ইউনিয়ন পর্যন্ত পুলিশের উপস্থিতির কারণে এলাকায় অপরাধ, মাদকের ব্যবসা ও ব্যবহার, জঙ্গিদের হুমকি, নারী ও শিশুদের প্রতি অপরাধ প্রবণতা (যেমন-ইভটিজিং, বাল্যবিয়ে) হ্রাস পাবে। বিট কর্মকর্তা স্থানীয় চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় স্থানীয় পর্যায়ের ছোটখাটো বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হবেন। 

যার মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী নাগরিকদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে, সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা উন্নত হবে। পুলিশ কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ের অপরাধ চিত্র, অপরাধীদের তথ্য, অগ্রীম গোয়েন্দা তথ্য, নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ গণতান্ত্রিক পুলিশিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সকল তথ্য সরাসরি সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে। জনবহুল বাংলাদেশে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো ভূমি। 

গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভূমির মালিকানা নিয়ে উদ্ভূত বিরোধ, হানাহানি, খুন তথা ফৌজদারি অপরাধে পর্যবসিত হয়। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে এই সব শরিকি বিরোধ ও শত্রুতা প্রাথমিকভাবে নিষ্পত্তি করা যায়; যা গুরুতর অপরাধ সংঘটনের সম্ভাবনা হ্রাস করে। ইভটিজিং, যৌতুক, বাল্যবিয়ে ইত্যাদি সামাজিক সমস্যা নিরসন ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করা অতীব জরুরি। 

সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং এমন একটি মাধ্যম যার সাহয্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এসব অপরাধ অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। যার ফলে একদিকে যেমন প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ পুলিশি সেবা পাচ্ছে সেই সাথে বাড়ছে পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গা। আগামীর সম্ভাবনাময় উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং কার্যক্রম সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।