Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

রাজনীতিতে বিষাক্ত মেরুকরণ!

অক্টোবর ৩০, ২০২১, ০৭:১০ পিএম


রাজনীতিতে বিষাক্ত মেরুকরণ!

ফাঁকা মাঠেও অশান্তি! আওয়ামী লীগে ক্ষমতা নিয়ে রক্ত ঝরছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামাতে চাচ্ছে বিএনপি। হঠাৎ ভুঁইফোঁড় সংগঠনের নানান কর্মসূচি। ঢাকায় প্রতিদিনই সাত-আটটি অনুষ্ঠানে শীর্ষ নেতাদের সক্রিয়তা।

আক্রমণাত্মক কথাবার্তা ছোড়া হচ্ছে। কূটনীতিতে উল্টো সূর। পবিত্র কুরআন অবমাননার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপে হামলা, অগ্নিসংযোগ, প্রতিবাদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এখনো চলছে ধারাবাহিক প্রতিবাদ। চট্টগ্রামে ইসকনের চলছে সিরিজ আন্দোলন। 

পূজামণ্ডপে হামলা নিয়ে জাতিসংঘে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির চিঠি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘সমপ্রীতি সমাবেশ ও শান্তি শোভাযাত্রা’, বিএনপির সমপ্রীতির মিছিলে সংঘাত-সংঘর্ষ, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের ‘বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ’ নামে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ, নুরের দলকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে প্রতিপক্ষের প্রচারণা, পূজামণ্ডপে হামলা ইস্যুতে মামলা ও গণগ্রেপ্তার, আওয়ামী লীগে নির্বাচন প্রস্তুতি নিয়ে চলছে ঘরে ঘরে ক্ষমতার লোভ,  চলছে লোভের লড়াই! 

অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সরকারের ব্যর্থতা উপস্থাপন, তরুণদের নিয়ে লড়াইয়ের বার্তা দিচ্ছে বিএনপি। দেশের কূটনীতিকপাড়ায় এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নজর রাখছে আন্তর্জাতিক মহলও। দেশে কোনো ধরনের রক্তঝরা পরিস্থিতি চাচ্ছে না তারা। বাংলাদেশকে বড় ব্যবসায়িক জোন হিসেবে নজর রাখা হয়েছে। 

যেকোনো মূল্যে শান্তি ধরে রাখতে রাজনৈতিক ঘরে ঘরে শান্তি বার্তা পৌঁছানো হচ্ছে। এ নিয়ে রাজনীতিতে বিষাক্ত মেরুকরণ দেখছে দেশের অভিজ্ঞ মহল। তারা বলছে, দেশে আন্দোলনের নামে কোনো পরিস্থিতি তৈরি হোক আমাদের পার্শ্ববর্তী কোনো দেশই তা চাচ্ছে না। এ জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে অতীতের চেয়ে এবার বিশেষ কিছু দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও তারা নজর রেখেছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রের ভাষ্য, ক্ষমতাসীন দলের দীর্ঘ সময় ক্ষমতার অবস্থানে বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে বৃহৎ ব্যবসার জোন তৈরি করেছে। এখানে এখন অতীতের মতো হরতাল, অবরোধ, সংঘর্ষ কিংবা আন্দোলনের নামে দেশের চলমান পরিস্থিতি উত্তপ্ত হোক— তা কেউ চাচ্ছে না। শান্তিপূর্ণভাবে ফের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক, কিংবা শান্তিপূর্ণভাবেই দেশে একটি পরিবর্তন আসুক— এটাই বিশেষ দেশগুলোর চাওয়া। উত্তপ্ত পরিবেশ তৈরি হয়ে ব্যবসার ক্ষতি হোক, কিংবা শক্তিশালী অবস্থানের রদবদল হোক তা-ও কেউ চাচ্ছে না। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দেয়া হচ্ছে শান্তির বার্তা। 

তবে এ নিয়ে দলগুলোর কূটনৈতিক ব্যক্তিদের ভিন্নমত রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল বলছে, একটি অংশ বিএনপিকে দিয়ে নতুনভাবে ফায়দা হাসিলের উদ্দেশে কাজ করছে। আওয়ামী লীগ তা বুঝতে পেরে সতর্কতা অবলম্বন করছে। বিশেষ করে সামপ্রদায়িক ইস্যুতে অতীতে রাজনৈতিক হামলা কেউ স্বীকার করেনি। এবারই দেখা গেলো ভিন্নতা। প্রধান দুদলেই একে অপরকে সরাসরি দোষারোপ করেছে। হিন্দুবাদী ভারতও এ নিয়ে কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে জবাব দিয়েছেন। 

জানা গেছে, অতীতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় ভারতের কোনো সরকার আওয়ামী লীগকে সরাসরি দায়ী করেনি। এবার বিজেপি সরকার আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছে; তাদের ওপর আঙুল তুলেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের চিঠি, জাতিসংঘের অধিবেশনের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বক্তব্য ‘আর কোনো দেশের অনির্বাচিত সরকারকে সমর্থন করা হবে না’, চীনের সাথে সুসম্পর্ক নিয়ে ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতের উক্তি— সবকিছু বার্তা দেয়। 

প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ভারতের উচিত নিজেদের লোকদের নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা, তাদের কোনো কথায় যেনো এখানে কোনো প্রভাব না ফেলে।’ সেখানেও (ভারতে) এমন কিছু যেনো না করে— যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে আর আমাদের হিন্দু সমপ্রদায়ের ওপর আঘাত আসে। প্রতিবেশী দেশেও এমন কিছু যাতে না করা হয়, যার প্রভাব এখানে পড়ে।’ 

সমপ্রতি এ বিষয়গুলো দেশের মানুষকে ভাবাচ্ছে। এ ছাড়া এখনো পূজামণ্ডপে হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনের নামে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেস-ইসকন উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামে এখনো কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। 

ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের ঘটনায় ভূমিকা নেয়ার অনুরোধ জানান। এ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূলের মুখপাত্র জাগো বাংলার ‘বাংলাদেশের হূদয় হতে’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশ ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সেখানে লেখা হয় ‘আমরা বিস্মিত, ভারতের যে প্রধানমন্ত্রী ভোট টানার অঙ্কে বাংলাদেশে পূজা দিতে গিয়ে প্রচার সারলেন, তিনি প্রথম থেকে নিষ্ক্রিয় কেন? নাকি বাংলাদেশের হিন্দুনিগ্রহ দেখাতে পারলেন, সেই সুড়সুড়ি দিয়ে এই বাংলায় হিন্দু-আবেগ উসকে ভোট করার চেষ্টা? বাংলাদেশের ঘটনায় যথাযথ তদন্ত চাই।’ এই ইস্যুতে বিজেপির ভূমিকা নিয়েও তীব্র সমালোচনা করেছে তৃণমূলের মুখপাত্র জাগো বাংলায়। 

প্রথম পাতায় ‘শকুনের রাজনীতি বিজেপির’ শিরোনামে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘বাংলাদেশের হিংসা নিয়ে বিজেপি কোনো রাজনৈতিক চাল দেয়ার পরিকল্পনা করছে। না হলে কেন শুভেন্দু অধিকারী বলবেন, বাংলাদেশের ঘটনার পর আমাদের (বিজেপি) ভোট বাড়বে? আমরা জিতবো সামনের ভোটগুলোয়? তাহলে তো স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সমীকরণ ঠিক কী?’ 

কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিদিনে লেখা হয়, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দায় সরব আমেরিকা। এই মর্মে এক বিবৃতি জারি করে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর চলা নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগও প্রকাশ করেছে মার্কিন বিদেশ দপ্তর। 

বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দলের প্রধান দুই ব্যক্তি ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখনো ওই ঘটনায় একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এ নিয়ে কথা বলা রুটিন ওয়ার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের। 

এর মধ্যে রাজনীতিতে নতুন হাওয়া। তৈরি হচ্ছে নতুন দল— ড. রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হককে নিয়ে। নাম দেয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ’।  এসেই তাদের ঘোষণা— আগামী নির্বাচনে তারা ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। এদিকে  আত্মপ্রকাশের পরই নতুন দলটিকে ‘পরিচিত করে তুলতে’ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠন দলটিকে নিষিদ্ধের দাবি জানায়। 

নতুন দলের নেতা ড. রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হককে গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবরোধ করেন ওই সংগঠনের নেতাকর্মীরা। নুরের নতুন দলকে দেশবাসীর সামনে পরিচিত করে তুলতেই এমন নিষিদ্ধের দাবি কি-না তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। অনেকেই মনে করছেন, বিএনপি যদি শান্তি বজায় রাখার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে সরকারের সমালোচনার জন্যই রেজা-নুর বিকল্প হিসেবে থাকবে।

তবে এবারই বিস্ময়করভাবে প্রায় তিন বছর আগ থেকে দু’দলে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ এক বছর পর গত ৯ সেপ্টেম্বর দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা করে। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া বিএনপি ছাড়াই একচেটিয়া খালি মাঠে খেলছে আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ভোট প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে এক মাসে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে ক্ষমতাসীন দলের আট নেতাকর্মী-সমর্থক নিহত হয়েছেন। চলমান ইউপি-পৌর নির্বাচন ঘিরে প্রায় দুইশর মতো সংঘর্ষের ঘটনায় ৩৮ জন নিহত ও আহত হয়েছেন দুই সহস্রাধিক। 

নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে কেন্দ্র থেকে। উপদেষ্টা ও ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সদস্যসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সাথে বৈঠক করেছে বিনপি। এ ছাড়া দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা সভাপতিদের নিয়ে বৈঠক করেছে। পেশাজীবী, আইনজীবী, শ্রমজীবী, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের সাথে মতবিনিময় করে। যার উদ্দেশ্য— নির্বাচন। বৈঠকগুলো থেকে বলা হয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে আগে বিএনপিকে আন্দোলনে জিততে হবে। এটি না হলে নির্বাচনে গিয়ে আবারো ভরাডুবি হবে। 

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘মন্দিরে কুরআন শরিফ রেখে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অবমাননা করেছে বিএনপি। তাই তাদের বিরুদ্ধে আলেম-ওলামাদের সোচ্চার হতে হবে।’ ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘একটি অশুভ মহল দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের গুজব, অপপ্রচার চালাচ্ছে, যা আমাদের গণতন্ত্র ও সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ বিষয়ে  আরও সতর্ক থাকতে হবে দলীয় লোকদের।’
 
এ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনি মাঠ খালি করতেই সরকার পূজামণ্ডপের ঘটনায় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। পূজামণ্ডপের ঘটনায় এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৬০টি। আসামি সংখ্যা ১৫ হাজার ৯৬ জন। ইতোমধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ১৮৬ জনকে। এরমধ্যে বিএনপির ১৬৮ জন। বিএনপির যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা কেউ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না। অথচ ওই ঘটনার পেছনে সরকারের মদত আছে।’ 

তিনি বলেন, ‘দেশের ঘটনাগুলো নিয়ে তরুণদের জাগ্রত হতে হবে। তাদেরকে লড়াইয়ের জন্য মাঠে নামতে হবে।’

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত আমার সংবাদকে বলেন, ‘প্রথম কথা— সামপ্রদায়িক যে হামলা হলো, সেসব অতীতে কোনো রাজনৈতিক দল স্বীকার করেনি। এ সরকারও স্বীকার করে না। এবারের একটি ইতিবাচক দিক হলো, উভয় দলই সামপ্রদায়িক হামলা হয়েছে বলে স্বীকার করেছে।’