Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

বিচার বন্ধ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের

নভেম্বর ১, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


বিচার বন্ধ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের

আন্তর্জাতক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আলোচিত মানবতাবিরোধীদের দণ্ড কার্যকরের পরই বিচারিক কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ২৯ যুদ্ধাপরাধীর বিচার দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। এছাড়া করোনা মহামারিসহ অন্যান্য কারণে প্রায় ২০ মাস ধরে কার্যক্রম স্থগিত ছিলো। 

ফলে ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মামলা ও এ সংক্রান্ত আপিল জমে আছে। এসময়ে নতুন অভিযোগের তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে ভুক্তভোগী ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবারসহ বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। 

গত আট মাসে কোনো মামলায় রায়ও হয়নি। ১৬ মাস ধরে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা থেকে কোনো নতুন মামলার প্রতিবেদনও জমা পড়েনি। 

এদিকে বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ায় প্রসিকিউশন অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। সংকট পড়েছে বিচারকেরও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত শীর্ষ ছয় যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ও সাজা কার্যকরের পর ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজে গতি কমে এসেছে। আলোচিত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি সম্পন্ন হওয়ার পরই মূলত গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে পরবর্তী বিচারকাজ। 

সেই সাথে সাক্ষী হাজির ও তদন্তের সময় ক্ষেপণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিচারকাজ। আবার প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবের মামলার তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করাও সম্ভব হচ্ছে না। গত সাড়ে সাত মাসে একসময়ের আলোচিত এই ট্রাইব্যুনালে হয়নি কোনো বিচারের রায়। অভিযোগ রয়েছে, ওই রিভিউ আবেদন ও যুদ্ধাপরাধীদের আপিল দ্রুত শুনানি করতে রাষ্ট্রপক্ষের তেমন উদ্যোগ নেই। 

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২৩৭ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের মামলা বিচারাধীন। বিচারক শূন্যতায় ট্রাইব্যুনালেও বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। 

রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আপিল বিভাগে একটি বেঞ্চ থাকার কারণে যুদ্ধাপরাধীদের আপিল ও রিভিউ আবেদনের শুনানি দ্রুত করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, ট্রাইব্যুনালে একজন বিচারপতিকে দ্রুত নিয়োগ দিলে বিচার প্রক্রিয়ায় যে  স্থবিরতা তা কেটে যাবে। 

এদিকে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের বিচারক আমীর হোসেন গত ২৪ আগস্ট মারা যান। এতে একটি সদস্য পদ শূন্য হয়। আইন অনুযায়ী দুজন সদস্য দিয়ে এর বিচার কাজ চালানোর সুযোগ নেই। তাই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের জন্য একজন বিচারপতি নিয়োগ দিতে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠানো হয়েছিল। 

গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমকে ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই দায়িত্ব নেবেন তিনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এর একটা কারণ হয়তো হতে পারে যে, আলোচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়ে গেছে, অনেকের দণ্ডও কার্যকর হয়ে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। কিন্তু সরকারের ঘোষণা ছিলো, দেশে একজন মানবতাবিরোধী অপরাধী থাকা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কাজ চলবে। 

তারা বলেন, মামলার যে ধীরগতি তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর এখন মাত্র একটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। দুটি ট্রাইব্যুনাল করা হলেও একটি ট্রাইব্যুনাল এখন আর নেই। সে জন্য মামলা বিচারে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ৪৭২টি অভিযোগ ঝুলছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা দুই হাজার ৭৪৪ জন। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষে বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় স্থানীয় তৃণমূল যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জমা পড়া সাত শতাধিক অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ থমকে আছে। বর্তমানে যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে আগামী ১০ বছরেও এই সাত শতাধিক অভিযোগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। 

একদিকে তদন্ত সংস্থায় জনবল সংকট, অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের মামলা নিষ্পত্তির গতিও এর বড় কারণ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রতি বছর গড়ে চার থেকে পাঁচটি রায় হয়ে থাকে। কিন্তু গত পৌনে দুই বছরে মাত্র একটি মামলার রায় হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সংস্থার সংশ্নিষ্টরা জানান, মুজিববর্ষে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়েছিল, লক্ষ্য ছিলো যাচাই-বাছাই শেষে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ অভিযোগ নিষ্পত্তি করা। কিন্তু গত বছর মার্চ থেকে দেশে মহামারি করোনা ভাইরাস বেড়ে যাওয়ায় তা আর করা সম্ভব হয়নি। 

সর্বশেষ চলতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের গফরগাঁও এবং ভালুকার আট রাজাকারকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে তিন আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং পাঁচ আসামিকে ২০ বছর করে সাজা দেয়া হয়। এরপর আর কোনো রায় হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পর্যায়ক্রমে আরও শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মো. মোবারক হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আফসার হোসেন চুটু ও মাহিদুর রহমান, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক, বাগেরহাটের সিরাজুল হক ও খান আকরাম হোসেন, নেত্রকোনার আতাউর রহমান ননী ও ওবায়দুল হক খান তাহের, কিশোরগঞ্জের শামসুদ্দিন আহমেদ, মোসলেম প্রধান, হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান বড় মিয়া, মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া ও আবদুর রাজ্জাক, জামালপুরের সামসুল হক ওরফে বদর ভাই ও এস এম ইউসুফ আলী এবং যশোরের সাবেক এমপি ও জামায়াত নেতা সাখাওয়াত হোসেন ও বিল্লাল হোসেন, নোয়াখালীর সুধারামের আমীর আলী ও জয়নাল আবেদীন, মৌলভীবাজারের উজের আহমেদ ও ইউনুছ আহমেদ, ফুলবাড়িয়ার রিয়াজউদ্দিন ফকিরসহ ২৯ জন।

তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক বলেন, করোনার কারণে অনেকদিন মাঠপর্যায়ে তদন্ত কাজ বন্ধ ছিলো। এখন কিছুটা চালু হয়েছে। বিচার না চলায় অনেক বিচারপ্রার্থী হতাশায় ভুগছেন। কারণ সাক্ষী ও আসামিদের বয়স হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক সাক্ষী ও আসামির মৃত্যু হয়েছে। যেসব আসামি বেঁচে আছেন, তাদের বিষয়ে দ্রুত তদন্ত না হলে এদেরও স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে। 

তিনি বলেন, দ্রুতই দু-তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। ৭৯০টি অভিযোগের মধ্যে গত ১১ বছরে যাচাই-বাছাই করে মোট ৭৮টি মামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। জনবল সংকটের কারণে তদন্ত কাজে দেরি হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ শিমন বলেন, বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমরা মামলাগুলো স্টাডি করছি। খুব শিগগিরই কয়েকটি রায় পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি। 

প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এখন পর্যন্ত ৪২টি মামলায় ১০৩ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার রায় হয়েছে। এর মধ্যে ৭১ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। 

বিচারাধীন আছে ৩৮টি মামলা, যেগুলোর আসামি সংখ্যা ২৩২ জন। এ ছাড়া আপিল ও রিভিউ শেষে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০টি মামলা। যার মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। রায় ঘোষণা অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত ৪২ যুদ্ধাপরাধী পলাতক।