Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

মানুষের যত ক্ষোভ

নভেম্বর ৫, ২০২১, ০৭:৫০ পিএম


মানুষের যত ক্ষোভ

জার্মানির লাখ লাখ গাড়িচালক তাদের গাড়ি রাস্তায় রেখে প্রতিবাদ করেছিল। তখন জার্মান সরকার জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। আমাদের তাই করা উচিত, সবার গাড়ি রাস্তায় রেখে বাসায় চলে আসা উচিত। রাস্তা বন্ধ থাকবে— তাহলে ভিআইপিদের গাড়ির চাকাও ঘুরবে না।  সব মানুষের দাবি আদায়ে অংশগ্রহণ থাকবে, এমনই বলছিলেন রাজধানীর এক স্কুলশিক্ষক জসিম শেখ।

 তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই যানবাহন চলাচল বন্ধের উপায় আছে। কিন্তু চালের ও অন্যান্য খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই খাদ্য বন্ধ করে রাখা যায় না বলেও এর সমাধান হয়না। বিদ্যুৎ বিল বাড়তি নেয়া হচ্ছে,  দুই বছর যাবত, এটা বন্ধ করে রাখা যায় না বলেও সমাধান হয় না। সবাই সমান টাকা দিচ্ছে, কেউই কিছু বলে না।  চলছে চলবেই— হজম করে নিচ্ছে— আর কত! ১৭ কোটি মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। একজন থেকে পাঁচ টাকা হারে বেশি নিলে প্রতিদিন কয় টাকা হয়? ৩০ দিনে কয় টাকা হয়? বছর শেষে কয় টাকা হয়? এভাবে আপনার আমার টাকা বড়লোকদের পকেটে চলে যায়। চলছে চলবেই— হজম করতে থাকেন... এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকা কলেজের  শিক্ষার্থী ওবাইদুর সাঈদ। 

গত বৃহস্পতিবার ঘোষণা ছাড়াই আকস্মিকভাবে বাড়ল ডিজেল ও কেরোসিনে লিটার ১৫ প্রতি টাকা। এ ছাড়া তরলিকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির দাম কেজিতে বাড়ানো হয়েছে সাড়ে চার টাকা। পাশাপাশি রেটিকুলেটেড এবং যানবাহনে ব্যবহূত অটোগ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে চলছে আন্দোলনও। মালিক ও পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় বের করছেন না গাড়িও। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষ ও সচেতন মহলে ক্ষোভ বিরাজ করছে। 

মাসুম হোসাইন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন,সাময়িক কষ্ট হলেও আমি মনে করি ওদের ধর্মঘট দেয়া ঠিক আছে। সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বগতি কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না, করলেও জোরালো কোনো ভূমিকা নেই। তাই ধর্মঘট দিয়ে ভালোই করছে। রুদ্র আলম বলেন, পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি, যে দেশের মানুষের কোনো মূল্য নেই, সব কিছু চাপিয়ে দেয়া হয় সাধারণ মানুষের ওপর। 

অর্থনীতিতে অভিজ্ঞ ও ব্যবসায়ী কাজী নজরুল বলেন, বাস ভাড়া কত শতাংশ বাড়ানো উচিত এটা আলোচনার আগে মৌলিক প্রশ্নের ওপর মীমাংসা হওয়া উচিত। জ্বালানি খরচ ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির যুক্তি কি? এই আলোচনাটা প্রাসঙ্গিক করা উচিত। যখন সরকার ২০ শতাংশ বা তারও বেশি লাভ করছিল তখন সে মাত্র ৫ শতাংশ দাম কমিয়েছে (তাও মাত্র একবার)। অন্তত সাত বছর সরকার ১০-১৫ শতাংশ লাভ করেছে।  তখন সে জ্বালানির মূল্য কমায়নি। জ্বালানির দাম বাড়লে যাপিত জীবনের দরকারি সব পণ্যের দাম বাড়বে, এটা জেনে মূল জায়গায় হাত দেন। তেল বেঁচে সরকার সাত বছর লাভে ছিলো, লোকসানে মাত্র গত পাঁচ মাস। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। এমতাবস্থায় এত উচ্চ হারে তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তি কি?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পরিবহন শ্রমিক এবং মালিকদের ধর্মঘট যথার্থ ও যৌক্তিক বলে মন্তব্য করে বলেছেন, আজকে বাংলাদেশে পরিবহন শ্রমিকদের মালিকপক্ষের একটি কর্মসূচি চলছে। 

আমরা মনে করি, এটি শ্রমিকদের যথার্থ কর্মসূচি। কারণ কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই হঠাৎ ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ার ফলে প্রোডাকশন থেকে শুরু করে পণ্য সরবরাহসহ জনজীবনে এর প্রভাব পড়েছে। সেই সাথে গণমানুষের জীবনযাত্রার মানে একটা পরিবর্তন আসবে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এ জন্য জনজীবনে এক ধরনের অস্বস্তিবোধ করে আসছে। এরপর ডিজেল ও কেরোসিনের অতিরিক্ত দামের প্রভাবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। তাই দ্রুত নির্ধারিত ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রত্যাহার করতে হবে।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে সরকার ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম একসাথে লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধি করে জনগণের ওপর নির্দয় আঘাত করেছে। এই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তিতে ফেলবে। সবকিছু লাগামহীন হয়ে যাবে।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার নির্বাচিত নয় বলেই সংসদ কিংবা জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করতে হয় না। তাই যা ইচ্ছা তাই করছে সরকার। নিজেদের পকেট ভারী করার জন্য, ব্যবসা করার জন্য সব জিনিসের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের দামও বৃদ্ধি করা হয়েছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস এসব কারা আমদানি করে। এতে সব ধরনের দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এ সরকার বিবর্তনমূলক, দমনমূলক আচরণ করছে।’

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি বলেছেন, ‘অযৌক্তিকভাবে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। তেলের দাম বৃদ্ধিতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বাড়বে। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। এ অবস্থায় তেলের দাম বৃদ্ধি মানুষের জীবনযাপন আরও কঠিন করে তুলবে।’

ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেছেন, কোভিডের মধ্যে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। মোট দরিদ্রের সংখ্যা ৪২ শতাংশ বা প্রায় সাত কোটি। বেকার হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। এর মধ্যে দফায় দফায় নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে। বহু পণ্যের মূল্য এখনো ঊর্ধ্বগতিতে। এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি অত্যন্ত অমানবিক সিদ্ধান্ত। 

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে শুধু এই পণ্যটির মূল্য ওঠা-নামা করে না, এর সঙ্গে পরিবহন ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য এবং সেবার মূল্যও বেড়ে যায়। ফলে সরকার একটি পণ্যের মূল্য বাড়ালেও ভোক্তাকে বহু পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ভার সইতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে যা ভোক্তা সাধারণের নাভিশ্বাস সৃষ্টি করবে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় পণ্য রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ডিজেল, কেরোসিন ও এলপিজি গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। কাজেই তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং সেটা যাতে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।’