Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

জ্বালানির উত্তাপ বাজারে

নভেম্বর ৭, ২০২১, ০৬:১৫ পিএম


জ্বালানির উত্তাপ বাজারে

জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করেছে সরকার। আর ফার্নেস অয়েলের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারপ্রতি তিন টাকা। আর এই দাম বৃদ্ধির উত্তাপ লেগেছে নিত্যপণ্যের বাজারে। বিশেষ করে সবজি ও মাছের বাজার বেশ চড়া। সাধারণত রাজধানীর বাইরে থেকে আমদানি করে মাছ ও সবজির চাহিদা মেটানো হয়। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ায় পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। 

এর ফলে স্থায়ীভাবে দাম বাড়লো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে ট্রাকের ভাড়া পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বেড়ে গেছে। এই ভাড়া যোগ হবে সবজি ও পণ্যের দামের সাথে। এর ফলে স্থায়ীভাবে দাম বেড়ে গেলো। একই সাথে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ের ওপর। 

গত তিনদিনের ধর্মঘটের কারণে সবজি ও মাছসহ প্রায় সব পণ্যের দাম ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। প্রতিটি নিত্যপণ্য কিনতে ক্রেতাকে বাড়তি পাঁচ থেকে ১০ টাকা গুনতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমে কঠিন হয়ে উঠছে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা।

গতকাল রোববার রাজধানীর শ্যামবাজার, যাত্রাবাড়ী, কাপ্তানবাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজির দামই বেড়েছে। দুদিন আগে যে বেগুন ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে, সেই বেগুন এখন ৭০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা মরিচ বাজারভেদে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যে সাইজের ফুলকপি দুদিন আগে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেগুলো এখন ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাঁধাকপি প্রতিটি আকারভেদে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দুদিন আগেও পাঁচ থেকে ১০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে। 

এছাড়া মুলা, চিচিঙ্গা, ঝিঙে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, লাউ ৬০ টাকা, মিষ্টি কুমড়ো ৭০ টাকা ও করলা ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে বাজারগুলোতে শিম বিক্রি হয়েছে ১২৫-১৩০ টাকায়, একই মানের শিম এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। 

গাজরের কেজি ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা, ঢেঁড়শ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, টমেটো ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, বরবটি ৬০ থেকে ৭০ টাকা, পটোল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। চড়া পেঁয়াজের দামও। দুদিন আগে খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় পাওয়া গেছে। একই মানের পেঁয়াজ এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আটা, ময়দা, শুকনা মরিচ, আলুসহ বেড়েছে আরও কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, শীতের সবজি বাজারে আসতে শুরু করায় দামও কমের দিকে যাচ্ছিল। এমন সময় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে দাম আরও বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধর্মঘটের কারণে বাজারে চাহিদার তুলনায় নিত্যপণ্যের সরবরাহ কম। আর বিভিন্ন মাধ্যমে কিছু পণ্য বাজারে আনা হলেও পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা ছাড়া বিকল্প নেই। তেলের দাম বেশি তাই ট্রাক ভাড়াও বেড়ে গেছে। কেনা খরচ বাড়লে বেশি দামে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই।

অপরদিকে সম্প্রতি পণ্যের দাম বাড়িয়েছে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। প্রতি কেজি সয়াবিন তেল কেজিতে ১০ টাকা ও ডাল কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি দামে ১১০ টাকায় সয়াবিন তেল ও ৬০ টাকায় মসুর ডাল বিক্রি করছে সংস্থাটি। একই সাথে বেড়েছে মাছের দাম। যেকোনো ধরনের মাছ কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। বড় আকারের কাতল, রুই ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় পাওয়া গেছে। তেলাপিয়া ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা, চিংড়ি ৫৮০ থেকে ৭৫০ টাকা, পাবদা ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা, পাঙাশ ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা, কৈ ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা, শিং ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, টেংরা আকারভেদে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ব্রয়লার মুরগির দাম সামান্য কমেছে। কেজিতে ১০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায়। সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকায়। আর লেয়ার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। ডিমের দামও কিছুটা কমেছে। ফার্মের লাল ডিম হালিতে দুই টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৮ টাকায়।

শ্যাম বাজারের সবজি ব্যবসায়ী রাসেলা বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ায় ট্রাক ঢাকায় আসতে আগের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। এই বাড়তি ভাড়া সবজির দামের সাথে যুক্ত হচ্ছে। তাই সামনে শীতের ভরা মৌসুমেও সবজির দাম কমার সম্ভাবনা নেই।’ 

ব্যবসায়ী নাসির হোসেন জানান, ‘বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সবজি এনে ঢাকার চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে সবজির সরবরাহ কমে গেছে। এতে করে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন আড়তে থেকে কিছু সবজি বাজারে আনা হলেও পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে।’

মাছের আড়তের ব্যবসায়ী মিরাজ হোসেন বলেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। বেশি দামে কেনার কারণে বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। না হলে লোকসান হবে। ক্রেতারা বলছেন, শীতের সময় বিভিন্ন ধরনের সবজি বাজারে ওঠে। এখন যদি সবকিছু নাগালের বাইরে থাকে তাহলে অন্য সময় অবস্থা কী হবে। 

যাত্রাবাড়ী বাজারে বাজার করতে এসে মো. বশির বলেন, ‘দাম শুনেই চোখেমুখে অন্ধকার দেখি। সবকিছুর দাম বেশি। একবার দাম বাড়লে আর কখনো কমে না। এ অবস্থায় আরও বাড়লে আমরা সাধারণ মানুষ বাঁচবো কীভাবে।’ রিপা বেগম বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর জন্য নানা অজুহাত খোঁজে। সরকার তেলের দাম বাড়ানোর আগেও সব কিছুর দাম বেশি ছিলো। এখন তারা ভালো একটা অজুহাত পেলো। এই অজুহাতে ব্যবসায়ীরা এখন আরও লাগাম ছাড়া হয়ে যাবে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সব কিছুর দাম বাড়বে। ধর্মঘটের কারণে বাজারে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে। যেহেতু তেলের দাম কমছে না তাই বর্ধিত স্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে।’

অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, সাধারণত বাজার সিন্ডিকেট, পণ্য মজুদ বা অন্য কোনো কারণে দাম বাড়লে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু একই সাথে পরিবহন খরচ ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় নিত্যপণ্যের দাম স্থায়ীভাবে বেড়ে গেলো।