Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

৯২ প্রাণহানিতেও আদালত চুপ!

নভেম্বর ১২, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


৯২ প্রাণহানিতেও আদালত চুপ!

ভোট এখন রক্তক্ষয়ী সংঘাতের! প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন, সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখল, ব্যালটে সিলমারা, ককটেল বিস্ফোরণ। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারের ইউপি ভোটেও ৭ খুন। তবে খুন, রক্তক্ষয়ী ঘটনাকে অতি আবেগে সহিংসতা বলে দাবি নির্বাচন কমিশনের। 

তারা বলছে, ঘরে ঘরে পাহারা দিয়ে নির্বাচনি সহিংসতা ঠেকানো যাবে না। অন্যদিকে শুধু ইউপি ভোটে ৩৭ মৃত্যুর সহিংসতাকে ‘ঝগড়াঝাটি’ বলে মনে করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন নির্বাচনি সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন।

 স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পার হয়ে এসে প্রাণহানির নির্বাচনকে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ বলায় তা জাতির জন্য এক কলঙ্কময় অধ্যায় বলেও মনে করা হচ্ছে। এতো মৃত্যুর পরও নির্বাচন কমিশনের জবাবদিহি না থাকায় দেশের সাধারণ মানুষসহ সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। 

তারা বলছেন, বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৫০ বছরেও এ ধরনের নির্লিপ্ত ভোটের চিত্র কেউ দেখেনি। এমন ভোট ও রক্তের দৃশ্যপট দেখেও আমাদের আদালত কেন নির্বাচন কমিশনকে জিজ্ঞাসা করছেন না—  কেন নির্বাচনে এত প্রাণহানি হচ্ছে? এ বিষয়গুলো এখন মাঠ থেকে উঠে আসছে। দিনভর গণমাধ্যমে সংঘর্ষ আর নিহতের খবর পেয়ে দিনশেষে কমিশনের ‘সুষ্ঠু ভোটের’ দাবিকে বিস্ময়করভাবে দেখছে সাধারণ মানুষের এক বড় অংশ। এতো সহিংসতা ও প্রাণহানির নির্বাচন কেন বাতিল করা হচ্ছে না— এ বলেও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। 

একটি কলেজের শিক্ষক হাসান ওয়ালি ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন : সুস্থ থাকলে সুষ্ঠু হওয়ার অর্থটা বুঝতেন। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে; এতো  প্রাণহানিতে সুষ্ঠু নির্বাচন জাতির জন্য এক কলঙ্কময় অধ্যায়। আমাদের কমিশন ও দায়িত্বশীলরা হয়তো সুস্থ নেই, তাই সুষ্ঠুর মর্মার্থ তারা বুঝতে পারছেন না। 

একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী শাকিলা জান্নাত বলেন, এটা ভোটের আগেই সবাই জানে যে, এ দেশে ভোট সব সময় সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর হয়। কিছু শব্দ ও বাক্য আমাদের মুখস্থ। মাঝে মাঝে একটু ঝগড়াঝাটি, মরামারি, ব্যালট বাক্স-ইভিএম লুট হয়। এসব কিছু কথা আমরা সব সময় শুনি। এগুলো কোনো ব্যাপারই নয়। সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় হলো, এখন আর সবাইকে কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে খুশিতে, ঘোরতে, ঠ্যালায় ভোট দেয়া লাগে না! 

একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাজ করেন রেজাউল করিম। তিনি বলেন, দ্বিতীয় ধাপের ইউপি ভোটে সাতজন মানুষ নিহত হলো; তারপরও বিশেষ গোষ্ঠী  বলতে পারলো নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে হচ্ছে। ইউনিয়ন নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির জন্যই এত সংঘাত। ইউনিয়ন নির্বাচনে দলীয় রাজনীতি বন্ধ করা হলে সংঘাত কমে যাবে।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৮ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। 

নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪১, বিএনপির ২, সাধারণ মানুষ ২২, পুলিশের গুলিতে ১৫ এবং একজন সাংবাদিক মারা গেছেন। গতকাল নির্বাচনে ৭ জন নিহত নিয়ে মোট মারা গেছেন ৯২ জন। সহিংসতাগুলো বেশিরভাগই ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সংঘটিত হয়েছে।   

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সহিংসার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বহীনতা,  উদাসীনতা। এ নির্বাচন কমিশনের পেছনে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। জনগণের টাকায় কমিশনাররা নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু শুধু সুষ্ঠুভাবে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারছেন না। তারা সহিংসতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। প্রকাশ্যে সরকারি দলের নেতা একে-৪৭ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। 

উল্টো কখনো কখনো তারা বলছেন— নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে! গত ৫০ বছরের নির্বাচন কমিশন বিশ্লেষণ করে এ ধরনের নির্লিপ্ত কমিশন দেখা যায়নি বলে মনে হয় আমাদের। কিন্তু  আমাদের আদালত কি কখনো নির্বাচন কমিশনকে জিজ্ঞাসা করেছে নির্বাচনে এত প্রাণহানি কেন হচ্ছে? এমন প্রশ্নও তোলেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। 

স্থনীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে তারা এই নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না। ৩৭ জনের মৃত্যুর পর এটা কীভাবে ‘ঝগড়াঝাটি’ হয়!  

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন তো নিজেদের অবস্থান আগেই নষ্ট করে ফেলেছে। এ ধরনের সহিংসতা বন্ধে তাদের কোনো ধরনের পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তাদের কেউ মাঠেও নেই।  কমিশনের লোকজন বেতন-ভাতা নিচ্ছে, কিন্তু দায়িত্ব পালন করছে না। কমিশন যদি কঠোর হস্তে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতো, নির্বাচন বাতিল করতো, তাহলে এই সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এত প্রাণহানির পরও কোথাও নির্বাচন বাতিল করা হচ্ছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নির্বাচন কমিশনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নেই। ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের চেয়ে পরবর্তী ধাপগুলোতে এই সহিংসতা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।